সত্যজিৎ রায়ের সাথে সাইন্স ফিকসন নিয়ে আলাপচারিতা

- Advertisement -

(সত্যজিৎ রায়ে এই সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন ড. অমিত চক্রবর্তী ও সংকর্ষন রায়, আকাশবাণীর বিজ্ঞান বিভাগ থেকে প্রচারিত হয়েছিল আশির দশকের গোড়ায়।)

একটা বিজ্ঞান ভিত্তিক লেখা বা সাইন্স ফিকশন এসবও বিশেষভাবে লেখা হচ্ছে, আমার নিজের একটা ধারণা যে সাহিত্য বিজ্ঞান ভিত্তিক না হলে সেটা সার্থক হয় না। সত্যজিতবাবু এ বিষয়ে আপনার কি মনে হয়?  

হ্যাঁ মেনে একটা ত গেল, যাকে কল্প বিজ্ঞানের গল্প বলা হয়, যেটা সাইন্স ফিকসনই বলুন বা সাইন্স ফ্যান্টাসিই বলুন, সেটা তো আলাদা একটা জাতের মধ্যেই পড়ে যাচ্ছে। তবে হ্যা সাধারণ গল্পে আপনি দি মানুষদের নিয়ে, মাউশদের কথা লেখেন বা সেখানেতো বিজ্ঞানের একটা দিকতো এসেই যাচ্ছে, যাকে মনস্তত্ব বলা যেতে পারে। মানুষের মন, বিশেষ করে আমার ছবি-টবিতে, আমার   গল্পটল্পতে সবসময় মানুষের মন একটা বড় ভুমিকা গ্রহণ করে, মানুষের সম্পর্ক তাদের ব্যাবহার কথাবার্তা সবকিছুর মধ্যে যে  একটা… আমরা সত্য, বলা যেতে পারে আমরা যে ট্রুথটার দিকে যাবার চেষ্টা করি

সত্য তো বিজ্ঞান সম্মত হবেই।

দৈনন্দিন জীবনে যা অভিজ্ঞতা, মানুষ চেনা জানা, এমনকি দেশ বিদেশ সম্মন্ধেও যে সমস্ত কথা লেখা হয়, বা শহর সন্মন্ধে বা আরেকটা দিক যে মানুষের , বিভিন্ন স্তরের মানুষ সম্পর্কে যে লেখা গান সম্মন্ধে, সবসময়য়ই একটা বিজ্ঞানের দিক , সেরকম ভাবে দেখতে গেলে তো থেকে যাবেই। যেটা প্রথম কথা বললাম,  মনস্তত্বের দিকটা ত থাকবেই, সেটা তো একটা বর ব্যাপার, সে বিজ্ঞানটা নিয়ে পড়াশুনা না করা থাকলেও চলে, মানুষের  অব্জাভেশনের ওপরেই পর্যবেক্ষণের ওপরেই সত্যটাকে চিনে নেওয়া, এ ক্ষমতাটা তো সাহিত্যিকের থাকতেই হয়।

আমি একটা কথা বলি, আপনি যে অবজারভেশনের কথা বললেন, সেটা বোধ হয় একটা সাইন্টিফিক মেথড মানে বিজ্ঞানেরই একটা মেঠড তো?

হ্যাঁ বটেই তো, মেথড তো বটেই।

সেই হিসেবে বিজ্ঞানটাই থাকছে ওর ভিতরে।

হ্যাঁ থাকছে, কিন্তু সেটা সম্পর্কে আমরা যে সবসময় সচেতন তা কিন্তু না।

হ্যা তা না। ঠিকই।

সেটাকে আলাদা করে একটা বিজ্ঞান নাম দিয়ে তাই নিয়ে বই লেখা, তাও হয়, ভাষা নিয়েই হয়। ভাষারই বিজ্ঞান রয়েছে, মানুষের কথাবার্তা, বিভিন স্তরের মানুষের বিভিন্ন জাতের মানুষের  বিবিন্ন অবস্থার মানুষের, বা বিভিন্ন ক্লাসে মানুষের, তাদের কথা বার্তার মধ্যে তফাত রয়েছে সেটাও তো আজপকাল বিজ্ঞানের  মধ্যেই পড়ে। সেটা লিঙ্গুইস্টিক্সের মধ্যে চলে যায়। সেরকম ধরতে গেলে আপনার গপ্পের যে কোনোও উপাদানকেই একটা দিক তার বৈজ্ঞানিক দিক দেখিয়ে দেওয়া যেতে পারে। এবং সেটার প্রতি আমাদের আনুগত্য বা সেটাকে মেনে চলা, বা সেটা যাতে ভুল না হয়, যেন ত্রুটী না থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখা মানেই বিজ্ঞানটাকে বাঁচিয়ে চলা,

আচ্ছা তাহলে কি আপনার মনে হয় সব লেখকেরই বজ্ঞান সচেতন হওয়ার দরকার? মানে বস্তু জ্ঞান, মানে আজকের পৃথিবীটাকে যদি আমরা বিজ্ঞান সম্মতভাবে না জানি, তাহলে যার আবিজ্ঞান ভিত্তিক লেখক নন, বা বিজ্ঞান সাহিত্য সৃষ্টি করছেন না, তারাও বোধহয়…

মোটামুটি ভাবে সেটাতো বলতেই হবে। তবে তার মানে এই নয়, যে বিজ্ঞানের যে একেবারে আধুনিকতম পরীক্ষানিরীক্ষা বা চর্চা হচ্চে, সেই সম্মন্ধেও যদি সেটা আনতে হবে, সেটা না হলেও হয়তো চলে। কেন আজকালতো সব সাইন্স-ই, ধরুন এস্ট্রোনমি  বলুন, বায়োলজি বলুন মাইক্রবায়লজি বলুন এমনভাবে বেড়ে যাচ্ছে, এমন ভাবে তার পরিধিটা বেড়ে যাচ্ছে, সেটা নিয়ে এতো গভীরভাবে আলোচনা হচ্ছে, যে তার হদিস রাখা সকলের পক্ষে, সকল সাহিত্যিকের পক্ষে

