Saturday, July 12, 2025
Saturday, July 12, 2025
Homeসিনেমা‘অংক কি কঠিন’ সেই তাজা বাতাসের এক সোজা হিসেব

‘অংক কি কঠিন’ সেই তাজা বাতাসের এক সোজা হিসেব

দেবা রায়

সামাজিক অবক্ষয় যখন সারা বাংলা তথা দেশের আনাচে কানাচে বাসা বেঁধে রয়েছে, সেই চরমতম হাঁসফাঁস করা সময়ে বাংলা সিনেমা বয়ে নিয়ে এল এক মুঠো তাজা বাতাস। সৌরভ পালধি পরিচালিত ‘অংক কি কঠিন’ সেই তাজা বাতাসের এক সোজা হিসেব। যা বাংলা সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি সযত্নে এড়িয়ে এসেছে বহুকাল ধরে।

একদিকে প্রান্তিক মানুষের যন্ত্রণা আর অপর দিকে শৈশব মনের দামালপনা। এই সিনেমার বাণিজ্যের গাণিতিক হিসেবের অঙ্ক হয়ত মিলবে না। কারণ বাঙালি কয়েক দশক ধরে তার জীবনের হিসেবের খাতায় বাজার কেন্দ্রিকতাকেই তোল্লাই দিয়ে আসছে। আর সেই কঠিন সময়ে প্রযোজক রাণা সরকার এরকম এক ছবি বাঙালিকে উপহার দিলেন তাকে নির্মাণ করার সুযোগ দিয়ে। হয়তো আরও ছবি নির্মাণের উৎসাহ যোগাবে এই প্রয়াস।

‘ছোটরে কখনও ছোট নাহি কর মনে, আদর করিতে জানো অনাদৃত জনে’ –এই বয়ানের সূত্র ধরে এগিয়ে গেলে অনাদরে, অবহেলায় পড়ে থাকে শিশুদের গোপন ডেরায় ঝাঁক মেড়ে মিলে গেলেও যেতে পারে অমূল্য রতন। আর এই রতনকে চিনে, তাকে সেখানে থেকে আমাদেরই সামনে তুলে ধরার গুরু দায়িত্ব নিয়েছেন পরিচালক সৌরভ পালধি। ছবি নির্মাণে তাঁর দক্ষতা তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন। নির্বাচন থেকে নির্মাণ সবেতেই তাঁর সুস্থ সমাজ চেতনা ও শৈল্পিক গুণ প্রকাশ পেয়েছে। তিন খুদের না বলা কথা ও স্বপ্নের ঠিকানা তিনি অনুধাবন করেছেন বলেই বাবিন-টায়ার-ডলি চরিত্ররা পর্দায় এক মায়াজাল বিস্তার করে থেকেছে। এই তিন চরিত্রের শিল্পী ঋদ্ধিমান বন্দ্যোপাধ্যায়, তপোময় দেব ও গীতশ্রী চক্রবর্তী, তাঁদের অত্যন্ত সাবলিক অভিনয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন এক নিপাট সামাজিক গল্পের চিত্রকল্প।

শৈশবের নানান চাওয়া থাকে। সেই শৈশব, শ্রেণি বিভক্ত সমাজে চিরাচরিত বয়ানে বিদ্যমান। তাই এই বাবিন-টায়ার-ডলিও তাদের ব্যতিক্রম নয়। তারা স্বপ্ন দেখেছে এক পরিত্যক্ত বাড়ি যা আব্বুলিশ নামে চিহ্নিত, সেখানে তারা গড়ে তুলবে হাসপাতাল। একটি বস্তিতে যা অসম্ভব, অবাস্তব বা স্বপ্নের কথামালা। যে অঙ্কের উত্তর অনেকেই পাবেন না। কিন্তু ওই শিল্পীমনের বিমুর্ত্রা যখন খেলার মনন, যাপনে তখনই এই ‘অংক কি কঠিন’ এর মতো একটি ছায়াছবি তৈরি হয়। তিন প্রান্তিক সন্তানের সংসার আর তাদের বন্ধুত্ব, আর স্বপ্ন নামক ম্যাজিকের কেরামতি।

