শ্রুতি নাটক ‘মহলার আড্ডায়’

- Advertisement -

শিবশঙ্কর সাহা

পরিমার্জনা- দেবা রায়

উপস্থাপনা- শহীদ স্মৃতি সংঘের নিজস্ব নাট্যদল ‘দক্ষিণের বাতাস’

প্রথম অভিনয়- ২১.২.২৪

অভিনয়ে- মৌসুমি দত্ত, রাজরূপা সেন, কল্যান দাস, অর্কন ব্যানার্জী ও শিবশঙ্কর সাহা

নাটকের মহড়া চলছে

কল্যান/ সাজাহান।। আমার হৃদয় এক শাসন জানে। সে শুধু স্নেহের শাসন। বেচারী মাতৃহারা পুত্রকন্যারা আমার! তাদের শাসন করবো কোন প্রাণে জাহানারা! ঐ চেয়ে দেখ- তারপর বলিস তাদের শাসন করতে।

মৌসুমি/ জাহানার।। পিতা, এই কি আপনার উপযুক্ত কথা! এই দৌর্বল্য কি ভারত সম্রাট সাজাহানকে সাজে! সাম্রাজ্য কি অন্তঃপুর! একটা ছেলেখেলা! একটা প্রকাণ্ড শাসনের ভার আপনার ওপর, এটা বুঝুন! প্রজা বিরোধী হ’লে সম্রাট কি তাকে পুত্র বলে ক্ষমা করবেন? স্নেহ কি কর্তব্যকে ছাপিয়ে উঠবে?

কল্যান/ সাজাহান।। তর্ক করিস না জাহানারা। আমার কোনো যুক্তি নাই। আমার কেবল এক যুক্তি আছে। সে হল স্নেহ। দারা আমি শুধু ভাবছি যে, এই যুদ্ধে যে পক্ষেরই পরাজয় হোক না কেন, আমার ক্ষতি সমান সমান। এই যুদ্ধে তুমি পরাজিত হলে, তোমার ম্লান-মুখখানি আমার দেখতে হবে, আবার তারা পরাজিত হ্যে ফিরে গেলে তাদের ম্লান-মুখ কল্পনা করতে হবে। না না কাজ নেই দারা। তারা রাজধা্নীতে আসুক, আমি তাদের বুঝিয়ে বলবো।

শিব/ দারা।। পিতা, তবে তাই হোক। (কথা শেষ হবার আগেই শিব কেশে ওঠে)

মৌসুমি।। এই দেখো, দারাও জল আনি।

শিব।। (নিজেকে সামলে নিয়ে) না ঠিকাছে, মৌসুমী এবার যখন ব্রেক হোক। Let’s have some tea first, cookies ভি দেনা। 

মৌসুমী।। না হবে না তোমার এই হিংলিশ ভাষায় চাইলে কিচ্ছু পাবে না। দেবই না।

অর্কন।। মৌসুমিদি শোনো ‘আমাকে চা দাও’, পুরো বাংলায় বললাম কিন্তু। 

মৌসুমি।। এই জন্য তোকে চা দেব, অপেক্ষা কর এক্ষুনি দিচ্ছি। 

কল্যাণ।। আচ্ছা শিবদা তুমি কি জান এই বাংলা ভাষার জন্যে ১৯৫২ সালে ২১ শে ফেব্রুয়ারি কতজন প্রাণ দিয়েছেন।

রাজরূপা।। ঠিক তাই, সম্মিলিত রাষ্ট্রপুঞ্জ আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে এই দিনটিকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এটা নিশ্চই তুমি জান না।

শিব।। হ্যাঁ সোসাল মিডিয়ার দৌলতে আজ সবাই সব জানে। তবে এটা একটা আর্ন্তজাতিক ভাষা। ইংরেজী ছাড়া আজ সবকিছু অচল।

চা নিয়ে মৌসুমির প্রবেশ ।    

মৌসুমি।। এই নাও চা এসেগছে, সবাই নিয়ে নাও, না- এই শিবদা তুমি পাবে না, আগে ইংরাজী ছাড়া-

শিব।। দিস ইস ব্যাড – দূর ইংরাজী ছাড়া ইমপসিবল! – ওহ শিট!   

মৌসুমি।। দুঃখিত, আমি মানতে পারলাম না, এইতো সেদিন ব্যাংক থেকে ফোন করে হিন্দি ইংরেজিতে বকবক করছে আমি বাংলায় বলতে বললা্‌ম, প্রথমে গাইগুই করল তারপর, যে বাংলায় বলতে পারে তাকে কথা বলতে দিল। ভুল বুঝলে হবে না, আমরা তো কোন ভাষার বিরুদ্ধে নই, মাতৃভাষার দিকে। আমার মায়ের ভাষাকে আমি ভালোবাসি।   

রাজরূপা।। তাইতো! ইংরেজি তো ভাব বিনিময়ের একটা মাধ্যম মাত্র। ইংরেজি জানে মানেই, সে জ্ঞানী তা তো নয়।      

শিব।। বাস্তবটা কিন্তু উল্টোকথা বলে, বাসে ট্রেনে ঝগড়া লাগলো তো, ব্যাস একজন  ইংরেজিতে ঝগড়া শুরু করে দিল। Why they do that? Bengali medium school বন্ধ হয়ে যাচ্ছে চারিদিকে, আর english medium school রমরমিয়ে চলছে।   

কল্যাণ।। আরে থামো তোমার রমরমিয়ে! সেদিন যে চাঁদে চন্দ্রযান নামল, যেকজন বাঙালি বিজ্ঞানী দেখলা্‌ম, অধিকাংশই তো বাংলা মাধ্যমে পড়া। তা তাঁদের কি গবেষণার কাজে কোনও অসুবিধা হয়েছে?      