ধরুন আজকে অন্য একটা বিষয়ে বিজ্ঞানী তার পক্ষেও সেটা ধরে রাখা খুবই মুশকিল এখন

খুবই মুশকিল।

এতো স্পেসিফিক ও এতো বিস্তৃত হয়ে যাচ্ছে

ভয়ানক বিস্তৃত হয়ে যাচ্ছে।

আমি বলছি সাধারণ কিছুটা তো জানা উচিত।

সেটুকুতো খবরের কাগজ পরলেও লোকে জানতে পারে। তার জন্য যে মোতা মোটা বই পড়তে হবে সবসময় বা সবচেয়ে লেটেস্ট পত্রিকাগুলো পড়তে হবে এমনও কথা নেই, সুতরাং মোতামুটিভাবে শিক্ষিত মানুশ যাদের আমরা সাহিত্যিক বলবো, তাদের হয় জানা উচিত বা তাঁরা জানেও। অনেকক্ষেত্রেই জানে, আর যদি না জানে, যদি জানে তাহলে তাঁদের লেখা আরোও সমৃদ্ধ হবে।  

আচ্ছা এবার একটু কল্পবিজ্ঞানের ব্যাপারে আসা যাক। আমি একটু অন্য কথা বলি, সত্যজিৎ বাবু বললেন যে সাইন্স ফিকশন বা সাইন্স ফ্যান্টাসি, দুটোকেই কল্প বিজ্ঞানের গল্প বললেন, যেটা বলা হয়ে থাকে আরকি। কিন্তু এই দুটোর মধ্যেও তো তফাৎ করা হয়ে থাকে, মানে সাইন্স ফিকশন যেটা অনেক বেশী, যেটা আপনি একটু বললে…

না এটা হচ্ছে কি এক ধরনের গল্প যেমন আমি উদাহরণ দিচ্ছি, যদি একটা গপ্প লিখতে হয়, যেমন বহুকাল আগে জুল ভার্ন লিখেছেন, জার্নি টু দা মুন, ইত্যাদি ইত্যাদি, চাঁদে যাওয়া নিয়ে বা অন্য কোনো গ্রহে যাওয়া নিয়ে, মানুষে যাচ্ছে যদি একটা গপ্প লিখতে হয় তাহলে, স্বভাবতই আমরা ফিল্মেও এটা দেখেছি, ২০০১ ছবির কথা মনে পড়ছে বিশেষ করে, স্পেস অডিস্টি, তাতে যে সমস্ত বিজ্ঞানের তথ্য থাকবে সেগুলো একজন বৈজ্ঞানিকও নিশ্চয়ই যাতে তার চোখে ভুল না ঠেকে সেটা করতেই হবে, যেখানে মানুষে কি করছে না করছে, সেটা আজকাল সকলেরই জানা, বা কোন জিনিসটা সম্ভাব্য, কোন জিনিসটা সম্ভব নয় সেটা সকলেরই জানা। কাজেই সে বিষয়ে লিখতে গেলে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনা করতেই হবে, এবং বিজ্ঞানটা যথাযথ হতে হবে, বঈজ্ঞানিক তথ্যগুলোতে কোনো ভুল থাকলে চলবে না।

কিন্তু আবার আরেক ধরনের গপ্প হয়, যেমন আমিই লিখেছিলাম, যেটা একবার ছবি হবার কথা হয়েছিল, কিন্তু হয়নি, যাইহোক এলিয়েন বলে একটা চিত্রনাট্য আমি লিখেছিলাম, যাতে ব্যাপারটা ছিল, অন্য গ্রহ থেকে, একটি প্রাণী পৃথিবীতে আসছে। এখন তার যে মহাকাশ যান বা তার যে বিজ্ঞান, বা তার যে টেকনোলোজি সেটা সম্বন্ধে মানুষ তো এখনও জানে না। আর সেখানে আমাকে অনেকখানি কল্পনার আশ্রয় নিতে হয়েছে, এবং সেখানে কেউ যাচাই করে দেখতে যাবে না এটা হয় কি নাহয়। কারণ কি যে হয় না হয় তা আমরা এখনও জানি না। অন্য গ্রহ যে গ্রহ আমাদের থেকে অনেক বেশী টেকনোলজিতে এগিয়ে রয়েছে, তারা যে কোথায় পৌঁছেছে তার, তাদের পক্ষে সম্ভব, না সম্ভব, সেটা আমরা জানি না। তাহলে সেখানে অনেকটা কল্পনার আশ্রয় আমরা নিতে পারি। সেখানে আমরা কাব্যের জগতে চলে যেতে পারি, আমরা দর্শনের জগতে চলে যেতে পারি, কিন্তু মানুষ যখন কিছু করছে, যা দেখানো হচ্ছে, এমনকি আজ থেকে পঞ্চাস বছর পরে সে কি করছে তাও দেখানো হয়, তাহলেও আজকের দিনে যে, টেকনোলজি যে অবস্থায় রয়েছে, সেটার কথা চিন্তা করে আমাদের এগোতে হবে।

আচ্ছা এ প্রসঙ্গে, সত্যজিৎ বাবুরই লেখায়, মনে পড়ছে একটা, বেশ কিছুদিন আগে উনি সাইন্স ফিকশন বা সাইন্স ফ্যান্টাসি সম্পর্কে এক জায়গায় লিখেছিলেন যে, আমি আপনার লেখাতেই পড়েছি, ওখানে বলছেন, টাইম মেশিন সম্পর্কে আপনি বলছে, বতাম টিপলাম আমি চলে গেলাম, এখন আপনি এই এলিয়েন ছবির কথা বললেন, সেখানেও একটা বিশ্বাসযোগ্যতা আনার জন্য যেটুকু বজ্ঞান আনার দরকার সেটুকুতো আনতেই হবে?

