Friday, June 13, 2025
Friday, June 13, 2025
Homeআলোচনাসাদার্ন এভিনিউ চরৈবেতি প্রযোজিত সেল-ও-টেপ  

সাদার্ন এভিনিউ চরৈবেতি প্রযোজিত সেল-ও-টেপ  

রজত মিত্র

বর্তমান সময়টাই এমন… ভোগবাদের (Consumerism) ধ্বজা আজ শুধুই আমাদের রাজ্যে, আমাদের দেশেই নয়, সারা পৃথিবীতেই বিজয়-গর্বে আন্দোলিত হচ্ছে। সবকিছুই, সবাই (!) আজ বিক্রয়যোগ্য। সামাজিক আর রাজনৈতিক মূল্যবোধ (Socio-political Values) কেবলই আভিধানিক শব্দে পর্যবসিত হয়েছে। এই সামগ্রিক অবক্ষয়ের (Decadence) মধ্যে সুবিচারের (Justice) আশা দূর অস্ত। কামদুনি থেকে আর.জি.কর, ঊন্নাও থেকে হাথরস… ‘প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে’– এটাই নির্ভেজাল সত্য। বিশেষত অর্ধেক পৃথিবী যাদের, সেই নারীদের উপর নির্যাতন, শোষণ, বঞ্চনা আর বৈষম্য – অত্যন্ত প্রকট হয়ে উঠেছে। এই অন্যায়-অবিচারের বাস্তবতাই প্রতিফলিত হয়েছে সেল-ও-টেপ (Sale-O-Tape) অনুনাটকে। গল্প বলার শৈলী (Style) মনোজ্ঞ এবং অন্তরঙ্গ থিয়েটারের (Intimate Theatre) ফর্ম-এ নাটকটির উপস্থাপনা অত্যন্ত মুনশিয়ানার সঙ্গে করেছেন নাট্যকার ও নির্দেশক শান্তপ্রিয় মুখোপাধ্যায় ।

সাদার্ন এভিনিউ চরৈবেতি প্রযোজিত এই নাটকের প্রথম উপস্থাপনা হয়ে গেল শনিবার, ৩১ মে ২০২৫ সন্ধ্যায় তপন থিয়েটারের তাপস-জ্ঞানেশ মঞ্চে, বেহালা ক্রিয়েটিভ নাট্য চর্চা কেন্দ্র আয়োজিত নাট্য সমারোহে। নাটকটিতে উপস্থিত চরিত্র মাত্র দুটি… মা এবং মেয়ে। প্রথমাংশে স্বগতোক্তির (Soliloquy) ঢংয়ে মা তাঁর নিজের জীবনের যন্ত্রণাদয়ক অতীত, যা ঘৃণ্য যৌন শোষণ, ষড়যন্ত্র আর বঞ্চনাদগ্ধ, তার সঙ্গে দর্শকদের পরিচয় করিয়ে দেন। দ্বিতীয়াংশে মা এবং মেয়ের কথোপকথন-এ (Dialogue) একদিকে যেমন উঠে এসেছে সন্তানের পিতৃপরিচয় দিতে অসমর্থ মায়ের যন্ত্রণাদীর্ণ আক্ষেপ, অসহায়ত্ব, তীব্র ঘৃণা আর অবদমিত ক্রোধ, তেমনই অন্যদিকে উঠে এসেছে মা-মেয়ের একে-অপরকে আগলে রাখার আকুল প্রচেষ্টা আর আপোষহীন প্রতিবাদের রাস্তায় নিরন্তর এগিয়ে চলার আন্তরিক আকাঙ্ক্ষা। যদিও এই লড়াইটা কেবলই কোনও অপরাধী বিশেষের বিরুদ্ধে নয়, বিরোধিতা… স্বার্থান্বেশী ও মতাদর্শহীন রাজনৈতিক শক্তির, ভ্রষ্ট প্রশাসনিক ব্যবস্থার, বিবেক-অন্ধ বিচার ব্যবস্থার, আর বিক্রি হয়ে যাওয়া সংবাদমাধ্যমের। বিরোধিতা… মানুষের ভোগবাদী মানসিকতার, ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের ।  মা এবং মেয়ের তথা বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন সমস্ত সাধারণ মানুষের এই লড়াই অতি অসম। তবুও নাটকের পরিসমাপ্তি (Climax) ঘটে হাজারো প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে ফিনিক্স পাখির মতো নবজন্মের অঙ্গীকার নিয়ে, সুবিচারের (Justice) ন্যায্য দাবি আর আশার আলোকবর্তিকা জ্বালিয়ে ।

আজকের এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে এমন একটা নাটকের খুবই প্রয়োজন ছিল। খুবই সুচিন্তিত এবং সুনির্মিত প্রযোজনা। তবে আরও ভালো করার অবকাশ, অন্য সকল প্রযোজনার মতোই, এই ক্ষেত্রেও আছে; কারণ শিল্পের অন্যতম ধর্মই উন্নত থেকে উন্নততর হওয়ার নিরন্তর প্রচেষ্টা। বেশ কয়েকবার সেলোটেপ-এর (Cello tape) উল্লেখের পরিবর্তে, নাটকের শীর্ষক (সেল-ও-টেপ / Sale-O-Tape) আরও অর্থবহ হতে পারতো যদি সংলাপে আর একটু গুরুত্ব পেতো। অন্তরঙ্গ পরিসরে, দর্শকদের থেকে স্বল্প দূরত্বে দাঁড়িয়ে অতি নাটকীয়তা যথাসম্ভব বর্জনও বাঞ্ছনীয়, যা মঞ্চাভিনয়ের (Proscenium Theatre) থেকে চরিত্রগতভাবে ভিন্ন মাত্রার। আর শেষ পর্যায়ে ‘আগুন পাখি’গানের ব্যবহারে শব্দ-প্রাবল্য বেশ খানিকটা কম করে, নাটকের ভাবাবেগ (Emotion) এবং দর্শকদের মেজাজের (Mood) সঙ্গে সাযুজ্য রাখতে পারাটাও, প্রযুক্তিগত অসুবিধা সত্ত্বেও, প্রয়োজনীয় বলে মনে হয়। নাট্য সমারোহের আয়োজকদের, ব্যবস্থাপনায় সতর্ক হওয়া একান্ত বাঞ্ছনীয় । অনিয়ন্ত্রিত দর্শক সমাগম, অপর্যাপ্ত আসন, অপ্রতুল শীতাতপনিয়ন্ত্রণ… কোনটাই উচ্চ গুণমানের উপস্থাপনার সহায়ক ছিল না; এমনকী শিল্পী এবং দর্শকদের জন্যও ছিল অত্যন্ত কষ্টকর ।  

পরিশেষে বলা যায়, সাদার্ন এভিনিউ চরৈবেতি প্রযোজিত এবং নাট্যকার ও নির্দেশক শান্তপ্রিয় মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘সেল-ও-টেপ’, অন্তরঙ্গ থিয়েটারের (Intimate Theatre) শর্ত মেনে, প্রথম উপস্থাপনাতেই নাট্য-পরিসর ব্যবহার (Use of space), নাট্য-সংলাপ এবং অভিনয়ে, দর্শকদের আবেগের (Emotion) সঙ্গে সেতুবন্ধনে (Communication) সফল হয়েছে। মায়ের ভূমিকায় অমিতা মৈত্র এবং মেয়ের ভূমিকায় মৌসুমী সরকার যথেষ্টই সাবলীল এবং প্রশংসাযোগ্য অভিনয় করেছেন। প্রযোজনাটি নিশ্চই দর্শক মনে জায়গা করে নেবে।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -

Most Popular