নৈতিক রায়
‘হ্যালো মি দুবে’ এক সত্যান্বেশন। এক অস্থির ইতর সমাজের মুখোমুখী দাঁড়িয়ে রুখে দেবার অভ্যাসের বার্তা বয়ে আনা নাট্য নিবেদন। যে নাট্যের প্রযোজনার দায়ভার নিয়েছে কলকাতার অত্যন্ত পরিচিত নাট্যদল রঙ্গলোক। সম্প্রতি তপন থিয়েটারের পর কলকাতার বেশ কয়েকটি প্রেক্ষাগৃহের সফলভাবে মঞ্চস্থ হয়ে চলেছে।
সমাজ বাস্তবতার ভয়াবহ রূপ জন আদালতে দাখিল করার দায়ভার গ্রহণ করেছেন এই সময়েয় একজন বলিষ্ঠ নাট্যকার উদয়নীল ভট্টাচার্য। সংলাপ তাঁর রচনা শৈলীর এক বলিষ্ঠ মাধ্যম। আর সেই সংলাপ যদি কোনো অভিজ্ঞ ও দাপুটে অভিনেতার মুখে উচ্চারিত হয়, তখন তার নাট্যগুণ সম্পূর্ণ প্রকাশ পেতে অসুবিধা থাকে না।
উন্নয়নের পথ ধরে মেট্রোর সিটির পথ ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তিক অঞ্চলে। সরকারী প্রকল্পের আওতায় এসে যায় এক সিন্ডিকেট চক্র, যার অব্যবহিত পরে শুরু হয় ক্ষমতাদখলের সুচতুর খেলা। সেখানে কোনো সৎ মানুষের পক্ষে লড়াই করে টিকে থাকা সহজ হয় না। কারণ এই চক্রের মহীয়ান বলবান স্থানীয় ‘বাবুজী’ রা মাথার ওপর বসে ক্ষমতাবানদের পরিচালনা করে। তাঁর কথামত পৃথিবী সচল থাকে যেন। কিন্তু এই ঘটে যাওয়া বেনিয়ম বা দুর্নীতি সব কিছুকেই মেনে নিয়ে সরকারি আমলারা সুখে স্বাচ্ছন্দে পরিবার সামলে লাইফ স্টাইল মেন্টেন করেন। আজ এই সময়ে দাড়িয়ে এরকম কোনও বোকাকে পাওয়া যাবে না, যে এই সীমাহীন দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান, একমাত্র বোকা ছাড়া।
কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী রেখে এরকম বিবেকবান, সৎ, কর্তব্যপরায়ন উচ্চপদস্থ ইঞ্জিনীয়ার মিঃ সুশীল দুবে বীর দর্পে এগিয়ে আসেন। গোটা জেঁকে বসা অব্যবস্থাকে যেন সজোরে ধাক্কা মারেন। স্বাভাবিকভাবেই গোটে সিটেম নড়ে চড়ে বসে। কিন্তু ঋজু, অনমমনীয় মিঃ দুবে তাঁর সিদ্ধান্তে থাকেন অনড়। এরপর জল অনেক ঘোলা হতে হতে, সেই মহীয়ান ‘বাবুজী’র পক্ষেই সমস্ত তদন্ত কমিটি ঝুঁকে থাকে। কিন্তু তাতেও হেরে যাবার পাত্র দুবে নন। কিন্তু নাট্যের বয়ানে বা ঘটনার সত্যাসত্যে তাকে হেরে যেতেই হয়। এই মিঃ দুবের পরিণতি দেখতে হলে রঙ্গলোকের হ্যালো মিঃ দুবে নাটকটি অবশ্য দ্রষ্টব্য একটি নাটক। আপনাকে দেখতেই হবে।
ঘটনা প্রবাহের সাথে সাথে মঞ্চে যে সকম নাট্য মুহুর্ত অসামান্য দক্ষতার সাথে নির্মান করা হয়েছে, তার জন্য কৃতিত্বের অগ্রাধিকার পাবেন শুভ গুপ্ত ভায়া। নাটকটি দেখতে দেখতে বার বার মনে হয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নাট্যকারের ভাবনার যথাযথ আত্তীকরণ করেছেন নির্দেশক। টেক্সট আর সিঙ্কোনাইজেসন বেশ ছন্দময় ছিল।
মিঃ দুবে চরিত্রের রূপকার বিশ্বজিৎ ঘোষ মজুমদারের সহজ ও সরল না-অভিনয় নাট্য কলার নবোতম দিকের উন্মোচন করেছে অভিনেতা। চরিত্র নির্মানে কোনো তামঝাম, অঙ্গ সঞ্চালনা দেখা যায়নি তাঁর অভিনয়ে। এই ব্যাপারে চরিত্র নির্বাচনে অবশ্যই সফল নির্দেশক।
শামীম রেজার ভূমিকায় পার্থ মুখোপাধ্যায় বেশ ভালো অভিনয় করেছে। নাট্যের দ্বিতীয়ার্ধের নাট্য মুহুর্ত নির্মানে তার ভূমিকা কম নয়। স্বয়ং নির্দেশক শুভ গুপ্ত ভায়া উচ্চাকাঙ্ক্ষী বসের ভূমিকায় ভীষণ সাবলীল। ঘুষখোর পুলিশ বাবুলালের চরিত্রে বিভাস ব্যানার্জী নাট্যের রিলিফ দিতে সম্পুর্ণ সক্ষম।
এই নাটকের যে চরিত্র সম্পর্কে না বললে বলা পুর্ণতা পাবে না, তা ‘বাবুজী’ চরিত্রনির্মানে অভিনেতা শ্যামল সরকার। মঞ্চে জুড়ে তাঁর অভিনয়ের দাপট আমাদের বার বার স্মরণ করায় বর্তমান ক্ষমতাসীন ভয়ঙ্কর লম্পটদের কথা। সংলাপ ও অঙ্গ সঞ্চালনার অপুর্ব ছান্দিক নাট্যাভিনয় যেন বহুদিন বাদে দেখা মিলল।
অন্যান্য চরিত্রগুলির মধ্যে বিশেষ করে, বাবুজির আস্তানায় বৃদ্ধ নাসের চরিত্রাভিনয়ে শিশির রঞ্জন রায়, কুন্তা চরিত্রে বিংশতি বসু, রোহিত শর্মা চরিত্রে অভিজিৎ ব্যানার্জী, মনপ্রীত সিং প্রমুখের অভিনয় বেশ সাবলিল।
প্রধান উপদেষ্টা শ্যামল চক্রবর্তী মাথার ওপর থেকে সামগ্রিক প্রযোজনার মান নিয়ন্ত্রণে নিশ্চই নিজেকে নিবেদন করেছেন নিশ্চই।
নির্দেশক শুভ গুপ্তভায়ার মুন্সিয়ানা আর মঞ্চচিন্তক শ্যামল সরকারের যথাযথ প্রয়োগ আর অবশ্যই আলোয় সুদীপ সান্যালের জাদু সমগ্র প্রযোজনাকে সমৃদ্ধ করেছে। নাটকে প্রজেকশনের ব্যবহার দেখা গেছে, যার কোনও প্রয়োজন ছিল বলে মনে হয় না। বরং না থাকলে সেতা অভিনয় দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে করা যেতে পারে। এহেন বাংলা নাট্যাভাসের পেশাদারিত্ব বেশ চোখে পড়ার মতো- !!!