হ্যাঁ তা তো আনতেই হবে। কারণ এমন তো কিছু হতে পারে না, যে একেবারে পৃথিবির সঙ্গে কোনও যোগ নেই, এরকম গ্রহ বা এরকম প্রাণী কল্পনা করা কঠিন, কারণ কতকগুলো খুব বেসিক লেভেলে, এমিনো এসিস বলুন, যার থেকে প্রাণ প্রন সৃষ্টি হচ্ছে, সেটা তো দেখা যাচ্ছে সব জায়গায়ই এক। প্রথমত পৃথিবীতে  সমস্ত প্রাণীর মধ্যে এক, এবং এখনও যেটা অনুমান করা হয়, অন্যগ্রহে যদি কোনও প্রাণী থাকেও, তাহলে তাদের প্রাণের উৎপত্তিটা বা মৌল উপাদানতা বোধহয় একই হবে।

আচ্ছা একটা কথা এ সম্মন্ধে আমি বলি যে, অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় যে কল্পনা, মানে সাহিত্যিকের কল্পনা নিশ্চই বিজ্ঞানীর কল্পনাকে ছাপিয়ে গেছে, কারণ জুলে ভার্নের কল্পনা যেখানে গিয়েছিলো, তৎকালীন বিজ্ঞানীদের কল্পনা সেইখানে পৌঁছোয়নি।  কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই মনে হয়, যারা বিজ্ঞান ভিত্তিক লেখক, বা বিজ্ঞান সাহিত্যিক, তারা বোধহয় বিজ্ঞানীদের অনুসরণ করেছেন, এরকমও তো হয়েছে অনেক, তাই না?

তাদের বৈজ্ঞানিকরা অনুসরণ করেছেন। এখন এটা ত বটেই, যে সত্যি কথা বলতে , আজকাল নামকরা যারা বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প লেখক, তাদের মধ্যে অনেকেই কিন্তু নিজেই বৈজ্ঞানিক। যেমন আর্থার ক্লার্কের উদাহরণ রয়েছে, এবং আর্থার ক্লার্ক, এখন ওই যে স্যাটেলাইট ব্যাবহার করা হচ্ছে, সেটা তিরিশ বছর আগে তার গল্পে ভবিষ্যত বাণী করে গেছিলেন।  

বা ধরুন নাইটিন ফর্টিসের প্রথম দিকে, যখন অ্যাটম বোম সম্পর্কে ম্যানহাটন কেউ জানতোই না, তখন ওরা গল্পে এনেছেন, তখন যে সমস্ত সাইন্স এবং সাইন্স ফিকশন নিয়ে পত্রিকা বেরোচ্ছে, তাতে এধরণের গল্প ছিল যে, অ্যাটম বোম ফেলানো বা এধরণের কনসেপ্ট।

নিশ্চই। সে তো দেখতে গেলে আপনি যদি পাঁচশ বছর পিছিয়ে যান, বা চারশ বছর পিছিয়ে যান, সেখানে লিওনার্দো দা ভিঞ্চি কি না করেছেন বলুন। তিনি তো কত কি যে দেখিওয়ে দিয়ে গেছেন, তখনকার যুগে বসে, যখন বিজ্ঞানের যুগ সবে শুরু হচ্ছে। তখন বসে বসে সেই এরোপ্লেন  হেলিকপ্টার হ্যানো ত্যানো, গ্রামাফোন, কি না তাঁর কল্পনার মধ্যে এসছে। কাজেই মানুষের কল্পনা, যে কতদূর যেতে পারে, এবং বিজ্ঞান পিছিয়ে থাকলেও ক্রমে ক্রমে চেষ্টা করে যে সেই কল্পনার… যদি সেতা তার মধ্যে সম্ভাবনা এতটুকু থাকে, তাহলেই । তার টেকনোলজির পসিবিলিটি যদি সামান্যতম থাকে, তাহলে সে একদিন না একদিন্ত তাকে ধরে ফেলবে। এবং সেটা বস্তবে পরিণত হয়ে যাবে।

আমাদের পুরাণকারদের কল্পনাতেও এমন হয়েছে যেমন

আরে বাবা সে তো আছেই, সেতো আমি শুনেছি যে, এত আমাদের এতেই রয়েছে কি বলে, যেমন একটা শোনা যায়। খুবই সম্ভবত সত্যি হিটলারদের জার্মানীতে ওয়ার অফিসে সমরাঙ্গণ- মানে ঐ যুদ্ধ সংক্রান্ত কিছু পুঁথি ছিল , সংস্কৃততে , সংস্কৃত পুঁথি, জার্মানীতে তো বহু ইডিওলজিস্ট বা সংস্কৃত পন্ডিত আছেন, এবং তার মধ্যে থেকে নাকি প্রথম সেই ওদের সেই মিসাইলের ধারণা নাকি তার থেকেই আসে। এরকমও শোনা গেছে।

আচ্ছা এইবার একটু আপনার কথায় আসতে চাই। সেটা হল এই, যে আপনি এই বিজ্ঞান ভিত্তিক লেখা বা কল্প বিজ্ঞান কাহিনী বা উপন্যাস আপনি লিখছেন, আপনি এই লেখার মধ্যে আপনি কি করে এলে?

অপরজন- না এ প্রসঙ্গে আমি একটু বলি, ধরুন আমরা ১৯২০ , ১৯৩০ র দশকে প্রেমেন্দ্র মিত্র বা অনেকেই লিখেছেন বিজ্ঞান ভিত্তিক গল্প বা কল্প বিজ্ঞানের গল্প, কিন্তু প্রফেসর শঙ্কুর  মতো একটা বিজ্ঞানীর চরিত্র নিয়ে গল্প লেখা এবং কল্প বিজ্ঞানের সাইন্স ফ্যান্টাসি এটা আমরা প্রথম একদম পেলাম, এবং ষাটের দশকে

অপর- এই যে একটা অসাধারণ চরিত্রের আপনি ইন্ট্রোডিউস করলেন, সেটা কি করে হল, সেটা এক্তি জানতে চাই। 