রাজরূপা।। সারা পৃথিবীর কাছে মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ। যে ভাষায় আমি কথা বলি, যে ভাষায় আমি প্রথম মা বলি, যে ভাষা আমাকে আমার পরিবেশের সাথে মিশতে সাহায্য করে, তার গুরুত্ব আমার কাছে অনেক বেশী। বুঝলে?   

অর্কন।। শোনো শোনো আজ বাংলা না জানাটা, বাংলা না বলাটাকে কৃতিত্ব মনে করছে ওই অভিভাবকেরা। এই ব্যাপারে মৌসুমিদি একটা ভালো কবিতা আবৃত্তি করে, শোনাও না মৌসুমি দি। প্লিজ। 

মৌসুমি।। কিনতু আমাদের সাজাহানের রিহার্সাল কিন্তু হচ্ছে না, সামনে শো-

অর্কন।। ও ঠিক হবে, কথা যখন উঠলোই, শিবদাকে কবিতাটা শুনিয়ে দাও, আমিও শুনতে চাই।

রাজরূপা।। হ্যা মৌসুমি কর না। শুনি।

মৌসুমি ।। আচ্ছা বলছি। ভবানী প্রসাদ মজুমদারের কবিতা-

ছেলে আমার খুব সিরিয়াস, কথায় কথায় হাসে না

জানেন দাদা, আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না।

ইংলিশে ও ‘রাইমস’ বলে

ডিবেট’ করে, পড়াও চলে

আমার ছেলে খুব ‘পজিটিভ’ অলীক স্বপ্নে ভাসে না

জানেন দাদা, আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না।

ইংলিশ! ওর গুলে খাওয়া, ওটাই ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ

হিন্দি সেকেন্ড, সত্যি বলছি হিন্দিতে ওর দারুন তেজ।

কী লাভ বলুন বাংলা পড়ে?

বিমান ছেড়ে ঠেলায় চড়ে?

বেঙ্গলি থার্ড ল্যাঙ্গুয়েজ, তাই তেমন ভালোবাসে না

জানেন দাদা, আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না। 

অর্কন।। অসাধারণ, শিবদা এটা শুনেছো আগে? আরে শুধু শুধুই কি UNESCO থেকে বাংলা ভাষাকে পৃথিবীর সবচেয়ে মিষ্টি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে? তুমিই বল না-

শিব।। সব মানলাম। Point taken। আমারও যে বাংলা গান, সে যে কোনো ফর্মে হোক  লোকগীতি, আধুনিক, রবীন্দ্র সংগীত, রামপ্রসাদী ভালো লাগেনা তা তো না। খুবই লাগে। তবে সবই বহুকাল আগের। আর এখন সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা, ঝকঝকে ছাপায় উপেন্দ্রকিশোরের বই, আজ যেখানে আমরা World Citizen, বিশ্ব নাগরিক কিন্তু বিশ্বমানের সেইসব প্রযোজনা কই? 

মৌসুমি।। এর একটা জবাব আছে। আমরা ততক্ষণই বাংলা প্রেমিক যতক্ষণ আমাদের পকেট থেকে পয়সা খরচ না করতে হয়।  

রাজরূপা।। ঠিক। বছরে একটা বাংলা বই পড়িও না বাংলা নাটক দেখতে যাই না পাঁচ বছরে একটাও। পাড়ার মাঠে মন দিয়ে নাটকটা না দেখেও বলে দি দারুন করেছিস, পয়সা খরচ তো বড় ব্যাপার সময়ও দি না, উৎসাহও দি না।

শিব।। আচ্ছা আমি কি চা পাবনা, পাবনা আমি চা।

মৌসুমি।। এবার পাবে। 

কল্যাণ।। তবে দেখো এই সদ্য পদ্মশ্রী পাওয়া রতন কাহারের গানগুলো শুনেছো! সারা দেশের মানুষের হৃদয় জয় করে নিয়েছে।

অর্কন।। ঠিক। গবেষকরা ‘বড় লোকের বেটি লো’ গানটার গীতিকার হিসেবে রতন কাহারকেই মেনে নিয়েছেন, এবং এর জন্য তাকে পাঁচ লক্ষ্ টাকা পাঠান হয়েছে। একজন বাংলা ভাষায় গান লিখে এতো টাকা এর আগে কোনো গীতিকার পেয়েছেন বলে আমার জানা নেই।