আর এগল্পের পাশাপাশি এগিয়েছে এক সুন্দর প্রেমের কাহিনী, যা শহর কলকাতা বা বাংলা আবহমানের সংস্কৃতিকেই নির্দেশ করে। বাঙালির শাহরুখ- কাজল রূপে প্রসূন সোম ও পর্ণ মিত্রর স্বাভাবিক অভিনয় হয়তো হিরোইজমকে উস্কে দেবে না, কিন্তু বাঙালি মনের রোমান্টিকতাকে নর্দমা থেকে টেনে বার করে নিয়ে আসতে একশ শতাংশ সফল চিহ্নিত হবেই। প্রেমের রসায়ন বেশ সফল। এই সিনেমায় বাবিনের বাবার চরিত্রে শঙ্কর দেবনাথের অনবদ্য অভিনয় এই ছবিকে যেন মেরুদন্ডের মতো টান টান করে রেখেছে। বাবাইনের মায়ের চরিত্র নির্মাণ ও নির্বাচন যথাযথ, আর সেই কাজটি করেছেন থিয়েটারের এক বলিষ্ঠ অভিনেত্রী সঞ্জিতা। টায়ারের মায়ের চরিত্রে দীপান্বিতা নাথের স্ক্রিন প্রেজেন্স, আচ্ছা আচ্ছা নামী অভিনেতাদের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে। ডলির মায়ের চরিত্রে উষসী চক্রবর্তীও বেশ স্বাচ্ছন্দ থেকেছেন।  

এই ছবিতে লগ্নজিতা চক্রবর্তীর কণ্ঠে ‘একটা গল্প বলো’ এক অপূর্ব মুর্ছনা নির্মান করে। ঞ্চিকেতার ‘বাহান্ন পাখি’ যেন ছবিটিকে পুর্ণতা এনে দেয়।  

এই ছায়াছবির বেশ কিছু দৃশ্যের অবতারণা বেশ প্রসংশার দাবি রাখে। যেমন ইঞ্জিনিয়ার টায়ারের হাতে তৈরি গাড়িতে মা কে বসিয়ে তাকে নিয়ে ছেলে গুরে বেড়ানো, ছোট্ট ছেলে বাবিনের ভবিষ্যত নিয়ে বাবা ও মায়ের এক অটোতে বসে আলোচনা, ডাক্তার সন্তানের, তার বাবাকে ইনজেকশন দিয়ে রোগ সারানো, ডলির মায়ের সাথে তিন বন্ধুর খাওয়া ভাগ করে নেওয়া এরকম আরও বহু ঘটনার কোলাজ জুড়ে জুড়ে কখন কিভাবে একটা গোটা সিনেমার, অঙ্কের সমীকরণ যেন মিলিয়ে ফেলেছেন সৌরভ পালধি।

আর এখানে এই সিনেমার সার্থকতা। শিল্প ও বিনোদন একসাথে হাত ধরাধরি করে হাঁটে। বেশ কিছু বড় ক্যানভাসের শট বা দৃশ্যায়ন এই ছবির সম্পদ বলা যেতেই পারে। এ ছবি সাহসের কাছে হার মানে কঠিন বাস্তব। অবাস্তবের সেই কথীন সমীকরণ সেই খুদে টীম যখন আব্বুলীশ বাড়িতে ঘটিয়ে ফেলেন তখন কখন কোথায় কিভাবে যে সেটা একটি ফর্মুলায় রূপ নেয় তা সত্যি বলা কঠিন।

তাই সিনেমা বাঙালির মননের ছবি। নস্টালজিয়ার ছবি। সামাজিক দায়বদ্ধতার ছবি। অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে রুখে দেবার ছবি।    

RELATED ARTICLES
- Advertisment -

Most Popular