হল মানে, আমার তো এমনি লেখার কোনো প্রশ্নই ছিল না, আমি যে কোনোদিন লিখবো, বা সাহিত্যিক হব, বা গল্প বসে লিখতে হবে, এ আমি কোনোদিন ভাবিনি। আমি বিজ্ঞাপণের অফিসে কাজ করতাম, তারপর সেটা ছেড়ে ফিল্মে ঢুকলাম, আমি ফিল্মের কাজ করছি, তখন একদিন আমার বন্ধু কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় বললেন যে সন্দেশটাকে আবার বের করলে কেমন হয়? তা সেটা মনে ধরলো, ব্যাপারটা এবং তার ছ মাসের মধ্যেই ওতা ১৯৬১ তে, সন্দেশ আমরা নতুন করে বার করি, সুভাষ এবং আমি সম্পাদক ছিলাম, এবং সপ্নদের বেরনোর পর, স্বাভাবতই আমার মনে হল, এবার তো লিখতেই হবে, আর কিছু না হোল সন্দেশকে ফিড করার জন্য, প্রথম গল্পই কিন্তু আমার বলতে পারেন বিজ্ঞান ভিত্তিক গল্প, যদিও সেটা প্রফেসর শংকুর গল্প না, সেটা হচ্ছে বংকু বাবুর বন্ধু। এটা আমার জীবনে প্রথম বাংলা গল্প।

এবং পরে এই গপ্পটা প্রসঙ্গে যদি আশা যায়, সেটা পরে আসা যাবে, সেটা হচ্ছে এই গপ্পই, ভিত্তি ছিল, যখন আমি চিত্রনাট্য করি। যাই হোক, বংকু বাবুর বন্ধু লেখার পর আমি দু একটা ভুতের এ গল্প সে গল্প লিখে তারপর আমার মনে হল, এই শংকু ধরণের একটা  চরিত্র, ডায়েরী ফর্মটার কথা মনে হল, যে এটা হতে পারে, এবং এটা বোধহ্য সাবকন্সাসলি, আমার খানিক.টা কাজ করেছিল, হেসোরাম হুঁশিয়ারির ডায়েরী, আবার বার লেখা, সেটা আমার একটা ভয়ানক একটা প্রিয় লেখা। তাতে উনি কোনেন ডয়ালের লস্ট ওয়ার্ল্ড বা অজ্ঞাত জগতকে নিয়ে ঠাট্টা করেছিলেন, সেখানে বাবা যেগুলি তৈরি করেছিলেন, একেবারে কাল্পনিক কিছু, প্রাগৈতিহাসিক কিছু জানোয়ার, তাদের নাম ধাম, স্বভাব চরিত্র, এমনি কোনো বই খুলে সেবব এই জানোয়ারগুলোকে পাওয়া যাবে না, পুরটাই মজা করার জন্যে, ঠাট্টা করার জন্য, লেগ পুল করার জন্য বলা যেতে পারে, ঐটা নিয়ে একটা রসিকতা, রঙ্গ, আমারও প্রথম যেটা শংকু যেটা বোম যাত্রার যাত্রী, তার মধ্যে এই মেজাজটা বর্তমান, শঙ্কু যদিও ডায়েরী লিখছে, আপাত দৃষ্টিতে তাকে সিরিয়াস বলে মনে হবে, কিনতি তার প্রথম যে ইনভেনশন, নসাস্ত্র, স্নাফডান নস্যি সেটা মারলে ছাপ্পানবার হাঁচতে হবে। এ ধরনের কতগুলো ব্যাপার ছিল।

তা সেইটে লেখার পরে, কিন্তু ক্রমে ক্রমে, শঙ্কু সিরিয়াস হয়ে গেছে। কেননা ঐটা লেকার পরে আমি ভীষণভাবে বিজ্ঞান সম্পর্কে কাগজপত্র বই, পড়তে আরম্ভ করলাম, এবং আরও অন্যান্য, বিজ্ঞানভিত্তিক লেখা, তখন একটা ভীষণ নেশা চাপল। বিদেশী নামকরা লেখকদের লেখা পড়তে আরম্ভ করলাম। এবং তারপরে, কতগুলো সাইন্স ফিকসনের যে কতগুলো মূল প্রধান, বিষয়বস্তু  বা থীম বলুন সেগুলো একটার পর একটা ধরে ধরে, আমি শঙ্কুর মধ্যে সেগুলো, ব্যাবহার করতে লাগলাম। ইন ভিজিবিলিটি বলুন বা লংজিবিটির ব্যাপার বলুন, ব্রেনের ব্যাপার বলুন, বা প্রাণী আসার ব্যাপার বলুন, বা এখানে থেকে বাইরের কোনো গ্রহে যাবার কথা বলুন, কতগুলো স্টেপ রয়েছে একেবারে, মুল থীম, সাইন্স ফিকশন, যে গুলো প্রত্যেক সাইন্স ফিকশন লেখকই একবার না একবার ব্যাবহার করেছে। সেই থীমগুলো নিয়ে নিয়ে, আর কতগুলো জায়গা সম্বন্ধে তো আমাদের ভয়ানক ফ্যাসিনেসন থাকে, নিশ্চই আপনারাও আছে, যেমন ইজিপ্ট, আফ্রিকার কিছু অংশ, মরু অঞ্চল, এই ধরনের কতোগুলো প্রাচীন সভ্যতা, কিন্তু তার মধ্যেও যে কতগুলো অদ্ভুত, আজকের দিনেও আমাদের কাছে খুব অবাক করে, এমনকি, পিরামিড তৈরির ব্যাপারটাই এতো একটা অদ্ভুত জিনিস। এইসবগুলো, প্রাচীন সভ্যতার প্রতি আমার একটা ভিয়ানক টান রয়েছে। সেগুলো আধিনিক, আজকের দিনের একজন

