(নাট্য ও থিয়েটারের উৎস ইতিহাস)
ডঃ শুভ জোয়ারদার
পৃথিবীতে বেশ কিছু জিনিস আছে যেগুলিকে ঘিরে গোড়ার থেকেই একটা বিতর্কের বাতাবরণ আছে। ‘থিয়েটার’ সম্ভবত ঠিক তেমনই একটি শব্দ! থিয়েটার, বিশেষ করে দেশীয় থিয়েটার নিয়ে যেদিক থেকেই এগোতে চান না কেন, দেখবেন রাস্তাটা যেন একটা অন্ধগলিতে আটকে পড়েছে বা অংকটা যেন ঠিকঠাক মেলানো যাচ্ছে না। যার ফলে আমাদের বাংলা থিয়েটারের তত্ত্ব-প্রয়োগ-সংকট বা মতিগতি সম্পর্কে কথা উঠলেই দেখতে পাওয়া যাবে যে বহু প্রশ্নের উত্তর অদ্যাবধি অমীমাংসিত অথবা স্পষ্টতই পরস্পর বিরোধী। আসুন, এ নিয়ে আমরা এখানে একটু খোলাখুলি কথা বলে সমস্যার গভীরতা মাপার চেষ্টা করি।
প্রথম রাতে বেড়াল মারার মতো সবার আগেই বলে ফেলা ভালো যে, থিয়েটার আর নাটক আপাতদৃষ্টিতে সমগোত্রের বলে মনে হলেও, কার্যত কিন্তু দুটি বস্তু স্বতন্ত্র। একটি সম্পূর্ণ বিদেশী বিনোদন, অন্যটি খাঁটি দেশজ। তবে থিয়েটারের শুরু যীশু খীষ্ট্রের সাতশ বছর আগে, গ্রীস দেশে হলেও এদেশে থিয়েটার শুরু করে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর কর্মচারীরা, আজ থেকে কমবেশি দু’শো বছর আগে নিজেদের মনোরঞ্জনের জন্য। নবাবের অনুমতি না নিয়েই বাণিয়া ইংরাজরা কলকাতায় Old Playhouse থিয়েটার হল আর কেল্লা স্থাপন করেছিল। এর ফলে ক্রদ্ধ নবাব তোপ দাগলে উড়ে গিয়েছিল কলকাতার প্রথম থিয়েটার রঙ্গালয়। ওখানে হোত বিশুদ্ধ বিদেশী ইংরাজী থিয়েটার। ১৮১৭ সালে দেশীয় মানুষজনের মধ্যে ইংরাজী শিক্ষার প্রসারের জন্য ‘হিন্দু কলেজ’ স্থাপিত হয় কলকাতাতে। কলকাতার ফুর্তিবাজ বাবুরা অতঃপর শিক্ষার আলোকবৃত্তে এসে নতুন আমোদ ‘থিয়েটার’-এ মজলেন। যার কিছু বাস্তবানুগ বর্ণনা পাওয়া যায় বঙ্কিম চন্দ্রের ‘বাবু’ প্রবন্ধ বা মধুসূদন দত্তের ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ নাটকে। অর্থাৎ ভারতে বিদেশী প্রসেনিয়াম থিয়েটার চর্চার দেশীয় উদ্যোগের শুরুয়াৎ হয়, নব্য ইংরাজি শিক্ষিত ‘বাবু’দের শৌখিন হুজুকে। প্রথমে সরাসরি ইংরাজদের অনুকরণে ইংলিশ প্লে হোত! পরে দেশীয় ভাষাতে অভিনয় হয়, ইংরাজি বা সংস্কৃত নাটকের অনুকরণে। এই সমুদয় প্রচেষ্টা ছিল আঙ্গিক আর বিষয়ে আক্ষরিক অর্থেই বিদেশী প্রসেনিয়াম ধর্মী। কলকাতা থিয়েটারে মাত্র একবারই দেশীয় কনটেন্ট ও ফর্মকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল, দেশীয় দর্শকদের গ্রহণযোগ্যতাকে মাথায় রেখে। সেটা ১৭৯৫ সালে ঘটিয়েছিলেন রাশিয়ান নাট্যপরিচালক লেবেদেফ আর তার বঙ্গজ সহকারী গোলোকবিহারী দাস। মঞ্চসজ্জার পরিকল্পনা ও গীতধর্মী পালাবিন্যাসে তারা আগাগোড়া দেশীয় প্রকরণ ব্যবহার ক’রে আমজনতার কাছে এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন যে তৎকালীন ইংরাজী থিয়েটার আর প্রশাসনের কর্তামশাইদের অসূয়াজনিত কারণে বিরাগভাজন হয়ে অচিরেই ডোমতলা লেনের সেই বেঙ্গলী থিয়েটারে আগুন লেগে গিয়েছিল।
