Tuesday, October 7, 2025
Tuesday, October 7, 2025
Homeসিনেমাউত্তমকুমারের জীবনের কিছু মুহুর্তকথা

উত্তমকুমারের জীবনের কিছু মুহুর্তকথা

নৈতিক রায়

মৃত্যু- ২৪ জুলাই ১৯৮০  

বাংলার রূপালি পর্দার রূপ কথার নায়ক উত্তমকুমার কেন মহানায়ক। এই বয়ানের সত্যতা যাচাইয়ে গেলে বেশ কিছু তথ্য উঠে আসে। যা কি না তার মহানত্বকে নির্দেশ করে। তিরোধানের ৪৫ বছর অতিক্রান্ত তবু তিনি বাঙালি মনে স্বমহিমায় সেই রূপকথায় নায়ক হয়েই রয়েছেন। শুধু কি সৌন্দর্য! শুধু কি বাচন ভঙ্গিমা! শুধু কি নিজেকে উপস্থাপনের কৃতিত্ব? নাকি তাকেও ছাপিয়ে গিয়ে আলাদা কিছু।     

টলিউডের পরিসরে আজও কান পাতলে শোনা যায়, সেই সব মহানন্ত্বের কাহিনী, যা কি না সময়ের সাথে সাথে আমরা আমাদের সংস্কৃতির ধারায় নিবন্ধ করে নিয়েছি। আজ আমরা বাজার সংস্কৃতির আবহে এই মহানত্ব নির্মাণের নানা খেলা লক্ষ্য করে থাকি। কিন্তু মহানায়ককে কোনওদিন এই খেলায় মাততে হয় নি। বরং তার সেই পরোপাকারের কীর্তির কথা গোপনই থাকতো। উপকৃত জনের থেকে আমরা পরবর্তীকালে সেই সব রূপকথার গল্পকথা জানতে পারি। হ্যাঁ রূপকথা বলার কারন, আজ এইসব ঘটনাবলী প্রায় অচল, অসম্ভব ও অত্যাশ্বর্য এক বিষয়।   

উত্তমকুমারের একটা ডায়েরী থেকে পাওয়া গিয়েছিল। তিনি কাকে কখন কত টাকা দান দিয়েছিলেন। হিসেব করে দেখা গেছে তার পরিমাণ সেইসময় পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকা হবেই, এমনই দাবী করেন তার ভাই তরুন কুমার। যা দান হিসেবে গেছেন। এ বিশয়ে উত্তমকুমার বলতেন- ‘দান করে দাতা হতে নেই, এতে তমভাব আসে। দান করে বলতে নেই, আমি অমুককে এতো টাকা দিয়েছি। দানের ব্যাপারতা সবসময় গোপন রাখতে হয়।’       

আজ তাঁর প্রয়াণ দিবসে কথাগুলো আবারও স্মরণ করা সকল অভিনেতার কর্তব্য হওয়া উচিত বলে মনে করি। ঘটনাবলীর স্থান কাল পাত্রের সত্যতা বহুবার, নানাভাবেই যাচাই হয়ে গেছে। তার অটোবায়োগ্রাফির অনেক কথাই আজ জনশ্রুত।

