দুলাল চক্রবর্ত্তী
সম্প্রতি তপন থিয়েটারে, চারটি নাট্যদলের (কলকাতা স্রাইন, টাকি কালচারাল ইউনিট, বেহালা অনুদর্শী এবং তিলজলা ঋতু) সমবেত নাট্যায়ন উদ্যোগে “এক টিকিটে চারটি নাটক”শীর্ষক আয়োজনে প্রথম দর্শনে অভিনীত হয়েছিল, নাকতলা অঞ্চলের সাউথ কলকাতা স্রাইনের প্রযোজনা অবিনশ্বর।
নাটকের রচনা, মঞ্চ ভাবনা এবং নাটকীয় আবহ চিন্তনে যুক্ত ছিলেন অভিজ্ঞ নাট্যজন আগরপাড়া কালপুরুষ সংস্থার রাজা গুহ স্বয়ং। এই নাটকের নির্দেশনা আরেক বর্ষীয়ান নাট্যজন অমিত ভট্টাচার্য। এই সময়ের রবীন্দ্রনাথ অবমাননাকর ঘটনার আলেখ্যদর্শন করে রাজা গুহ রবীন্দ্র অনুভূতির মনস্তাত্ত্বিক আর্তনাদে এই নাটকের শরীর গড়েছেন। পশ্চিম বাংলা এবং বাংলাদেশের কাঁটা তারের মাঝখানের নো ম্যানস লান্ডে কুঁড়ে ঘরে যেন বাস করছে শিশু পাগল আর নন্দিনী। বিশু বুকে আঁকড়ে আছে একটি পোটলা। তার মুখে শুধুই রবীন্দ্র গান। গান শুনে ছুটে আসে তারাপদ। তারপর পোটলাটা কেড়ে নিতে আসে রঘুপতি আর গোঁসাইয়ের দল। এরা কোথা থেকে আসে। তার বাস্তবতা নাটকে নেই। আসলে এটি আইডিয়ার নাটক। একটি প্রতিকী এবং রবীন্দ্র দর্শনের নিরিখে কাল্পনিক নাটক। সাম্প্রতিক সময়ে মৌলবাদীরা রবীন্দ্রনাথের মুর্তি ভেঙে ফেলেছে। এই ঘটনার বুক চাপা ডুকরে কেঁদে ওটার নাটক। পুটুলিতে সেই ভাঙা মুর্তির অংশ বিশেষ বয়ে বেড়াচ্ছে পাগল ভাই। নন্দিনী যেন পাহারায় আছে। অনুরাগী তারাপদ সেই স্বাদ চেটে পুটে খাচ্ছে। মাটি বা ধরিত্রীর দু’হাতে অন্ধকার নেই। আছে সবুজ। আছে প্রাণের আদিম সাড়া।
আসলে রবীন্দ্রনাথ বাঙালির মননে যেভাবে লালিত পালিত। বাংলার আকাশে বাতাসে রবীন্দ্রনাথের মুক্ত চিন্তা মানবতার জয় গান গেয়ে মানুষকে মানুষের সাথে মিলিয়ে রেখে যে বিশ্বাসের বিশ্ব রচনা করে রেখেছেন। তারই নিশ্চিত আবেদন প্রকাশ করাই এই নাটকের রচনা উৎস। কোন কাঁটা তারের বেড়া দিয়ে রবীন্দ্র অন্তর ক্ষত বিক্ষত কিরা যায় না। কোন ধর্মীয় ক্ষুদ্রতা দিয়ে যে রবীন্দ্রনাথের বিশালতা পরিমাপ করা যায় না। সৃষ্টির কিছুই আজো রবীন্দ্রনাথ বিকল্পের যোগ্যতায় নেই। নাটকের আভ্যন্তরীন আনন্দিত স্বর সেই সংবাদেই রবীন্দ্রনাথকে নো ম্যান্স ল্যান্ডে কাল্পনিক প্রতিপালন চেষ্টায় টেনে এনেছে। একটা নির্মলেন্দু প্রশান্তি তাই এ নাটকে আছে। তবে বেশ ভাল চালনার মধ্যেই একটু বেশি ছোটাছুটি হচ্ছে কি-না ভাবয়া দরকার। কান্না নেই কেন? ভয় আছে, ত্রাস আছে, এখানে বিশ্বাস এতো ভীতিকর হলে ত্রান কীভাবে আসবে? ইত্যাদি অনেক টুকরো ভাবনা নাট্য টেক্সট বর্জিত ভাবেই মিনে আসে, অনেক বিশদতা কামনায়।
এই নাটক বর্তমান সময়ের মানুষের মন মেজাজের সাথে তাল মিলিয়ে চলেছে, তবুও অবিন্ন্যাস্ত ফিলজফিতে অন্তর বিকশিত চাপা কান্নায়, কখনো স্থির কখনো উত্তাল হ’য়ে আমাদের বিস্মিত করুক। যেখানে আরো একান্তের কিছু শৃঙ্খলা উঠে আসার অবকাশ রয়েছে। প্রযুক্ত আলো, আবহ, মঞ্চ, গান, কথা এবং ভঙ্গিমায় কোথাও খামতি নেই। নিরবতা নিরবচ্ছিন্ন চলায় এসে, তার আস্বাদে ভেতরে গিয়ে সবাইকে মোহিত করুক। এটাই কামনা। বিভিন্ন চরত্রে অভিনয় করেছেন, বিশু পাগল – অমিত ভট্টাচার্য, তারাপদ – শিবব্রত ঘোষ দস্তিদার, নন্দীন – তপতি মালি দাস, রঘুপতি – সৃজিত বাসু, গোসাই – বাসুদেব দাশগুপ্ত এবং ধরিত্রী – চুমকি সরকার। সকলেই নিজের বেস্ট টুকু দিতে তৎপর ছিলেন। তবুও ভাল লাগে তারপদ চরিত্রের জিজ্ঞাসা আকুলতায় শিবব্রত ঘোষ দস্তিদারের অভিনয়। অমিত ভট্টাচার্য, সৃজিত বসু, তপতী মালি ঢালি ও চুমকি সরকার এঁরাও নাটকের নানা টানাপোড়েনে উজ্জ্বল উপস্থিতি।