অন্যদিকে প্রথম মৌলিক বাংলা নাট্য রচনা করে সেযুগে ১৮৫৪ সালে বাবু ঈশ্বরচন্দ্র সিংহের থেকে শ্রেষ্ঠ নাট্যকার হিসাবে, ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’ নাটক লিখে পঞ্চাশ টাকা জলপানি আদায় করেছিলেন তৎকালীন সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক রামনারায়ণ তর্করত্ন মশাই। যে বাবু কালচারের বাই প্রোডাক্ট হিসাবে বঙ্গরঙ্গমঞ্চে থিয়েটারের পত্তন, সেই বাবু কালচারের বিরোধিতা করেই এই মৌলিক নাট্য রচনা। থিয়েটার যে সততই স্ববিরোধী তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সংস্কৃতি বিজ্ঞানীদের মতে পৃথিবীর প্রাথমিক মঞ্চগুলি ছিল নন-প্রসেনিয়াম এবং লোকনাট্য ঘরানার। গ্রীসদেশে প্রসেনিয়ামহীন থিয়েটার শুরুর বহুকাল আগেই পূর্বভারতের গঙ্গারিডি সভ্যতার হাত ধরে নাট্য বিনোদনের প্রচলন ছিল। এ নাট্য ছিল একেবারেই অনার্য ভূমিপুত্রদের। এটা প্রায় খ্রীষ্টপূর্ব দুই হাজার সালের কথা। গ্রিক ও রোমানদের বহু আগেই এই না রাজ্যের লোকনাট্য চর্চার সূত্রগুলির সমন্বয়ে অনার্যপুত্র ভরত একখানি নাট্যব্যকরণ লেখেন ‘নাট্য শাস্ত্র’ নামে, আজ থেকে কমবেশি সাড়ে তিন হাজার বছর আগে। এ কথার অর্থ হলো ইয়োরোপের থিয়েটার চর্চার বহু হাজার বছর আগেই ভরত মুনি তাঁর ‘নাট্য শাস্ত্র’ প্রণয়ন করেন। শাস্ত্রের আগেই চর্চা বিধেয় হওয়ায়, আমাদের নাট্যচর্চার প্রচলন তারো বহু আগে। লোকনাট্য তারও বহু আগে। পন্ডিত অতুল সুর, ড। দীনেশচন্দ্র সেন, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রমুখ ঐতিহাসিকদের মতে তাম্রাস্মযুগে সারা পৃথিবীতে তামা সরবরাহ করতেন গঙ্গানদীর অববাহিকার রাঢ় (লালমাটি) অঞ্চলের নাবিক আর বণিকেরা। গ্রিক মহাকাব্য ও অন্যান্য নথিপত্র থেকেও জানা যায় যে খৃষ্ট্রের জন্মের দেশ হাজার বছর আগেই গঙ্গারিডির বাণিজ্য পোতগুলি গ্রিসের বাজার দখল করে সেখানে রীতিমত উপনিবেশ গড়ে তুলেছিল। প্রাচীন নথিপত্র সুত্রে জানা যায় সেকালে, আর্যরা ভারতে আসার আগেই গঙ্গারিডির ভূমিপুত্ররা নিজদের সমুদ্রবন্দর তাম্রলিপ্ত থেকে পাল তোলা জাহাজে তামা, রেশম, মশলা, গুড়, অলংকার ও খেলনাপাতির সম্ভার নিয়ে মিশর হয়ে গ্রীসে পাড়ি দিয়েছিল। অনুমান গঙ্গারিডি