আধুনিক বুদ্ধিতে ব্যখ্যা হয় না এমন অনেক জিনিস আছে, যেমন পিরামিডের কন্সেপ্ট।

আজকালতো ক্রমে ক্রমে কত বেরোচ্ছে, আমি তো সম্প্রতি সন্দেশে একটা লিখেছে, সেই নাজকার লাইন সন্মন্ধে, জানেন কি না জানিনা, তা ঔ দক্ষিন আমেরিকায় নাজকা বলে একটি ছোট্ট জায়গা আছে, পেরুর ওইদিকে, যেখানে বছর চল্লিশের আগে এরোপ্লেন ওর ওপর দিয়ে যেতে যেতে, হঠাত জমিতে একেবারে বিশাল বিস্তৃত, সব জিওমেট্রীক নকশা। পাখি,  মাকড়সা , জানোয়ার, এতো বড় যে আপনি জমিতে বসে সে সব বুঝতেই পারবেন না, শুধু ওপর থেকে একটা এলিভেসন থেকে, অন্তর হাজার বা সাতশ ফুট ওপর থেকে, এ  নিয়ে ন্যাশানাল জিওগ্রাফিতে একজন জার্মান ভদ্রমহিলা, আজ প্রায় দশ বছর ধরে পড়ে থেকে, জানা চেষ্টা করছেন কেন করা হয়েছে, দানিকেন সোজা বলে দিয়েছে, সেটা বাইরের কোনো স্পেসের সুবিধা হবে বলে ইত্যাদি ইত্যাদি, এখন এইগুলো নিয়ে এইগুলো প্রত্যকেটায় কিন্তু আমার গল্পে ক্রমে ক্রমে, শঙ্কু, এবং তার সঙ্গে অন্য চরিত্রও এসেছে, তার বন্ধুবান্ধব, এবং শঙ্কুর, শঙ্কু প্রথমে গিরিডিতেই থাকতো, তারপর শঙ্কুকে , তারপর ফেলু যখন এলো চরিত্র, ফেলুকে আমি ভারবর্ষের মধ্যেই মোটামুটি রেখে, ভারতবর্ষের অনেকগুলো জায়গায় তার, না আরকম এডভেঞ্চারের কাহিনী, বলতে লাগলা, আর শঙ্কুকে সারা পৃথিবী চষে বেড়াতে লাগালাম,  

এই সুত্রে একটু বলে নিই,  শঙ্কু এখন অনেক বেশি সিরিয়াস, তাছাড়াও আমরা একটা জিনিস লক্ষ্য করছি, যে আপনার, গল্পে যেটা আগে ছিল না, এখন প্রবন্ধে বেশি পাচ্ছি, কোন একটা ল্যাবরেটরীর একটু ডিটেল এগুলো কিন্তু বেশি করে করে আসছে, সেই বিজ্ঞান নির্ভর হয়ে, আরো বেশি বিজ্ঞানের বিষয়গুলো আনছেন আরকি,   

সেটার জন্য আমাকে পড়াশুনাও করতে হচ্ছে, আমি প্রথম যখন  শঙ্কু আরম্ভ করি তখন সে আমার পড়াশুনার দৌড়টা অনেকটা কম ছিল, তারপরে আমি কতগুলো পত্রিকা রাখতে আরম্ভ করি, বই টৈ ভাল পেলে আমি তৎক্ষণাৎ কিনি, সেগুলো পরি, এবং তো একটা বই রাখলে চলে না, দু বছর তিন বছরের মধ্যে নতুন নতুন বেরুচ্ছে, এতো দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে, সে কল্পনার বাইরে, কাজেই যথা সম্মভ তার সাথে পা মিলিয়ে মিলিয়ে চলার চেষ্টা করি। এবং তার মধ্যে শঙ্কুতে কাজে লাগানো যায়, সেগুলি, কাজে লাগিয়ে দি, এবং ফেলুদাতেও এর আগে আমি একটা জিনিস যেটা এনেছি,  সেটা এখনও প্যারাসাইন্স পর্যায়ে যেটা রয়েছে, প্যারা সাইকোলজি বলুন, প্যারা নরম্যালের পর্যায়ে যেটা রয়েছে, সেটাতেও আমার কম উৎসাহ নেই, কৌতুহল নেই,

আচ্ছা আপনার নিজের মতামত টা বলুন,

আমার মতামত বলতে, আমার মনটা এব্যাপারে খোলা, আমার বিশ্বাস, যে এধরনের ঘটনা ঘটে, আমি নিজে দেখেছি, আমার পরিবারে ঘটেছে, প্রত্যক্ষ না হলেও আমার এতো কাছের লোকের সাথে ঘটেছে, যে তাকে প্রায় প্রত্যক্ষই বলা যায়। এবং সেটা না মানবার কোনও কারন নেই। এবং আমার একটা ধারণা রয়েছে, এগুলো বছর তিরিশ চল্লশের মধ্যে বিজ্ঞানের আওতায় এসে যাবে। এগুলোয় এখনো সেই কারণটা হয়তো পাওয়া যাচ্ছে না, আস্তে আস্তে সেটা তার ফিজিক্সের মধ্যেই হোক যার মধ্যেই হোক এসে যাবে।

আমরা জানি অনেক বিজ্ঞানী এখন এসকল বিষয়ে কাজও করছেন, গবেসনা করছেন,   

অনেক জায়গায় কাজ হচ্ছে, সোভিয়েট রাসিয়ায় কাজ হচ্ছে। এই যে কেরালিয়ান??? ফোটগ্রাফি,

আচ্ছা একটা কথা এবার বলি, আমরা শুনছিলাম , প্রফেসর শঙ্কুর  ব্যাপারটা নিয়ে, আমার মনে হয়, একটা দিকে যদি আসি আমরা, এই ধরুন সাইন্স ফিকশন বা সান্স ফ্যান্টাসির একটা তাগিদ যেটা, এটা লেখা দরকারটা বেশী করে আছে কি না, বা প্রয়োজনটা কোথায়? এইটা নিয়ে কিছু বলুন,

অপরজন – প্রয়োজন মানে , ধরুন আজকে এক্তা কথা বিজ্ঞানে লেখালেখি, বা বিজ্ঞানের কথা, কমিউনিকেসন, লোককে জানানো, এই সত্যগুলোকে জানানো, সেটা সাইন্স ফিকশনের মধ্য দিয়েও হচ্ছে, সাইন্স ফ্যান্টাসির মধ্যে নিয়ে

অপরজন-  আমি বলছি লোকের কাছে একটা বিজ্ঞানের আগ্রহ জনমানো, এটা কি সম্ভব ? কতখানি সম্ভব?