স্ক্রিপ্ট রাইটার গৌড় শী ওর তাঁর সঙ্কট

যমালয়ে জীবন্ত মানুষ ছবির লেখক গৌড় শী, তিনি একজন অভিনেতাও ছিলেন। একদিন একটা শ্যুটিং এ বারবার ডায়লগ ফেল করছেন- তখন উত্তমবাবু তাঁর কাছে গিয়ে জানতে চাইলেন তাঁর অন্যমনস্কতার কারণ, আর গৌড় বাবুর থেকে উত্তমকুমার জানতে পারলেন, তাঁর মেয়ের বিয়ে, তাই দুহাজার টাকার তাঁর খুব দরকার। তিনি টাকা যোগাড় করতে পারেন নি।  উত্তমবাবু তাকে আলাদা করে ডেকে, একটা খাম দিয়ে বলেছিলেন- গৌড়দা এটা আপনি এখানে খুলবেনও না, কাউকে বলবেনও না। আপনি এটা নিয়ে চলে যাবেন।’ গৌরবাবু যথারীতি বাড়ি ফিরে খাম খুলে দেখছেন, তাতে পাঁচ হাজার টাকা। গৌড়বাবু চমকে ওঠেন, তাঁর তো দুই হাজার দরকার ছিল, কিন্তু পাঁচ হাজার কেন? তিনি মনে করেছিলেন, উত্তমবাবু নিশ্চই ভুল করে এই টাকাটা তাকে দিয়েছেন। সাথে সাথে তিনি পাড়ার এক জায়গা থেকে তাঁর ফোন নাম্বারে ফোন করেন, তাঁকে জানালেন, উত্তম আমি তো দুই হাজারের কথা বলেছিলাম, তুমি এখানে পাঁচ দিয়েছো যে। উত্তমবাবুর সটান উত্তর ছিল- ‘না আমি পাঁচই দিয়েছি, আপনি আপনার দরকারের দুই হাজার নেবেন, আর তিন হাজার টাকা দিয়ে আপনার মেয়েকে কিছু একটা কিনে দেবেন। ওটা আমার তরফ থেকে।’     

রানী মহালানবিশ ও বকেয়া ইলেকট্রিক বিল

প্রশান্ত মহালানবিশকে সকলেই চেনেন। একজন পরিসংখ্যানবিদ। তিনি মারা যাবার পর তাঁর স্ত্রী রানী মহালানবিশ এক সংকটে পড়েছিলেন। সেইসময় তাঁর বাড়ির টেলফোনের বিল বকেয়া হয়ে গিয়েছিল, প্রায় পাঁচ হাজার টাকা। সময়টা ৭৮ সালের আগে পরে হবে। উত্তমবাবু সেই খবরও রাখতেন। তাই সেই খবর পাওয়া মাত্র তিনি টাকাটা দিয়েছিলেন।   

কমেডিয়ান সুশীল দাস ও তাঁর রোজকার ফন্দি       

কমেডিয়ান সুশীল দাস। অনেক বাংলা ছবিতে অভিনয় করেছেন। ভবানীপুরে থাকতেন। আর প্রায়ই ময়রা স্ট্রীটে যেতেন, আর উত্তমকুমারের থেকে নানান অছিলায় টাকা চেয়ে নিয়ে আসতেন। একদিন এরকমভাবে টাকা নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামছিলেন, তখন উল্টোদিক থেকে সিঁড়ি বেয়ে, তরুন কুমার উপরের দিকে উঠে আসছিলেন, তাকে দেখা মাত্র সুশীল দাস হাতের টাকাটা লুকিয়ে ফেলেন। কিন্তু তরুনকুমারের চোখ সেটা এড়াতে পারেনি। সে তখন তাকে কিছু না বলে, উপরে গিয়ে দাদাকে সেই টাকার কথা বললেন। বেশ অনুযোগের সুরেই। উত্তমবাবু বললেন- ‘কি করবো, ও বলল বোনের বিয়ে।‘ তরুনবাবু বললেন- ‘সেকি ওর কোনও বোনই নেই’। উত্তমবাবু সাথে সাথে বললেন- ‘সে তো আমিও জানি’।  