লোকনাট্য বিনোদন সূত্রেই গ্রিক থিয়েটারের সূত্রপাত। তথ্য বলছে যে রোমানরা সঙ্গীতে সিদ্ধ হলেও নাটক জানতো না। তারা প্রসেনিয়ামহীন নাট্যবোধের প্রাথমিক পাঠ পেয়েছিল গঙ্গারিডির থেকে আসা নাবিক ও বণিকদের অস্থায়ী শিবিরগুলির থেকেই। ফলে এটা সহজেই অনুমেয় যে, প্রাচ্যের নাট্যবীজেই পাশ্চাত্যের থিয়েটার চর্চার অঙ্কুরোদ্গম। পরবর্তীকালে সেই থিয়েটার ফর্ম আর কনটেন্টে রদবদল ঘটিয়ে সারা পৃথিবীতে সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে।
এবারে গোটা ব্যাপারটা গোলমেলে হলেও অনেকটা এইরকম। ব্রিটিশ থিয়েটারের উৎস রোমান থিয়েটার হলেও, তাদের থেকে থিয়েটার শিখেছে কলকাতার নব্য বাবুরা। অন্যদিকে আগেই বলেছি ইউরোপীয় উৎস গ্রিকরা মঞ্চচর্চার বোধ পেয়েছে পূর্বভারতের লোকনাট্যধর্মী নাটক থেকে। অর্থাৎ নাট্যসুত্রে থিয়েটার চর্চার গোড়াপত্তন হলেও, খোদ নাটকের ভূমিপুত্ররা ‘নতুন কিছু’ চর্চা করতে থিয়েটার শিখতে কেঁচে গণ্ডূষ করেছে ব্রিটিশ কলকাতাতে। পৃথিবীতে সবকিছু সতত পরিবর্তনশীল। তার মধ্যে সবচেয়ে পরিবর্তনশীল হলো সংস্কৃতি। যুগে যুগে সংস্কৃতির এতাদৃশ স্থানান্তরণ হরহামেশা ঘটে চলেছে। এটাই স্বাভাবিক। তবে ভারতীয় ঐতিহ্যময় নাটক আর ইউরোপের থিয়েটারের ক্ষেত্রে বিষয়টা বেস বিচিত্র আর আত্মবিস্মৃতির। কারণ এক্ষেত্রে শুধুই সাধারণ গমনাগমন ঘটেনি। প্রশ্ন উঠেছে আত্মসম্মানজনিত গ্রহণযোগ্যতারও। আর এই প্রশ্ন উঠেছে সমাজবিজ্ঞানের নিরীখে যুক্তিতর্কের বিশ্লেষণে, এখানে আমাদের ভারতীয় নাট্য শাস্ত্রের ভূমিকা অত্যন্ত গভীর এবং অনিবার্য। বিষয়টি অতঃপর একটু খোলসা করা যাক।
গোটা দেশের নানা অঞ্চলের লোকনাট্য
(কমবেশি ১০ হাজার বছর আগের বিনোদন)
নানা আঞ্চলিক লোকনাট্যগুলির সমন্বয় সূত্রে পৃথিবীর প্রথম নাট্য ব্যকরণ গ্রন্থ ‘ভরতের নাটাশাস্ত্র’ (১৫০০ খৃষ্ট পূর্বাব্দ)
গ্রীক থিয়েটারের প্রথমপর্ব (৭০০ খৃষ্ট পূর্বাব্দ)
গ্রীক ও রোম থেকে ইউরোপীয় থিয়েটার সুত্রে ব্রিটিশ থিয়েটার (১৫৫০ খৃষ্টাব্দে) সূত্রপাত।
ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ইংরাজ কর্মচারীদের আগ্রহে কলকাতায় প্রথম থিয়েটার ১৭৫৩ খৃস্টাব্দে ‘দ্যা প্লে হাউস’।
১৭৯৫ সালে লেবেদেফ ও গোলোকবিহারীর উদ্যোগে লালবাজার সন্নিহিত ডোমতলা লেনে ‘বেঙ্গলী থিয়েটার’এর প্রতিষ্ঠা।
১৮১৭ সালে ‘হিন্দু কলেজ’ প্রতিষ্ঠার পরে নব্যবাবুদের অনুকরণে ইংরাজী থিয়েটার চর্চা, ধনি বাবূদিগের পৃষ্ঠপোষকতায়।
বাবুদিগের প্রথম মৌলিক বাংলা নাটককার রামনারায়ণ তর্করত্নের ‘কুলীনকূলসর্বস্ব’ ১৯৫৪ সালে।