সম্ভব মানে কি- যদি ধরুন আমার গল্প যদি লোকের ভালো না লাগতো, বা যাদের জন্য লেখা, কিশোর কিশোরীদের যদি ভালো না লাগতো, তাহলে হয়তো আমি ওটা নিয়ে লেখার উৎসাহ পেতাম না।

এরকম কি জানতে পেরেছেন, আপনার এই লেখার প্রেরণায় সে হয়তো বিজ্ঞানচর্চায় নেমেছে, এরকমও তো হতে পারে,

অপরজন – আমি এ প্রসঙ্গে একটু বলে নি, আর্থার সি ক্লাব যখন কলিঙ্গ প্রসঙ্গেতে এসেছিলেন, উনি কিন্তু একবার বলেছিলেন যে, আমরা হিসেব রাখিনি, যে সাইন্স ফিকসন পড়ে কতলোক বৈজ্ঞানিক প্রফেশনকে বেছে নিয়েছে, বিজ্ঞানকে ভালোবেসেছে, এটা আপনি মনে করেন না, এটারও একটা দিক আছে!

দেখুন সাইন্স ফিকশন পড়ে আমি অন্তত সাইন্স ফিকশন লেখায় নেমেছি। আমার একটা ত উপকার হয়েছে, সে প্রেওণাটা তো পেয়েছি, এবং সেটা লিখছি, এবং তার ফলে আরও পাঁচজন যে সেরকম প্রেরণা পাবে না বা সেটা সবস্মই যে লেখা অর্থাৎ সাহিত্য সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে হবে, এমনটা নাও হতে পারে। সে নিজে সে ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নিতে পারে। তার যদি জিনিসটা সম্পর্কে যথেষ্ট আগ্রহ জাগে, তাহএ সে সেটা নিয়ে আরও চর্চা করতে চাইবে না কেন? সে তো শুধু আমার গল্প পড়ে জানবে না, তাই তেমনই যদি কৌতূহল বা আগ্রহ হয়, তাহলে তাকে নিজের থেকে চার করে, তাকে আরও পাঁচচরক জিনিস পড়তে হবে। সেটাকে সে পরে একাডেমিক ডিস্ক্লিনির মধ্যে নিয়ে নিতে পারে। কেননা টেক্সট বই হয়তো কিশোর কিশোরিদের পড়বার আগ্রহ নাও থাকতে পারে, কিন্তু তারা প্রথম জানছে গল্পের মধ্যে দিয়ে। তাই গল্পের প্লট অত্যন্ত বড় জিনিস, এবং তার সঙ্গে সেটা তথ্য ভারাক্তান্ত না হয়ে পড়ে, কখনও মনে হবে না যে, আমি এইসব তথ্যগুলো পরিবেশন করবার জন্য, আমি গপ্পটা লিখছি। প্রধান হচ্ছে গপ্পো। গপ্পের রস। এবং তার মারফৎ সে কতগুলো জিনিস জেনে যাচ্ছে, যেদিকে তার উৎসাহ জাগ্রত হচ্ছে। তারপরে সে সেটা কাজে লাগাতে পারে,

আচ্ছা এছাড়া আপনি মনে করেন না, যে ধরুন আজকে, যে ভবিষ্যতকে আমি জানি না চিনি না, মানে সাইন্স ফিকশনের বেসিরভাগ লেখকই, ফিউচারোলজির ব্যাপারটা নিয়ে চর্চা করেন। ভবিষ্যতে কি হতে পারে না প্রে, বা ধরুন আজকে, রকেট যখন ছিলো না , রকেটের কথা পড়েছি। সে একটা মন তৈরি হয়েছে, বা এটম বোমা ছিল না, এতম বোমার কথা পড়েছি, সেইভাবে মন তৈরি হয়েছে, আজকেও দু হাজার সালে, বা দুহাজার বিশ সালে কি হতে পারে, পৃথিবীতে , তা নিয়ে যখন বিজ্ঞান গল্পকাররা বলছেন, এটা আমাদ্র ধারনা তৈরি করছে, এটা আমদের সাহায্য করবে না, অনাগত ভিবিষ্যতের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে!

আমরা তো আর সে ভবিষ্যতের সময় থাকবো না, হা হা, এই জেনারেশনটা তখন তো, জেনারেশন তো বদলে বদলে বদলে যাচ্ছে, নিশ্চই, আখেরে…

না আপনার যারা পাঠক, তারা তো, মূলত কিশোর কিশোরী।

হ্যাঁ

তাদের কল্পনার মধ্যে যেটা রয়ে গেল , পরে হয়তো সেইটে, একটা বাস্তবরূপ নিতেও পারে।

নিতেও পারে, কিছু আশ্চর্যের নয়, তবে আমরা, নিজেদের অতো বড় বলে মনে করি না, যারা সত্যিকারের বড় বড় লেখক আছে, আসিমভ বা ক্লার্ক তাদের যে বিজ্ঞানের ভিত্তিটা রয়েছে, সেটাতো আমাদের নেই, কাজেই, আমাদের অনেকটা নির্ভর করতে হয় কল্পনার ওপর। প্লট বা গল্পের মজাটার ওপর। তার সঙ্গে সঙ্গে যতটুকু পারি, খুব একটা অ্যাবসার্ড কিছু একটা না হয়, বা সেটা অবিশ্বাস্য বা অবাস্তব না হয়, তার জন্য আমাদের খানিকটা পড়াশুনা করে নিতে হয়।

আচ্ছা আবার আমরা একটু বিজ্ঞান ভিত্তিক ছবির প্রসঙ্গে আসি। মানে বিজ্ঞানভিত্তিক কাহিনীর ওপরেই তো আমাদের ছবিগুলি দাঁড়িয়ে আছে, এখন তো বিদেশি অনেক ছবিই আসছে, যার অধিকাংশই বিজ্ঞান ভিত্তিক দেখা যায়।

অপরজন – এবং সত্যজিতবাবু নিজেও একসময় বলেছিলে, উনি বলেছিলেন যে, ওনারও একটা পরিকল্পনা আছে, এধরণের সাইন্স ফিকশন ফিল্ম করার, সেটা হয়তো সেই স্পেস ওডিসি ধরনের অত বড়, অত চমকদার না হলেও, ওনার মনেও একটা পরিকল্পনা আছে, এ ব্যাপারটা নিয়ে আপনি এখন কি ভাবছেন?

