দেবা রায়
পর্ব- ২
সরকারী সাহায্যের হাত
সরকার নাট্যকর্মীর সুবিধার জন্য নানা প্রকল্পের জাল বুনেছেন, সবই ভোট কেন্দ্রিক জনমুখী নীতি। সরকার নাট্যকর্মীদের অপরিসীম শ্রমের মূল্য হিসেবে তাঁদের সম্মান জানাতে তাঁদেরই হাতে তুলে দেন নানান প্রকল্প। আর আমাদেরই একটি কতিপয় অংশের কাছে পৌঁছে যায় সেই প্রকল্পের অর্থ সাহায্য। যেটা আমজনতার অনেকেই জানেন না। সরকার ডাক্তার বানাতে অর্থ খরচ করে। আবার এখন করতেও হয় না। সেই ভাবী ডাক্তারের মা-বাপ তা জানেন। কিন্তু নাট্যকর্ম করলে সরকার টাকা দেয় কজন অভিভাবক জানেন? জানলে হয়তো নাটকে আসার ধান্দাটাকে আরোও উৎসাহ দিতেন। কেন্দ্রীয় সরকার এই প্রকল্পের অর্থ নানাভাবে দলগুলি ও অভিনেতাদের সাহায্য করে। তার এক নম্বরে প্রোডাকশন গ্রান্ট, দুই স্যালারি গ্রান্ট, তিন ফেস্টিভাল গ্রান্ট, চার বিল্ডিং গ্রান্ট ইত্যাদি। এখন দলগুলির অর্থনৈতিক অবস্থা এতোটাই খারাপ, যে টাকা ছাড়া এতো দল সব নাট্যকর্মীর পক্ষে চালানো সম্ভব নয়। নাট্যক্ষেত্রে বড় দল, মাঝারি দল আর ছোট দল এইভাবে বিভাজনের এক হাবভাব আছে। আর এই নিয়ে পূর্বে আংশিক আলোচনা ছুঁয়ে গিয়েছিলাম। প্রযোজনার জনপ্রিয়তার নিরিখে একটি দলের নাম শীর্ষে যায়।
আর সেই শীর্ষ স্থান থেকে সেই দলের পরিচালক হয়ে ওঠেন বটগাছ। দলের সমস্ত কিছুর প্রতি অধিকার বা দায় তাঁর ওপরই ন্যস্ত থাকে, তাঁর সিদ্ধান্তের ওপরই শো হয়, উৎসব হয়, নাটক নির্বাচন হয় সবই প্রায়। এর একটি বড় কারণ দলের অন্য কর্মীদের না এগিয়ে আসা, আবার এর ব্যতিক্রমও আছে। যেখানে দলের সিদ্ধান্তর ওপরই সব নির্ভর করে। এখন আসা যাক, এই কর্মকাণ্ড চলবে কি করে? এই এত এতো তাকা সবে কোথা থেকে? একটা প্রোডাকশন মঞ্চস্থ করতে মিনিমাম খরচ ৫০ হাজার। খুব সাধারণভাবে করলেও। এবার একটা শো যদি মঞ্চে করতে হয় তার খরচ মিনিমান শো প্রতি ১০-১২ হাজার। এইভাবে কটা শো করা সম্ভব? কটা মানুষের কাছে এই কাজে কথা জানানো আছে, এখন ফেসবুক, ইউটিউব হয়ে কিছু প্রচার হয়, কিন্তু প্রযোজনার মান এতো দুর্বল যে সেক্ষেত্রে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নেন। আবার যদি নাটক ভালো হয়, দর্শক মনে দাগ কাটে তাহলে অবশ্যই হাউজফুল হতে পারে।
এবার আসে একদিকে দলে টাকা দরকার, আর অপরদিকে সরকারে টাকা নিয়ে ডাকার ব্যবস্থা। সুবিধা যখন দরজায় করা নাড়ে, তখন অভাব থাকলে মানুষ ভাবনা চিন্তার দুয়ারে তালা লাগায়। এবং সেই সাহায্য নেবার জন্য তৎপর হয়ে ওঠেন এবং সাহায্য নেন। এই সাহায্য নেবার পেছনে কোনো অন্যায় নেই, নেই কোনও অপরাধ। সরকার ব্যবস্থা করে জনতার কল্যানার্থে। এতে অসুবিধা থাকতে পারে না। কিন্তু সরকার এই টাকা দেবার সাথে সাথে দল্গুলির ওপর বেশ কিছু