রাজরূপা।। ঠিক শিল্প তার ভাষাতেই সুন্দর হয়ে ওঠে, সেই কিংবদন্তী গানটা দু কলি শোনা না অর্কন।

অর্কন।। আমি তো পারব না, তবে তারই কন্ঠে শোন-

গান- টা- রেকর্ডে বাজে, বড় লোকের বেটি লো…

মৌসুমি।। আর একটা কথা না বললেই নয়, আমার কাছে বাংলা এমন একটি ভাষা, যা ভাষায় দুটো ধর্মের মানুষ একসাথে গলা মেলায়। দুই বাংলা মানুষ এক সাথে রবীন্দ্র-নজরুলকে মনে রাখে।

রাজরূপা।। ‘একই বৃন্তে দুটি কুসুম’ এই শব্দবন্ধের মধ্যে দিয়ে হিন্দু-মুসলমানের বন্ধুতাকে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে কাজী নজরুল ইসলাম।

শিব।। Exactly

সকলে।। আবার-

শিব।। আচ্ছা বেশ। আমি চেষ্টা করছি। আমি আজ থেকে সম্পূর্ণ বাংলা ভাষায় কথা বলা প্র্যাক্টিস

সকলে।। এই-

শিব।। ‘অভ্যাস’- হ্যা আজ থেকে আমি সম্পূর্ণ বাংলা ভাষায় কথা বলা ‘অভ্যাস’ করব।

সকলে হাততালি দেয়।

শিব।। তোরা হয়তো ভাবছিস, আমি কথায় কথায় ইংরাজী বলাটাকে সঠিক মনে করি, আসলে আমি একটা পরীক্ষা করছিলাম, তোরা কি করিস। দেখলাম, তোরাই আমার আসল বন্ধু, যারা নিজের মাতৃভাষাকে শ্রদ্ধা করিস।

কল্যান।। মায়ের ভাষায় কথা যে সুখ পাই তা যেন স্বর্গসুখ

মৌসুমি।। ঠিক তাই, আসলে মানসিকতা পরিবর্তন হবার দরকার আছে।

রাজরূপা।। আমিও তাই বলছিলাম, আমরাই মনে যদি আমার ভাষা সম্পর্কে শ্রদ্ধা না রাখি- তাহলে কারা রাখবে-

অর্কন।। তোমরা মনে হয় জান না, বিশ্বে আরোও একটা দেশ বাংলা ভাষায় কথা বলে।

সকলে।। সেটা কোন দেশ?

অর্কন।। বাংলাদেশ থেকে ১৫ হাজার কিলোমিটার দূরের দেশ পশ্চিম আফ্রিকার আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূলে অবস্থিত, সিয়েরা লিওন প্রজাতন্ত্র। বাংলা ব্যবহৃত হচ্ছে তাদের সরকারী ভাষা হিসেবে। একে হীরা খনির দেশ বলে। ভীষণ গরীব এদেশের মানুষ। যুদ্ধ বিদ্ধস্ত এই দেশে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শান্তির দূত হিসেবে এসে, তাদের দেশের শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন, এবং তাদেরকে বাংলা ভাষা চর্চায় অভ্যাস করাতে শুরু করেন। আজ সেই দেশের রাষ্ট্র ভাষা বাংলা।

শিব।। বাহ তথ্যটা পেয়ে গর্বে বুক ভরে গেল অর্কন। সাহিত্য, সিনেমা, আঁকা, নাচ, গান সব ক্ষেত্রেই বাংলা বিরাজমান- হ্যাঁ আমি আমার ভাষার জন্য গর্বিত।

সকলে।। আমরা আমাদের ভাষার জন্য গর্বিত।   

মৌসুমি।। হ্যাঁ তাই তো বললাম, আমাদের ভাষার অনেক ক্ষমতা, অতুলপ্রসাদ গানেই সে কথা বলে গেছেন- 

সকলে প্রথমে গানটা শুরু করে তারপর রেকর্ডে তা বাজতে থাকে।

মোদের গরব, মোদের আশা, আ’মরি বাংলা ভাষা! ২

মাগো তোমার কোলে, তোমার বোলে, কতই শান্তি ভালবাসা! ২

মোদের গরব …  

কী যাদু বাংলা গানে! গান গেয়ে দাঁড় মাঝি টানে,

গেয়ে গান নাচে বাউল, গান গেয়ে ধান কাটে চাষা। আ’মরি বাংলা ভাষা

মোদের গরব …

বিদ্যাপতি, চণ্ডী, গোবিন, হেম, মধু, বঙ্কিম, নবীন 

ঐ ফুলেরই মধুর রসে বাঁধলো সুখে মধুর বাসা।।

ঐ ভাষাতেই প্রথম বোলে, ডাকনু মায়ে ‘মা, মা’ ব’লে ;

ঐ ভাষাতেই বলবো হরি, সাঙ্গ হ’লে কাঁদা হাসা।।

সমাপ্ত

- Advertisement -
সাম্প্রতিক পোস্ট
এধরনের আরও পোস্ট
- Advertisement -