হ্যাঁ ওটা পরিকল্পনা আজকের না, ওটার চিত্রনাট্য লেখা হয় ১৯৬৭ তে। পনেরো বছর আগে। ওটা ইনফ্যাক্ট আমি একবার লণ্ডন গিয়েছিলাম তখন, স্ট্যনলি কিউব্রিক স্পেস ওডিসি তুলছেন, আর্থার ক্লার্কের সঙ্গে আমার আলাপ হয়, তার আগেই, বঙ্কু বাবুর বন্ধুর ওপর ভিত্তি করেই, একটা ওই গপ্পো না কিন্তু ওই বাইরের থেকে স্পেসিস আসার ব্যাপারটা রয়েছে, আমার আইডিয়া , আমার পরিকল্পনা মাথায় ছিল, তা আমি আর্থার ক্লার্ককে বলাতে বলল, বাহ এতো বেশ লাগছে, তুমি গিয়ে লেখ, তারপর কলকাতায় ফিরে এসে আমি পুরো চিত্রনাট্য লিখেছিলাম, সেটা অনেকদূর এগিয়েছিল। কলাম্বিয়া কোম্পানি, আমি হলিউডে কাটিয়েছিলাম, ছ’সপ্তাহ, তবে আমার হয়ে যিনি মধ্যস্থতা করছিলেন, তার কতগুলো গোলমালের ফলে শেষ পর্যন্ত ছবিটা হয়নি। কিন্তু তার অপু আইডিয়া, কোলাম্বিয়া কোম্পানি করবে বলে আমার চিত্রনাট্যের অপু সাইক্লোস্টাইল, মিমিওগ্রাফ কপি অন্তত শ’খানেক সেই ওদের আপিসে ছিল। তার মধ্যে থেকে, চার আনা, পাঁচ আনা, দশ আনা করে আইডিয়া দুটি ছবিতে লেগে গেছে, একটা হচ্ছে ক্লোস এনকাউন্টারস অফ থার্ড কাইন্ড, আর একটি সেই স্পিল বার্গেরই নতুন একটি ছবি হয়েছে এক্সট্রা টেরিস্টিয়াল বলে ইটি নাম দিয়ে ছবি হয়েছে। এখন আমার এমন অবস্থা হয়েছে, যে আমার এলিয়েন আর অরা সম্ভব না, করলে বলবে, যে আমি ওর থেকে নিয়েছি। কিন্তু ব্যাপারটা আসলে উল্টো।

এটা আমাদের একদমই জানা ছিল না। ছবিটি কি আপনি ইংরিজিতে করবেন ভেবেছিলেন?

না ওটা বাইলিঙ্গুয়াল ছবি ছিল, আমার একেবারে বাংলাদেশের গল্প, একটি গ্রামে একটি পদ্ম পুকুরে এসে, একটা স্পেস শিপ ঝপাং করে পড়ে, এবং তার মধ্যে একটিমাত্র এলিয়েন চরিত্র রয়েছে, তা বোধহয় মেশিনটা বিকল হয়েছে, এবং চরিত্রটিও যেন একটু বিকল, কিন্তু পরদিন একটা পোর্ট হোলের মধ্য দিয়ে ভোরের সুর্যটা ওঠে, এটা মাঝ রাতের ঘটনা, এবং যেই পড়লো, অমনি দেখা যায় চোখের সামনে, সমস্ত পদ্মগুলো ফুটে উঠলো। ইটস আ বেনেভলেন্ট ফোর্স। এইটে বোঝা যাচ্ছে, তারপরে সেই পোর্ট হোলের মধ্য দিয়ে সূর্যের আলো এসে, এই এলিয়েন ক্রিয়েচারটির, এই প্রাণীটির গায়ে পড়াতে সে আবার সজীব উঠল। সুর্যের আলোতে তার প্রাণ পেল, এবং তারপর রাত্রিবেলা মাঝে মাঝে বেড়িয়ে আসে, এবং তাকে ঘিরে নানারকম প্রতিক্রিয়া, গ্রামের চাষাভুশও আছে, একটি জার্নালিস্ট ছেলে আছে, সে গ্রাম সম্মন্ধে একটা সমীক্ষা করতে এসছে, তার স্ত্রী আছে, নতুন বিয়ে হয়েছে, সেও মেয়েটি আবার গ্রামের মেয়েদের ফ্যামিলি প্ল্যানিং ট্যানিং ইত্যাদি নিয়ে রিসার্চ করে, দুজনেই রিসার্চ করে, একদিন মারোয়ারি আছে, তিনি একদিন, ড্রাউট এরিয়া ওটা, সে একজন আমেরিকানকে দিয়ে, আধুনিক একটা ড্রিলিং মেসিন বসিয়েছে। জলের জন্য।

এখন মজা হচ্ছে কি সেই পুকুরের ওপর দিয়ে সেই স্পেসশিপটির একটি ছুয়ো বেড়িয়ে রয়েছে, সোনালি রঙ তার, সে মারয়ারিটি মনে করে এটি একটি মন্দির, ব্লাস্টিং হয়েছেন তার জন্য ভেতর থেকে বেরোচ্ছে অর্থাৎ জলের থেকে বের করে নিয়ে আবার মন্দিরটিকে প্রতিষ্ঠা করবে, এই ধরনের সব ব্যাপার, একমাত্র আমাদের বাঙালি জার্নালিস্টটির সন্দেহ হয়, কারন  কতগুলো ঘটনা ঘটছে, এই যে প্রাণীটি বেরিয়ে আসে, সে একটি অতি ক্ষুদ্র, দেখলে মনে হবে দুর্ভিক্ষে না খেতে পাওয়া বাচ্চাছেলে। তার চখে নেই সকেটস আছে, এবং তার মধ্যে নানা রকম দৃষ্টি আছে, এক্সরে ভিশন আছে, মাইক্রোস্কোপিক ভিশন আছে, টেলি স্কোপিক ভিশন আছে, তার এক একটা রঙ, রশ্মির রঙ আলাদা, এমনকি সে মরা মানুষকে বাঁচিয়ে দিতে পারে। ইতিমধ্যে গ্রামের যে অধিবাসি সে মারা যাচ্ছে তার শ্মশানের একটি দৃশ্য। এরকম অনেক ব্যাপার আছে, যা খুব মজার।