ইসমাইল ও কানাই –এর ভুলের পরিণতি   

হারানোর সুর ছবির টানা দু দিনের শ্যুটিং করার পর, লাঞ্চ ব্রেকের সময়, উত্তমকুমার  পরিচালক অজয় করকে জানালেন- ‘অজয়দা কালকে শটগুলো রিটেক করা যায় না?’ অজয় কর স্বভাবতই অবাক হয়ে গিয়ে বলেন, ‘বলেন কি মশাই রিটেক’? উত্তমকুমার বললেন, ‘হ্যাঁ আমার মনে হচ্ছে, আমি বোধহয় সুবিধা করতে পারিনি। মনে হচ্ছে রিটেক করলে বেটার হবে’। অজয় কর বেঁকে বসলেন, তিনি উত্তমকুমারের অভিনয় সম্পর্কে জানালেন, সে অনেক ভালো অভিনয় করেছেন। রিটেকের কোনও দরকারই নেই। উত্তমকুমার নাছোড়বান্দা। অনেক চাপান উতরের পর উত্তমবাবু সরাসরি বলে বসলেন, ‘ঐ শটগুলি রিটেকের ব্যবস্থা করুন’। অবশেষে রিটেকের সিদ্ধান্ত হল। এখন প্রশ্ন কেন এই রিটেক? আসলে রিটেক না হলে ইসমাইল ও কানাইকে উত্তমকুমার কিছুতেই বাঁচাতে পারতেন না। এরা কারা? এরা হলেন এই ছবির ক্যামেরা সহযোগী। তাঁরা আগের দিন শ্যুটিং এ ক্যামেরা চালু করেছেন, কিন্তু সাউন্ড অপশন বন্ধ রেখে দিয়েছিলেন। যার ফলে ছবি উঠেছে, কিন্তু সাউন্ড ট্রাক আসেনি। পুরো রিল জুড়ে মিউট করা ছবি। এই সাংঘাতিক ভুল যা পরিচালক অজয় করের কাছে গিয়ে স্বীকার করে নেবার সাহস তাঁদের ছিল না। তাই তাঁরা গেলেন উত্তমকুমারের কাছে। সেখানে যাওয়াটাই শ্রেয় মনে করলেন। ঘটনাচক্রের ছবির প্রযোজক স্বয়ং উত্তমকুমার। নিয়ম অনুযায়ী তাঁর রেগে ওঠার কথাই ছিল। কিন্তু না। তিনি এই বিষয়টিকে অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় সামলে নিয়ে ইসমাইল আর কানাইকে সেই যাত্রায় রক্ষা করলেন। এই প্রসঙ্গে তাঁর আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছিলেন- ‘সেদিন ঐ ছবির প্রযোজক হিসেবে আমার উত্তেজিত হবারই কথা ছিল। তা হইনি। হতে পারিনি। ভুল তো মানুষই করে। তার জন্য ‘সাফার’ তো ওরা করবে না। অগত্যা সব দোষ স্বীকার করে, অজয় করকে সট-গুলো রিটেক করতে বাধ্য করলাম। একজন  টেকনিশিয়ানের মন দিয়ে সেদিন ওদের দেখেছিলাম, এ আমার নৈতিক কর্তব্য মাত্র’।       

পাহাড়ি সান্যাল ও সুপারিশ

পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় এর ছবি ‘নতুন জীবন’ ছবির কাজ শুরু করেছেন। উত্তম কুমার তখন প্রতিষ্ঠিত অভিনেতা। তিনি একদিন নিজে থেকেই অরবিন্দবাবুর কাছে গিয়ে বললেন- ‘আমাকে এই ছবিতে একটা রোল দিতে পারেন’? অবাক হয়ে অরবিন্দবাবু বললেন, ‘তুমি ডেট দিতে পারবে’? মৃদু হেসে উত্তম বললেন- ‘আমাকে নয় পাহাড়ি দাকে দিন। ওর সময়টা না ভালো যাচ্ছে না’। অরবিন্দবাবু উত্তমকুমারের এই অনুরোধ রেখেছিলেন, এই ছবিতে নায়িকার বাবার ভূমিকায় পাহাড়ি সান্যালকে নিয়েছিলেন। এরপর বিশ্বরূপা থিয়েটারের কর্মকর্তা, রাসবিহারী সরকারকে বলে স্টেজে পাহাড়ি সান্যালের জন্য একটা ভালো মাইনের কাজের ব্যবস্থাও তিনি করে দিয়েছিলেন।     