নিয়ম লাগু করে। খুব স্বাভাবিক সেইসব সব নিয়ম লাগু করা। সে যখন টাকা দেবে, সে হিসেবও চাইবে। অর্থা ইউটিলাইজেশন এক্সপ্লানেসন। টাকা নিয়ে কোন খানে কিভাবে খরচ হয়েছে? কারণ এই টাকা সরকারী তহবিলে জনতার টাকা। সরকার বর্তমানে সব সুবিধা করে দিয়েছে, টাকা কারা নিচ্ছেন, কত টাকা নিচ্ছেন সেটা সরকারে সংস্কৃতি মন্ত্রকের ওয়েবসাইটে গেলেই ডিটেলে দেখা যায়। তাই যারা মনে করছেন তাদের সাথে অনিয়ম হচ্ছে, তারা এই ডিপার্টমেন্টে অভিযোগ দায়ের করতে পারেন। এই অনিয়মের বিষয়টিতে আমি পড়ে আসছি। তার আগে সরকার কি দেয়, কত দেয়, আমরাই বা কি নিই, কত নই, এই নিয়ে কথা বলা যাক।
সরকারী অনুদানের পরিমাণ
সম্প্রতি সরকার স্যালারি গ্রান্ট হিসেবে মাথা পিছু প্রত্যেক কর্মীর জন্য বর্তমানে ১০ হাজার আর গুরুর জন্য মাথাপিছু ১৫ হাজার টাকা ধার্য করেছে। অর্থাৎ মাথাপিছু একটি কর্মীর জন্য সরকার ১লক্ষ্য ২০ হাজার টাকা মঞ্জুর করেছেন। আর গুরু বা পরিচালকের জন্য ১ লক্ষ্য ৮০ হাজার। ১০০ দিনের কাজের একজন অদক্ষ-অর্ধদক্ষ-দক্ষ শ্রমিকের মজুরি যথাক্রমে ২২৩-৩৩৪-৪৪৬ টাকা। সেই টাকায় একজন শ্রমিক বেঁচে থাকে। সেই অর্থে একজন নাট্যকর্মীকে প্রদেয় বেতনের মূল্য খুব কম নয়। ১০ হাজার টাকায় একজন নাট্যকর্মী খুব ভালভাবেই বেঁচে থেকে নাটকটা করতে পারেন। কিন্তু এখানে গণতন্ত্রপ্রিয় দল নিয়ামকরা কলকাঠি নাড়েন। সেই প্রদেয় অর্থ থেকে যেমন খুশী কেটে তাঁদের ইচ্ছামতো দিতেন এতোদিন, এখন শুনেছি সেই ব্যক্তির নামেই টাকা আসে।
যদিও কোনো এক অজানা ও অদৃশ্য জাদুবলে কর্মীদের স্যালারি মাসে ঢোকে আবার কখন বেড়িয়েও যায় শুনেছি। যা পাওয়া যায়, এই ভাবনায় কর্মীরা কাজ করেন, দলের উর্দ্ধে কেউ নন, দলকে টিকিয়ে রাখার জন্য সকল কর্মীকে এই স্যক্রিফাইস করতেই হয়। এখন প্রশ্ন এখানে কি একবারের জন্যও এই কাজটিকে অন্যায়বলে বিবেচিত হয় না, কর্মীদের যারা এরকমটা করেন। দল চালাবার না যে কারণ তারা দর্শান সেটা কি কোথায় গিয়ে সেই নবাগত কর্মীকে বঞ্চিত করা হচ্ছে না? দলের যারা সংগঠক তারা যদি দল চালাতে সমর্থই না হবেন, তাহলে দল রেখেন কেন? একজনের বেঁচে থাকা অর্থের ওপর দিয়ে দল চালানো কতটা যুক্তিগ্রাহ্য। তারপর যাদের নামে স্যালারি এলোট করা হয়, তাদের সকলেই কি বেরোজগেরে? এসব প্রশ্ন ঊথে আসা কি অন্যায়? এইসব প্রশ্ন যদি কেউ তোলেন, তখন সাথে সেই বক্তাকে নানান যুক্তি দিয়ে আক্রমণ করেন সুবিধাভোগী এই সব দলের মুখপাত্ররা।