আলটিমেটলি সে অ্যামেরিকানটিকে গিয়ে বাঙ্গালি জার্নালিস্ট বলে যে আমার মনে হচ্ছে এখানে স্পেস শিপ একটা রয়েছে। ও মাথা নাড়ে, এ পোড়া দেশে স্পেস শিপ আস্তে যাবে কেন? আমাদের এতো বড় বড় সব এ রয়েছে, এখানে সে কি করছে? তার কি দরকারটা কি? তারপর শেষে যখন নিজেরও সন্দেহ হয়, সে বন্দুকটন্দুক নিয়ে একটা ব্যাপার করতে যায়, কিন্তু তার আগেই আমাদের এলিয়ন ক্রিয়েচারটি , সে এসছিল কিছু, স্পেসিমেন সংগ্রহ করতে। দুটো ব্যাং একটা সাপ কিছু কিছু গাছ কিছু ফুল, এবং একটি খুব গরীব ছেলে, হাবা বলে সে ভিক্ষে করে বেড়াচ্ছে। তাকেও নিয়ে যাচ্ছে, কেননা, সে ধরে ফেলেছে যে এখানে কোনো ভবিষ্যৎ নেই। ও যখন সেই বন্দুক চালাতে যাচ্ছে, ওদিকে ওর যন্ত্র কিছু তৈরি হয়ে যাচ্ছে, তখন সে যন্ত্র উঠে চলে গেল। গ্রামের লোকেরা ভাবলে বাহ, আমেরিকান সাহেবদের জন্য আমাদের কী অদ্ভুত একটা কাজ হয়ে গেল, ওদিকে সে নিজে বুঝতে পারছে, আমি কিছু করিনি,

এইটা করুন না আপনি।

এটা এখন সম্ভব, আগে অদ্ভুত কঠিন ছিল সে ব্যাপার, এখন জলের মতো সহজ হয়ে গেছে,

করুন না

দেখি আমার ওখানে কতগুলো পরিবর্তন করতে হবে, কারণ কতগুলো আইডিয়া ও মেরে দিয়েছে।

তা হোক, আমার মনে হয় আপনি যে কাহিনিটা বললে, অপূর্ব হবে।  

এবং তারপরে আমি ঐতে দেখিয়েছি ওর চোখের মধ্যে দিয়ে, একটা অবজেক্ট, একটা পাতা, কি বা একটা পোকা, পোকার দিকে দেখতে দেখতে সেই মাইক্রোস্কোপিক দৃষ্টি দিয়ে তার ইন্টারনাল সিস্টেম, ধমনী, রক্ত, সমস্ত দেখা যাচ্ছে।

ফিল্মের দিক থেকেও কিন্তু অনেক স্কোপ রয়েছে।

অনেক স্কোপ রয়েছে। এখানের মজাটা হচ্ছে, এখানে আমার বিজ্ঞানটা, পার্থিব বিজ্ঞানটা যেটুকু দেখানো হবে, সেটা থিকই থাকবে, কিন্তু ছেলেটার স্পেস শিপের ভেতরটা তার মধ্যে কোনো যন্ত্রপাতি বা বোতাম টোতাম নেই, সমস্তটাই ভেইন্স আর আর্টারিস এর মতো চেহারা, সেটাও যেন একটা লিভিং বিয়িং। সব সময়ই সেটার মধ্যে একটা প্রাণ রয়েছে, দপ দপ। এবং এটা বহুদিনের আগে ভাবা। এবং এখনও করলে, এখনও করলে, করবে, আমেরিকা থেকে এখনও চিঠি আসছে। কিন্তু আমার একটা তক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল, আড় আজকাল তো আকছার বহু সাইন্স ফিকশন হচ্ছে। এবং সত্যি কথা বলতে কি টেকনিক্যালি, অসাধারন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে ওরা। 

আচ্ছা আপনি ওদের স্টুডিওর ফেসিলিটি পেতে পারেন নিশ্চই।

এ ছবি করতে হলে এমনিও আমার কো প্রোডাকশন ছাড়া সম্ভব না। আমাকে বাইরের টাকা নিতেই হবে। এটা অনেক খরচের ব্যাপার। ঐ যে প্রাণীটি তার চলাফেরা ভারী অদ্ভুত, সে এমনকি, একটা গাছের পাতার ওপরও দাঁড়াতে পারে। এত ওজন কম। প্রায় একেবারে, ওয়েটলেস বলা যেতে পারে, সেরকম আর্ধেক, উড়ে, আর্ধেক লাফিয়ে চলে, একদিন সে আমেরিকনাটা কোত্থেকে একটা ঐ সাঁওতালদের ওখাণে গীয়ে হাড়িয়া খেয়েছে, সে মদ্য অবস্থায় ফিরছে, একটা বাঁশ বলের মধ্যে দিয়ে, তার পেছন পেছন আসছে, সেই ক্রিয়েচারটি। তা ও হথাত পেছন ফিরে দেখে কে রে বাবা, ও ভেবেছে বুঝি দুর্ভিক্ষের কেউ, সে পকেট থেকে আধুলি বার করে ছুড়ে দেয় ওর দিকে। এবং সেইদিন  এলিয়েন যখন চলে যাচ্ছে, তখন দেখছে কপালে তার আধুলিটা লাগানো রয়েছে।

যাক সত্যজিতবাবু আজকে অনেকক্ষণ সময় দিয়েছেন আমাদের।

আপনাকে ধন্যবাদ, আমাদের মনে হয় আলোচনা আমাদের সকলের ভালো লাগবে।  

- Advertisement -
সাম্প্রতিক পোস্ট
এধরনের আরও পোস্ট
- Advertisement -