কৃষ্ণনগর সিঞ্চন প্রযোজনায় ‘দূরবীন’ যেন ফিরিয়ে নিয়ে যায় ৭৭ বছর পিছনের সময়ে

- Advertisement -

সুব্রত কাঞ্জিলাল

এক অদ্ভুত সময়ের মধ্যে দিয়ে মানব সভ্যতা কোথায় যে চলেছে কে জানে। সূর্য শিকার করতে উন্মত্ত একদল দানব মাঝে মাঝে গোটা পৃথিবীটা গিলে খেতে তাণ্ডব শুরু করে দেয়। দশ হাজার বছরের মানব সভ্যতার ইতিহাসে তাই দেখা যায় একদল দানব ১০ লক্ষ বার নিজেদের অধিকার বিস্তৃত করতে কোটি কোটি মানুষের অধিকার খর্ব করতে যুদ্ধ বাধায়।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের মতো অসংখ্যবার যুদ্ধের আগুন মানব সভ্যতাকে গ্রাস করেছে। তার মধ্যে দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধ মানুষের সভ্যতাকে চ্যালেঞ্জ করেছিল। বিশেষ করে পৃথিবী জয় করবার নেশায় পুঁজির শাসন সমস্ত মূল্যবোধ মানবিকতা বর্জন করে ফ্যসিবাদের যে ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় তার তুলনা আজও বিরল। কোটি কোটি মানুষের রক্তে ভেসে গিয়েছিল পৃথিবীর মাটি।

জার্মানির সংসদীয় গণতন্ত্রকে নাজি বাহিনীর ভারী বুটের নিচে থেতলে থেতলে ক্ষমতা দখল করেছিল হিটলার নামক এক ভয়ংকর দানব। যার স্লোগান ছিল বিশুদ্ধ জার্মান রক্ত পৃথিবী শাসন করবে। জার্মান রক্তই একমাত্র খাঁটি আর্য রক্ত। অন্য সমস্ত ভাষাভাষী এবং সম্প্রদায়ের মানুষেরা মানব সভ্যতার কলঙ্ক। শুরু হয়েছিল লাইব্রেরী পোড়ানোর মধ্য দিয়ে। ইহুদি জনজাতি শিকার করতে নেমে পড়েছিল তার বাহিনী।নিজের দেশে ১০ লক্ষ ইহুদিকে কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পের মধ্যে বন্দী করে গ্যাস চেম্বারে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। এবং একইসঙ্গে শুরু হয়েছিল কমিউনিস্ট এবং গণতন্ত্র পন্থীদের হত্যা করা।

দূরবীন নাটক দেখবার সময় আমরা বারবার ফিরে যাচ্ছিলাম আজ থেকে প্রায় ৭৭ বছর পিছনে একটা সময়। মঞ্চের পর্দা সরে যাওয়ার পর দেখা গেল পেছনের দিকে ঝালরের মত দুদিকে রক্তের ধারা নেমে আসছে মাটিতে। তার সামনে একটা কিউরেটরের দোকান। বেশ কয়েকটি মানবমূর্তির ডিসপ্লে করা হয়েছে। ভারতবর্ষ থেকে একজন যুবক সেই দোকানে ঢুকে পড়ে একটি মূর্তির হাতে দূরবীন আবিষ্কার করে। সেই দূরবীন দিয়ে সে ৭৭ বছর পিছনে ফিরে যায়। আমাদের সামনে উৎঘাটিত হয় সেই ভয়ংকর সময়ের খানিকটা দলিল।

আমরা ছোটবেলা থেকে পাড়ার ফাংশানে স্কুলের রবীন্দ্রজয়ন্তীতে অনেকেই রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর নাটক মঞ্চস্থ করেছি। আজকাল অবশ্য এসবের পাট চুকে গেছে। ডাকঘর নাটকের মর্মবস্তু কজন বুঝতে পেরেছি বলা যাবে না। অনেক গবেষণা করার পর ইউরোপের পোল্যান্ড দেশের একটি ঘটনা জানা যায়। হিটলার অধিকৃত পোল্যান্ড। সেখানকার একটি কুখ্যাত কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পে ধরে আনা হয়েছে একজন পোলিশ শিশু চিকিৎসক ও কয়েকজন অনাথ কিশোরদের। বন্দী শিবিরের অন্ধকারে প্রতিদিন তারা যখন মৃত্যুর সঙ্গে মুখোমুখি হবার সময় গুনছে সেই সময় তারা জানতে পারল যে দুদিন পরে তাদের গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। চিকিৎসক মানুষটি মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ঠিক করলো যে তারা রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর নাটকটা অভিনয় করে দেখাবে। এটাই ছিল তাদের শেষ ইচ্ছে।