প্রথম পেশাদারী বাংলা রঙ্গমঞ্চ ‘ন্যাশানাল থিয়েটার’-এ গিরিশ ঘোষের উদ্যোগে অভিনীত দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’।
এই তথ্য সারণি থেকেই পরিষ্কার যে পূর্বভারতের আদি লোকায়ত বিনোদন বা লোকনাট্য গৌতম বুদ্ধের সমকালের কিছু আগে পরে ধ্রুপদী নাট্যচর্চায় সুপরিণীত হয়। অন্যদিকে আর্য আগমনের আগেই অনার্য গঙ্গারিডির এই লোকনাট্যানুগ বিনোদনশৈলী বাণিজ্যপণ্য সমূহের সঙ্গে সাতসমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে গ্রিসে পৌঁছালে, সেই মঞ্চকলা সে দেশে প্রথমত অনুসৃত; পরে অনুশীলিত হয়! অর্থাৎ দেশে বিদেশে, ভারতে বা ইউরোপে, নাটক বা থিয়েটার যাই বলা হোক না কেন, তার উৎস বা শিকড় হোল লোকনাট্য; যা কি না একটি দেশের লোকজ সমাজের অভ্যাস আচরণ এবং দীর্ঘদিনের প্রাত্যহিক যাপনপ্রণালীর অনিবার্য অংশবিশেষ। মানুষ যেমন বিকশিত হয় বংশগতি (জিন) আর পরিবেশ বাতাবরণের অমোঘ প্রভাবে, সংস্কৃতিও তাই। উৎস শিকড়ের জিন চিহ্ন আর আঞ্চলিক ভূগোলের শর্তগুলিকে মান্যতা দিয়ে, একটি পারমুটেশন-কম্বিনেশনে নিজস্ব পরিচয়ে স্বীকৃত হয়। এইভাবেই পূর্বদেশের একমেবদ্বিতীয়্যন জননীর দুই সন্তান নাটক আর থিয়েটার, ভিন্নদেশে ভিন্ন সময়ে, ভিন্ন বোধে বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে। থিয়েটার বা নাটকে বীজ বা উৎস একই হলেও, স্বাদ গন্ধ চরিত্র আর অভিজ্ঞতায় এরা অনেকটাই আলাদা।
থিয়েটারের তুলনায় নাটক অনেক সিনিয়র বা প্রধান। তাছাড়া থিয়েটার পশ্চিম গোলার্ধের বোধবিশ্বাসের, অন্যদিকে নাটক হলো প্রাচ্যদেশের নিজস্ব অন্তর্যাপনের সহজিয়া বিনোদন, থিয়েটার আর নাটকের মূল ভেদাভেদটি ফর্ম বা আঙ্গিকের। লোকনাট্য আর নাটক আঙ্গিকে প্রায় এক। পাখীর মতো মুক্ত ডানায় স্বাধীন। অন্যদিকে থিয়েটার প্রথমদিকে তার উৎস বা জননীর মতো নন-প্রসেনিয়াম হলেও অল্পদিনের মধ্যেই ব্ল্যাকবক্সমুখী বা পর্দানশীন হয়েছে। লোকনাট্যের গ্রাম্যতা মুক্ত হয়ে নাটক ধ্রুপদী বা অভিজাত হলে, অচিরে তার রীতিনীতি অবগতকরণের জন্য শাস্ত্রানুসারী হয়েছে, অন্তত ১৫০০ খৃষ্ট পূর্বাব্দে। অন্যদিকে থিয়েটারের প্রকরণ নিয়ে গ্রামার বইয়ের প্রচলন অনেক পরে। তবে একথা অনস্বীকার্য যে মঞ্চকলা বিশয়ে সারা পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত যতো গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, ভরতমুনি প্রণীত ‘নাট্যশাস্ত্র’ তার মধ্যে সবার শ্রেষ্ঠ ও স্বয়ং সম্পূর্ণ। যাযাবর আর্যরা ভাগ্যান্বেষণে ভারতে এসে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে শিক্ষা