একবার ভেবে নিন, একজন কর্মীর খাতে যদি ১ লক্ষ্য ২০ হাজার হয় তাহলে যে দল ৫টা-১০টা-১৫- ২০টা-২৫টা কর্মীর জন্য টাকা পান, তাদের বছরে টাকার পরিমান যথাক্রমে ৬লক্ষ্য-১২লক্ষ্য- ১৮ লক্ষ্য- ২৪ লক্ষ্য- ৩০ লক্ষ্য টাকা। কোন দল কটা করে স্যালারি গ্রান্ট পান তা ওয়েবসাইটে ডিটেলে সব দেয়া আছে। তাই চুপিচুপি খেলাধুলা করার আর দরকার নেই। কেউ প্রশ্ন করে না বলে, একাংশ এই কাজটাকে দল চালাবার মহানত্বকে তুলে ধরে নিজেকে জাস্টিফাই করেন, যেমন তোলাবাজরাও আজ নিজেদের জাস্টিফাই করেন।
আয়নায় দাঁড়াবেন নিজের চেহারাটা দেখলে আঁতকে উঠবেন। থিয়েটারকে বাঁচিয়ে রাখার নামে একদল কর্মীর মুখের গ্রাস কেড়ে নিচ্ছেন, সাজিয়ে গুছিয়ে সরকারী কাগজের মনোনিবেশ করছেন, এদিকে সমাজের কাছে আমরা দেখাচ্ছি কী কষ্ট করেই না একদল মানুষ নাটক করে যাচ্ছেন। এটা যদি নীতি হয় তাহএ দুর্নীতি কোনটা? সব গল্প বলা হল না, সময় হলে তাও বলার ইচ্ছা রইল।
পরিকাঠামোর পরিবর্তন
দল একটি সামাজিক সংস্থা। নাট্যদলও তাই। নাট্য দলগুলির আমাদের পুর্বজরা লড়াই করেছিলেন বলে, কলকাতার পুরসভা আমাদের কর মকুব করেন, সেটা সরকারে সহকারী নীতি। এই নীতিতেই সরকা্রি অর্থ সাহায্যের কথা উপরিউক্ত কলামে উল্লেখ করেছি। সরকার এই এতো টাকা এইভাবে কেন দেন, এই প্রশ্ন ওঠানোর সময় এসেছে, কারা আনবেন, একসময় গ্রুপ থিয়েটার শিল্পকে বাঁচাতে দিল্লীতে দরবার করেছিলেন নাট্যাকর্মীরা, তখন সেই সব অগ্রজ নাট্যকর্মীদের মধ্যে সেই বোধ ছিল, যে নাট্য শিল্প ও শিল্পীকে বাঁচাতে হবে, আর সেই লড়াইয়ের ফসল যখন হাতে এলো তখন তা ভাগ বাটোয়ারা করে নিজেদের খুশী মতো যে যার দুর্গ রক্ষা করছেন। এইভাবে যলতে থাকলে প্রজন্মে আর এই শিল্পে আসতে চাইবে না। বা এলেও আগে থেকেই ধান্দাবাজিটাকে দারুণ দক্ষতার সাথে আয়ত্ব করে নেবেন। এতে কি নাত্য সামগ্রিক উন্নতি সম্ভব?
লক্ষ্য করলেই দেখবেন, সরকার প্রদেয় মুল্যের পরিমান বাড়িয়ে দিলেন, ৬ হাজার থেকে ১০ হাজার। আর গুরুকে ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার। সরকার চাইছেন এই অর্থ দানের মধ্য দিয়ে এই শিল্পকে রক্ষা করতে কিন্তু অপরদিকে সেইসব সুবিধাভোগী নাট্যকর্মীদের উঠোন বর হচ্ছে। টাকা নিচ্ছেন, প্রোডাকশন নামাচ্ছেন, সরকারী প্রযোজনায় নির্মিত নাটক টিকিট বেঁচে অর্থমূল্য ঘরে আনছেন।
সরকার কি তার সাহায্য সকলের কাছে পৌঁছাতে চায়? সরকারের টাকা পাবার যোগ্যাতার মাপকাঠি কি? তিন বছরের দল যেখানে সাহায্য পান, কিন্তু নিয়মিত কাজ করে যাওয়া ২০ বছরের দল সাহায্য পান না। সাহায্য পেতে গেলে দাদা দিদি ধরার ব্যাপারটা নাইবা বললাম।
তাই পরিকাঠামো বদলানোর প্রয়োজন, সেইকাজে সরকার এগোনো আগে, এই অনিয়মের বিরুদ্ধে নাট্যকর্মিদের এগিয়ে আসতে হবে। নিজের দলের প্রতি সরকার বিরূপ হয়ে তাঁদের দিকে চোখ তুলে তাকাবেন না বলে যদি আমরা চোখে ঠুলি দিয়ে থাকি, তাহলে আমাদের ভবিষ্যতের প্রজন্মেরই ক্ষতি সাধিত হবে। তাই ভাবার সময় হয়ে এসেছে।