বহুদিন আগে আমি একটি পত্রিকায় এই ঘটনার উল্লেখ করে প্রশ্ন করেছিলাম, তাহলে আমাদের জানতে হবে বুঝতে হবে ডাকঘর নাটকের মধ্যে কি এমন শক্তি রয়েছে, সত্য রয়েছে যা মৃত্যুপথযাত্রী একদল মানুষকে জীবনের উত্তাপ এনে দিতে পারে? আমরা যে রবীন্দ্রনাথকে আজও তেমনভাবে চিনতে পারিনি। বোঝার চেষ্টা করিনি। এখান থেকে সেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সে যাই হোক। এই দুঃসময়ে আমাদের দেশ যখন ঘৃণ্য পুঁজির দানবীয় আক্রমণে থেতলে যাচ্ছে। মানবতার চরম সর্বনাশ চারিদিকে দেখা যাচ্ছে। একদল তথাকথিত বুদ্ধিজীবী নামধেও নর কঙ্কাল সমস্ত রকম মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে ক্ষমতার অলিন্দে গড়াগড়ি খাচ্ছে, সংসদীয় রাজনীতির বীভৎস চেহারাটা উলঙ্গ হয়ে পড়েছে।

হিরোশিমা বাতাসে নিঃশ্বাস নেবার মতো এতোটুকু বিশুদ্ধ বাতাস খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সংস্কৃতিক কর্মীদের মধ্যেও একদল শাসকের পদলেহন করতে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে। ঠিক সেই সময় কৃষ্ণনগরের সিঞ্চন নাটকের দলটি তাদের দূরবীন নাটক নিয়ে প্রমাণ করলো যে সবকিছু পচে যায়নি। আমরা অবাক হয়ে যাই না পুজি শাসিত মিডিয়ার উল্লাস দর্শন করে। থিয়েটার সিনেমার যেসব লোকজনকে তারা মাইলেজ দেবার চেষ্টা করে সেগুলো যে মেরুদণ্ডহীন একদল সরীসৃপের চেহারা।

কিন্তু দূরবীনের মতো নাটক নিয়ে কেন যে সর্বোচ্চ চর্চা হয় না, তথাকথিত প্রগতিশীল বামদিকে ঘেঁষা সংস্কৃতিক কর্মীরা দূরবীন নাটকের জন্য কৃষ্ণনগর সিঞ্চনকে প্রচারের আলোয় নিয়ে আসে না পরিবর্তে দু-একজন মেরুদণ্ডহীন অত্যন্ত সুবিধাবাদী আপস কামীদের নিয়ে হইচই বাধায়! আমরা তখন বুঝতে পারি মাছের মত মাথা থেকেই শুরু হয় পচনের প্রক্রিয়া। নাটকের নামে আজকাল কি হচ্ছে? কটা নাটক সমসাময়িক বিষয়কে ধরবার চেষ্টা করছে? সময়ের ভাষা হয়ে ওঠার, মানুষের কণ্ঠস্বর কটা নাটকের মধ্যে দেখা যাচ্ছে?

দূরবীন নাটক শুধু বিষয়বস্তুর জন্যই শিল্প সমৃদ্ধ রাজনৈতিক নাটক হয়ে উঠতে পেরেছে তা কিন্তু নয়। সুশান্ত হালদারের পরিচালনায় এই নাটকের কুশীলবদের অভিনয় আমাদের চমকে দিয়েছে। মঞ্চ প্রকরণ থেকে শুরু করে আবহসংগীত আলোর ব্যবহার এক কথায় টোটাল থিয়েটারের মাইলস্টোন হয়ে উঠেছে এই প্রযোজনা। উচ্চাঙ্গের সূক্ষ্ম অভিনয় কলকাতার নাক উঁচু দল গুলোর মধ্যেও‌ আজকাল দেখা যায় না। সংলাপ ডেলিভারি র সময় যে পজ-এর ব্যবহার নিয়ে সারা পৃথিবীতে চর্চা চলে আসছে তার নাম গন্ধ আমাদের এখানে খুঁজে পাওয়া যাবে না। অবশ্যই দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া।

কিন্তু আমরা আশ্চর্য হয়ে দেখলাম দূরবীন নাটকের কুশিলবরা দক্ষতার সঙ্গে এই দিকটা কে ব্যবহার করেছেন। কোথাও কোনো বাড়াবাড়ি নেই। চিৎকৃত অভিনয় নেই। পরিচালকের পরিমিতি বোধ আমাদের স্তম্ভিত করে। ব্লকিং কম্পোজিশন গুলো অনবদ্য। ডিটেলিং এর কাজও অনবদ্য। আমার দেখা বিগত পাঁচ সাত বছরের মধ্যে এই একটি মাত্র নাটক যাকে চিরকাল মনে রাখা যাবে। এই একটিমাত্র সৎ নাটক যা কখনো কলুষিত হবে না। অনেক কথা না বলে, আঙ্গিকের বাহুল্য সার্কাস না দেখিয়ে এই নাটক আমাদের উদ্বেল করে তোলে। অন্যদিকে ধান্দাবাজ নাট্য কর্মীদের পিঠে সপাং সপাং করে চাবুক চালায়।

- Advertisement -
সাম্প্রতিক পোস্ট
এধরনের আরও পোস্ট
- Advertisement -