লাভ করে। একটিতে পেটের খিদে মেটায়, অন্যটিতে মনের খিদে। ভারতে এসে যেমন তারা কৃষির সঙ্গে পরিচিত হয়, তেমনি পরিচয় পায় সমাজ আর বিনোদনের এক অভিন্ন যৌগ নাটকের। গঙ্গারিডির অববাহিকা ধরে পশ্চিমদিক থেকে ক্রমশ পূর্বদেশের গঙ্গারিডিতে এসে আর্যরা বুঝতে পারে ‘বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি’, জয় করা অসম্ভব। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে হস্তী-অশ্ব-পদাতিক ও নৌসেনানী অলঙ্কৃত পূর্বদেশের যুদ্ধ নৈপুণ্যের কথা শুনেই গ্রীকবীর আলেকজান্ডারও পিছু হটেছিলেন। আর্যরা চলে না গিয়ে স্থানীয় ভাষা, মানুষ ও সংস্কৃতিকে আপনার করতে নাট্যমনষ্ক হয়ে নাটককে কাজে লাগালেন। অনার্য নাট্যাচার্য ভরতকে অনুরোধ করলেন নাট্য বোঝার ও প্রয়োগের জন্য একটি প্রকরণপুস্তক প্রণয়ন করতে। সমাজ বিজ্ঞানীরা বলেন বহিরাগত আর্যভাষা আর স্থানীয় ভাষার সংস্কার সাধনেই ‘সংস্কৃত’ ভাষার সৃষ্টি। উভয়পক্ষের গ্রহণযোগ্যতার কারণেই ভরতমুনি লিখলেন ‘নাট্যশাস্ত্র’। এখানে জানা দরকার যে আর্যরা এদেশে এসে ইতিমধ্যেই চারটি বেদ লিখেছিলেন তাদের আচার আচরণের প্রচারনকরণে। সেই বেদ গুলিতে শূদ্রের অধিকার না থাকলেও, ভরতের নাট্যশাস্ত্র পঞ্চম বেদ নামে অভিহিত করা হলেও, এই শাস্ত্রগ্রন্থটিতে কিন্তু অনার্যদের অধিকার ছিল। কারণ সেই গ্রন্থের স্বয়ং প্রণেতাই ছিলেন একজন অনার্য নাট্যাচার্য। এই বিষয়টির সমর্থন মেলে বেদের ভাষা আর পঞ্চমবেদ নাট্যশাস্ত্রের ভাষার তুলনামূলক পাঠবিচারে।
অতঃপর নাট্যশাস্ত্রের বিধিনির্দেশকে মান্যতা দিয়ে আর্যরা কতটা নাট্যানুশীলনে ব্রতী হলেন, সে কথা পরে। কিন্তু এই প্রশ্নটি অনিবার্যভাবে উঠে আসে যে, বহিরাগত আর্যরা যেখানে আমাদের সংস্কৃতি বুঝতে, তার প্রকরণগুলি রপ্ত করছেন, তখন নাট্যশিক্ষার্থী আমরা কেন সেই অমোঘ গ্রন্থটির ভুমিকাকে ভুলে গিয়েছি? কারণ পরিতাপের বিষয় হলেও এখানে এই জরুরী প্রশ্নটি দিয়ে আলচনা করা দরকার। আমাদের নাট্য কর্মীদের অধিকাংশই নাটক আর থিয়েটারের কোনও প্রভেদ বুঝি না। বুঝলেও নাটকের থেকে থিয়েটারকে অপেক্ষাকৃত বিজ্ঞানস্মত ভাবি। অধিকাংশই ‘নাট্যশাস্ত্রে’র নাম শুনিনি। বা শুনলেও, বেশিরভাগ সেই তিন/চার হাজার বছর আগে লেখা বইটির সমকালীন গ্রহণযোগ্যতাকে স্বীকার করি না।
