পারমিতা ব্যানার্জী
স্বপ্ন বড় গোলমেলে জিনিস। যে কথা একজন বাধ্য নাগরিকের ভাবাও পাপ, যে ইচ্ছেগুলো জন্মানোর আগেই পাথর চাপা দিয়ে দেওয়াটাই সমাজের দস্তুর, সেই সব নিষিদ্ধ ভাবনা সব বিরোধ ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে স্বপ্ন হয়ে। কিছু ক্ষেত্রে আবার তা বড় সংক্রামক, বিপজ্জনকও। কারণ এক থেকে অন্যের মধ্যে সংক্রামিত হয়ে সেই স্বপ্ন কখনো শাসকের চোখে চোখ রাখার মতো শক্তি সঞ্চয় করে ফেলে।
হতেই তো পারে আজ জম্পেশ বিরিয়ানি খেতে খেতে হিন্দু মুসলমান উত্তেজনা নিয়ে লম্বা নিউজ দেখে দশটা গালাগালসমৃদ্ধ ফরোয়ার্ডেড হোয়াটসঅ্যাপ আবার ফরোয়ার্ড করে হৃষ্টচিত্তে শুলাম। কিন্তু স্বপ্নে ঘুমের মধ্যে পৌঁছে গেলাম পীরপাঞ্জাল থেকে চোদ্দ মাইল দূরবর্তী সেই কাশ্মীর উপত্যকায় যেখানে সবে বিংশ শতকের পরাধীন ভোরের আলো ফুটছে। জোতদার, রাজা, যুযুধান জমিদারদের দাপটে লোপাট হয়ে যাচ্ছে নদী-পাথর-মাছ নিয়ে গান বাঁধা গরীব অন্ত্যজ চাষাভূষোরা। এলাকার মসিহা ফজ্জা ডাকু মাথা ঘোরানো মাথার দাম নিয়ে জোতদারের গুলিতে নিকেশ হয়ে যাচ্ছে, অথচ লাশকাটা ঘর থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে তার দামী মাথাটা। বেয়াড়া মুসলমান শিক্ষককে বাঁচাতে উলুখাগড়া হয়ে যাচ্ছেন এক হিন্দু ডাক্তার। নির্ঝঞ্ঝাটে সন্তানকে দুধেভাতে রাখতে চাওয়া এক রুগ্ন খিটখিটে গিন্নী আঁতকে উঠছেন ঘুষের টাকার থলিতে আজীবন সৎ ডাক্তারের সততার লাশ দেখে। এগুলো একটা নয়, অনেকগুলো খণ্ড বিখণ্ড স্বপ্নের মিছিল। এমন স্বপ্ন দেখতে নেই, রাষ্ট্র বারণ করে, উপনিবেশ বারণ করে, মায়া সুখের সন্ধানী সমাজ বারণ করে। তাও স্বপ্নমিছিল কেউ কেউ বার করেই ফেলেন। কখনও কৃষাণ চন্দর কখনও নাটককার সুপর্ণা ভট্টাচার্য।
‘বাবুর মা’ সত্যিই বলেছিলেন। মরা মানুষে কথা শুনতে পায় না। আমরা কি শুনতে পেয়েছি যে কথা শোনার ছিল? শুনতে চেয়েছি কখনও? স্বপ্নমিছিলের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে খানম আমাদের দিকে তাকিয়ে বলে “এখানে সবাই মরা মানুষ!” এইসব কথা কি বলতে আছে? সত্যিই যদি লোকে শুনে ফেলে? এ দেশ জেগে উঠলে ধর্মের তাসগুলো, জাতপাতের তাসগুলো লুকোবে কোন গর্তে?
অঙ্গন নাট্য সংস্থার সাম্প্রতিক নাটক ‘স্বপ্নমিছিল’ দেখে এইটুকুই বলতে ইচ্ছে হল। কৃষাণ চন্দর এর সাহিত্য অনুসরণে এ নাটকটি লিখেছেন সুপর্ণা ভট্টাচার্য এবং নির্দেশনা দিয়েছেন অসীম ভট্টাচার্য। মোটের ওপর নিরাভরণ মঞ্চসজ্জা। ঠিক যেটুকুর প্রয়োজন, সেইটুকুই। সৈকত মান্নার আলোর ব্যবহারেও কোনো অকারণ গিমিক নেই কিন্তু দৃশ্যান্তরে আলোর ব্যবহার দেখতে ভালো লেগেছে। ফজ্জা (দীপঙ্কর ঘোষ) আর খানম (চন্দনা চ্যাটার্জি) এর কয়েক মিনিটের দৃশ্যে মঞ্চের অর্ধেকটা যেন একটা পৃথিবী হয়ে ওঠে। ডোলার খালি গলায় মেঠো সুরের গান আশ্চর্য মায়াবী একটা আবেশ নিয়ে আসে। সেই গানে যখন তারা (সুপ্রীতি দাস) আর তুরজা (অর্পিতা ঘোষ) ঘুরে ঘুরে নাচতে থাকে, আগাগোড়া একটা হেরে যাবার গল্পেও বাঁচবার অসম্ভব স্পৃহা তৈরী হয়। কিষেণ চন্দররের জবানীতে বাবুর (আরুষ দত্ত) চরিত্রটি কঠিন, কিন্তু বোরিং হয়নি কখনও। বাবুর বাবা (ডাক্তারের চরিত্রায়ণে অসীম ভট্টাচার্য) আর বাবুর মা (সুপর্ণা ভট্টাচার্য) প্রথম অঙ্কে কেমন মনোজ মিত্র গীতা দে জুটির রোম্যান্স ফিরিয়ে আনছিলেন, পরের অঙ্কে হিসেব এলোমেলো হয়ে যাবার সময় দু’জনের টেনশন আসলে গল্পকে শিরদাঁড়ার মত ধরে রাখে।
সংলাপের কিছু কিছু মোচড় ভয়ানক গভীর। কিন্তু কিছু রেফারেন্স বেশ আধুনিক, একবিংশ শতাব্দীর মতন। এতে টাইমলাইন নিয়ে একটা কনফিউশন তৈরী হয়, এটা নাটকের একটা উদ্দেশ্য ছিল কিনা জানি না। মোটের ওপর স্বপ্নমিছিলের মঞ্চায়ন দেখে বড় খুশী হয়েছি। এই নাটক অনেক অনেক বার আসুক, মানুষে দেখুক। আমার কিন্তু স্বপ্ন দেখতে আজও ভালো লাগে!