মেকাপ ম্যানের মেয়ের বিয়ে  

একদিন স্টুডিওতে মেকাপ রুমে মেকাপ করতে করতে উত্তমকুমার লক্ষ্য করলেন, মেকাপ ম্যানের মুখটা খুব শুকনো। চিন্তিত। উত্তমকুমার তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, – ‘কি ব্যাপার রে? মুখ ভার করে আছিস কেন? কি হয়েছে আমায় বল’। মেকাপম্যান বললেন, ‘মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে দাদা, কিন্তু পণের পাঁচ হাজার টাকা কম পড়েছে’। টাকাটা জোগাড় করবো কিভাবে ভেবে পাচ্ছি না। উত্তমকুমার স্বস্নেহে গায়ে হাত বুলিয়ে বললেন, ‘কিচ্ছু ভাবিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে’। বিয়ের আগের দিন উত্তমকুমার তাঁকে সেই পাঁচ হাজার টাকা একটা খামে করে দিয়েছিলেন।      

অভিনেত্রী আরতি ভট্টাচার্য্য ও স্পর্ধার স্বর       

আরতি ভট্টাচার্য রাজবংশ, জাল সন্যাসী, স্ত্রী, নিশান ইত্যাদি বহু ছবিতে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। সলিল দত্তের পরিচালনায় স্ত্রী ছবির শ্যুটিং -এর প্রথমদিনেই ঘটে গেল অঘটন। স্বয়ং উত্তম কুমারের সাথে। সেসময় তিনি মহানায়ক। আর আরতি দেবী সবে শুরু করেছেন। সকাল থেকে স্টুডিওতে মেকাপ নিয়ে আরতি ভট্টাচার্য বসে আছেন, মহানায়কের দেখা নেই। তিনি এলেন বেলা ১২টার পর। ততক্ষণের সেদিনের শ্যুটিং সিডিউলের যাবতীয় সংলাপ তিনি মুখস্থ করে ফেলেছেন। অনেকক্ষণ পরে উত্তমকুমার জমিদারের সাজে সেটে  এলেন, আরতি ভট্টাচার্য তাঁকে দেখে বিমোহিত। মুগ্ধ। পরিচালক দুজনের মধ্যে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আরতি দেবী প্রণাম করলেন। শুরু হল শুটিং, এদিকে শ্যুটিং এ আরতি দেবীর সংলাপগুলো সব শুনে, উত্তমবাবু পরিচালককে, কিছু সংলাপ বাদ দিতে বললেন, কিন্তু আচমকা বেকে বসলেন আরতি দেবী। পরিচালক, সলিল বাবুকে উদ্দ্যেশ্য করে তিনি বলে উঠলেন, ‘বাহ রে, আমি এতো কষ্ট করে সকাল থেকে ডায়লগ মুখস্থ করলাম, শেষে আমার কথাগুলো বাদ দিয়ে দেবেন’?

সেটে যেন বাজ পড়লো- নতুন মেয়ের এতো স্পর্ধা! সেট থেকে সোজা বেড়িয়ে গেলেন মহানায়ক। আর এর ফলে সবার রাগ গিয়ে পড়লো, আরতি দেবীর ওপর। সবাই তাঁকে বললেন- ‘আপনি এভাবে কথাটা বলে ঠিক করেননি’। আরতি দেবীরও জেদ চেপে বসেছে। তিনি বললেন, ‘কেন? সলিল দা নিশ্চই কিছু ভেবে এই ডায়লগগুলি লিখেছিলেন, এখন উত্তমবাবু এসে বাদ দিতে বললে, বাদ দেওয়া হবে কেন’? এদিকে পাশের ঘরে বসে, সাউন্ড ট্র্যাকে আরতি ভট্টাচার্যের সমস্ত কথা শুনে ফেলেছেন উত্তমকুমার। কিছুক্ষণ পরে তিনি সেটে ফিরে এসে, আরতি ভট্টাচার্যকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কথাগুলো কিভাবে বলতে চাও? শোনাও তো দেখি’। আরতি দেবী ডায়লগ শোনালেন। উত্তমকুমার পরিচালককে শটটা টেক করতে বললেন। এরপর সারাদিন শ্যুটিং চলল। তবে আরতি ভট্টাচার্যের সঙ্গে একটা কথাও বললেন না, মহানায়ক। শ্যুটিং প্যাক আপ হওয়ার পর আরতি ভট্টাচার্য মন খারাপ করে বসেছিলেন। সেই সময় মেকাপ রুমে স্বয়ং উত্তমকুমার হাজির হলেন। আরতি ভট্টাচার্যের মাথায় হাত রেখে তিনি বললেন- ‘আজ পর্যন্ত উত্তম কুমারের মুখের ওপর কেউ সাহস করে কথা বলতে পারেনি। কিন্তু আজ তুমি যে গার্ডস দেখিয়েছো, তাতে আমি অভিভূত। আমি আশির্বাদ করছি, তুমি অনেক উন্নতি করবে’। সেদিন উত্তমকুমারের কথা শুনে আরিতি দেবীর দুচোখে জলের ধারা নেমেছিল। উত্তমকে প্রণাম করে আরতি বলেছিলেন- ‘আমাকে ক্ষমা করবেন’। উত্তমকুমার উত্তরে বলেছিলেন, ‘তোমার এই সরলতা মুছে যেতে দিও না কোনদিন’।           