অনুমান করা যায় নাটকের ধ্রুপদী যুগের শেষে এবং কুতুবুদ্দীন আইবকের পরে সংস্কৃতির অবগুন্ঠনকালে ‘ভরতের নাট্যশাস্ত্র’ বেশ খানিকটা কৌলিন্য হারিয়েছিল। পরবর্তীকালে নাট্যচর্চার পুনরাগমন ঘটলেও, নাট্য শাস্ত্রের অতীত মূল্যায়ন সম্ভবত পুনপ্রতিষ্ঠিত হয়নি। তারপর থেকে গুরুতপূর্ণ গ্রন্থটির উচ্চারণ অনেকক্ষেত্রে অনুক্ত থেকে গেছে। অদ্যাবধি সেই উপেক্ষা আর বিস্মৃতির ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। কারণ কোম্পানী থিয়েটারকালে বাবুরা যেমন এই ‘পঞ্চম্বেদ’কে গুরুত্বহীন ক’রে ইংরাজী থিয়েটারের নকলনবিশী করেছে, তেমনি পরবর্তীযুগে গিরিশ-অমৃতলাল-দীনবন্ধু-শিসির-বিজন-শম্ভুবাবুদের কালেও নাট্যশাস্ত্র অনেকটাই অনালোকিত থেকেছে। এর কারণ আর ফলাফল- দুটিই এখানে আলোচনা জরুরী।
ভারতে থিয়েটার প্রবর্তন করেন কলকাতার ইংরাজি শিক্ষিত বাবুরা। দেশীয় পালা ও নাটকে না গুরুত্ব দিয়ে তারা কিছুটা শ্লাঘার কারণে, নতুন কিছু করার তাগিদে থিয়েটারে মাতেন। অন্যভাবে বলা যায়, দেশী স্বাদগন্ধকে বাতিল করে তারা বিদেশী স্বাদে মজেছিলেন। এর আর একটা দিক হলো, যেটা তাদের আকর্ষণ করেছে, সেটাই সলে নিম্নবর্গীয় সাধারণ মানুষদের দূরে থাকার কারণ।
যে কারণে ভদ্রবাবুদের বিজাতীয় সংস্কৃতিকে এদেশের সাধারণ মানুষ কখনোই প্রহন করতে পারেনি। অনুমান করা যায়, মাটি ছুঁয়ে থাকেন যারা থিয়েটারে তাদের অনুপস্থিতির আসল কারণ এটাই। যদিও আমাদের নাট্যশাস্ত্রে এদের কথা ছত্রে ছত্রে উল্লেখ করা আছে আর সেই শাস্ত্রটিই আমাদের থিয়েটারচর্চার মধ্যে তেমন একটা চর্চিত নয়।
আমাদের থিয়েটার আর নাটকের মধ্যেকার মূল পার্থক্য গড়ে দিয়েছে, ভরতে নাট্যশাস্ত্র’ নামক মহাগ্রন্থাদি নাট্যশাস্ত্রের ‘নাট্যোৎপতি’ নামক প্রথম অধ্যায় ১১২ নম্বর শুটড়ে বোলা আছে ‘লোকবৃত্তানুকরণং নাট্যমেতস্ময়া কৃতম’। যার অর্ত হল লোকসমাজের জীবযাপনকে অনুকরণ করেই সেই সমুদয় সামাজিক ক্রিয়া-প্রতিক্রয়া নাটকের মাধ্যমে মঞ্চে তুলে ধরতে হবে। অনেকে আবার নাট্যবিষয়কে কেবল একটি বিনোদন সামগ্রী হিসেবে ভাবেন। তারা সংকীর্ণ অর্থে, ‘থিয়েটার শুধুমাত্র থিয়েটারের জন্যই’ এই বাক্য বন্ধটিকে ব্যবহার করার চেষ্টা করে থাকলেও নাট্যশাস্ত্র কিন্তু এই তত্বের বিপরীতে অবস্থান করে। যেখানে পরিস্কার বলা হয়েছে, আবিল সমাজের দূষণমুক্তি ঘটাতে নাট্য হলো একটু আয়ুধ। তাই অর্ধেক সমাজকর্ম আর অর্ধেক বিনোদন বা মনোরঞ্জন- এই শর্তেই নাট্যের উৎপত্তি। নাটক একটি অনিবার্য সামাজিক বিনোদন প্রক্রিয়া। অর্থাৎ যারা ভাবেন সমকালের সামাজিক প্রতিফলনের বিষয়টি পরবর্তীকালে প্রক্ষিপ্ত বা যুক্ত, তারা ভুল। বিনোদনের মাধ্যমে পীড়িত সমাজের আরোগ্য নিদানেই নাটকে উৎপত্তি। যার অর্থ হলো, নাট্য আদতে একটি সমাজকর্ম আর সমবেত বিনোদনের যৌথ প্যাকেজ। নাটক যেহেতু একটি সমবেত যাপনধর্মের ফলিত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, তাই সমাজের সব স্তরের আর সকল ধর্মের বা স্বভাবের চরিত্রাবলীর বিন্যাসও এখানে অনিবার্য। সংস্কৃতিগতভাবে মানুষ সাধারণত তিন ধরনের হয়। নাট্যশাস্ত্রানুসারে দেবস্বভাব(উত্তম), নরস্বভাব(মধ্যম) আর অধম(দানব) স্বভাব। এতাদৃশ্য সব চরিত্রই প্রতিফলিত হবে একটি নাটকে, বাস্তবের অনুকরণে। অন্যদিকে সামজিকভাবেই মনুষ্যযাপনেরতিনটি স্তর। যথাক্রমে উচ্চবর্গীয়, মধ্যবর্গীয় ও নিম্নবর্গীয়। এই নিম্নবর্গীয়রা সমাজের আর সভ্যতার পিলসূজ এবং সংখ্যাগুরু বলে এদের ভূমিকার প্রসঙ্গটি নাট্যে ইতীব গুরুত্বপূর্ণ। ফলে এদের প্রতিনিধিত্ব ছাড়া নাট্যই অসম্পূর্ণ। নিচ্র তলার মানুষজনের অংশগ্রহণ ব্যতীত নাটকে ব্যররথতা প্রসঙ্গটি আজ থেকে সাড়ে তিন হাজার বছর আগে যারা বিজ্ঞানসম্মতভাবে উচ্চারণ করেছিলেন, তাদের দূরদর্শিতার কথা যথেষ্ট প্রশংসনীয় তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সদিও সমকালের নিরিখে বিষয়টি অনেকটাই উপেক্ষিত। আর উপেক্ষিত বলেই আমাদের থিয়েটারে নিম্নবর্গীয় তথা সাধারণ মানুষদের কোনও উৎসাহ নেই। এটাই আসলে নাটক আর থিয়েটারের মৌল তফাৎ। নাটকের জন্মলগ্ন থেকেই সাধারণ মানুষ তার অনিবার্য সঙ্গী। অন্যদিকে বাংলা থিয়েটারের শুরু থেকেই তাতে কোনও প্রান্তিক মানুষজনের উপস্থিতি নেই। একদল নব্য ইংরাজী শিক্ষিত বাবুদের বিনোদন-বিলাস মাত্র। আর এটাও ঠিক তারপর থেকে বাংলা থিয়েটারের নানা পটবদল হলেও একমাত্র নবান্নযুগে মাত্র কিছুদিনের জন্য ধুলো মাখা পদাতিকরা থিয়েটারে ভিড় করেছিল। পরবর্তীকালে সেই গণনাট্য তার হৃত গৌরব হারিয়েছে আর আমজনতাও যথারীতি থিয়েটার আন্দোলন থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে।
নাটক যদি একটি সমাজকর্ম হয়, আর সমাজে নিম্নবর্গীয় আমজনতার যদি সংখ্যাধিক্য না হয়, তাহলে সেই আমজনতার অনুপস্থিতিতে কিভাবে নাটক বা থিয়েটার ‘সামাজিক’ হবে? তাই সংস্কৃতিবোদ্ধারা মধ্যবিত্তসুলভ থিয়েটার চর্চা ছেড়ে বারবার আমজনতার কাছে গ্রহণযোগ্য নাট্যচর্চার নদান দিয়েছেন। তাই আপাতদৃষ্টিতে থিয়েটার ও নাটক সমমূল্যের বলে মনে হলেও, আসলে দুই-এর মধ্যে একটি গ্রহণযোগ্যতার ভেদ আছে, অন্তত দেশের সাধারণ মানুষজনের কাছে। তাই নাটক বা থিয়েটার, যাই বলা হোক না কেন, আঙ্গিকে বিষয়ে তাকে সাধারণ মানুষের গ্রহণযোগ্যতা করে পরিবেশন না করলে সেটা হয়তো বিনদনের নিরিখে সুস্বাদু হবে, তবে সমাজকর্মের দায়িত্ববোধে টইটুম্বুর হবে না। আর কে না জানে যে নাট্যশাস্ত্রের শর্তই হলো- সমাজকর্ম আর বিনোদনের নিটোল মেলবন্ধন!
(প্রথম পর্ব শেষ)