তরুণ মজুমদার ও পলাতক       

এরপর পরিচালক তরুণ মজুমদার। তখন ‘পলাতক’ চিত্রনাট্য লিখেছেন। তাঁর সেই চিত্রনাট্যের কথা স্টুডিওপাড়ায় ছড়িয়ে পরে। প্রযোজক অসিত চৌধুরী তরুণবাবুকে তাঁর অফিসে ডেকে পাঠালেন। পরদিন তরুণ মুজমদার প্রযোজকের কাছে উপস্থিত হলেন। সেখানে অসিত চৌধুরী সাথে উপস্থিত রয়েছেন স্বয়ং উত্তমকুমার। সেই বৈঠকে তরুণবাবু তাঁদেরকে চিত্রনাট্য পড়ে শোনালেন। পড়া শেষ হলে উত্তম বাবু তাঁকে জানালেকে’দারুণ হয়েছে আপনার চিত্রনাট্যটি’। এরপর সেদিন বিকেলে, প্রযোজক অসিত চৌধুরী আবার তরুণবাবুকে ফোন করলেন। বললেন- চিত্রনাট্যটি শুনে উত্তমকুমার দারুন মুডে রয়েছেন, তিনি বলেছেন, দু একটা সিন এদিক ওদিক করে নিলেই, অভিনয়ে তাঁর ভীষণ জোশ আসবে। এই কথা শুনে তরুণ মজুমদার চুপ করে গেলেন। কি বলবেন বুঝে পাচ্ছিলেন না। আসলে এই লিডিং চরিত্রটি অনুপকুমারকে ভেবে লেখা। সেখানে উত্তমকুমারকে দিয়ে করবে্ন কি করে? দ্বোটানায় পড়লেন। অবশেষে তিনি উত্তমকুমারকে সব কিছু খুলে বললেন। ইতস্তত অবস্থা দেখে, উত্তমবাবু উঠে এসে বললেন, অতসব ভাববেন না আপনি, আমি অসিতবাবুকে সব বুঝিয়ে বলব। আপনি এগিয়ে চলুন। তারপর সেই ছবি তো ইতিহাস। পরবর্তীকালে, উত্তমকুমার অকাল প্রয়াণের পর তাঁর স্মৃতিতে এই কথা স্বীকার করে বলেছিলেন- ‘উত্তমকুমারের জায়গায় সেদিন অন্য কেউ থাকলে, সেদিন তাঁকে কী অপদস্তই না হতে হত’!     

‘কামনা’ ছবির নায়িকা ছবি রায়, উত্তমের ছবি দি   

নায়কের ভুমিকায় উত্তমকুমার প্রথম অভিনয় করেছিলেন, ‘কামনা’ ছবিতে। নায়িকা হিসেবে সেই ছবিতে ছিলেন, নিউ থিয়েটার্স-এর পেশাদার অভিনেত্রী ছবি রায়। উত্তমকুমারে থেকে সাত আট বছরের ছোট ছিলেন। কিন্তু অভিনয় জগতে তিনি তাঁর থেকে সিনিয়র ছিলেন বলেই, উত্তমকুমার তাঁকে ’ছবিদি’ বলেই ডাকতেন। সেসময় উত্তমকুমারের জীবনে একটি অপমান জনক ঘটনা ঘটেছিল। ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে যে ফ্লোরে কামনা ছবির শ্যুটিং চলছিল, তার পাশের ফ্লোরেই চলছিল, ‘দেবী চৌধুরানী’ ছবির শ্যুটিং। সেই সময় সেই ছবিতে শ্যুটিং করছিলেন, প্রদীপ কুমার, যার ডাকনাম ছিল শেতল দা। উত্তমকুমার দু-একবার এই শেতলাদার সাথে এমেচার থিয়েটারে নাটক করেছিলেন। সেই সূত্রের ছবি রায়ের অনুমতি নিয়ে একদিন উত্তমকুমার, পাশের ফ্লোরে শেতলদার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন, কিন্তু সেখানে তিনি  নিদারুণ এক ধাক্কা খেলেন। তিনি সেখানে গিয়ে প্রদীপকুমারকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘শেতল দা কেমন আছেন’? প্রদীপকুমার কথার উত্তর না দিয়ে উলটে বললেন, ‘তোমাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না’? উত্তমকুমার ভীশণ দুঃখ পেয়েছিলেন। লজ্জা আর অপমান নিয়ে ফিরে  এসেছিলেন, ছবি রায়ের কাছে। সব শুনে ছবি রায় বলেছিলেন- ‘অরুন দুখ কোরোনা, এটাই তো হয়। এখানে অপমানের কিছুই নেই। একদিন যারা বিখ্যাত হয়, তারা পুরোনোদের মনে রাখে না। এই যেমন তুমি, একদিন আমাকে ভুইলে যাবে। তুমি অনেক বড় হবে অরুণ। তখন এই ছবিদিকে তুমি চিনতেই পারবে না। উত্তমকুমার তাঁকে বাঁধা দিয়ে বলেছিলেন, ‘না না ছবি দি, তুমি দেখে নিও, আমি তোমায় ভুলবো না কোনওদিক’। তারপর ছবিদি হাসতে হাসতে বলেছিলেন- ‘ঠিকাছে, আমিও দেখবো। তোমার পাতা চাপা কপাল, আর আমার পাথর চাপা। একদিন দেখবে, সেই পাতা উড়ে গিয়ে তুমি মস্ত বড় হিরো হবে। আর আমি পাথর চাপা  হয়েই পড়ে থাকবো।‘

তার সেই কথাকে উত্তমকুমার ভুল প্রমান করেছিলেন। একদিকে ছবিদির কথা যেমন ঠিক হয়েছিল, পাতা সরে গিয়ে তিনি মহানায়ক হয়েছিলেন। কিন্তু  ছবিদিকে ভুলে যাওয়া, না। এই ঘটনার ১২ বছর পর, যখন উত্তমকুমার জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। আর নায়িকা ছবি রায় কোথায় হারিয়ে গেছেন। একদিন ছবি রায় বাসে করে হাতিবাগান থেকে ধর্মতলার দিকে যাচ্ছিলেন। জানালার পাশেই বসে ছিলেন। হঠাত তিনি লক্ষ্য করলেন, একটা গাড়ি, খুব কাছ থেকে জো্রে জোরে হর্ন বাজাচ্ছে। তিনি বাজে লোকের কীর্তি ভেবে গুরুত্ব দিলেন না। কিন্তু সিগনালে গাড়ি থামতেই, ছবি রায় টের পেলেন সেই গাড়ি থেকে কে যেন তার নাম ধরে ডেকে উঠলো। নিজের নাম শুনে গাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন, উত্তমকুমার। এক গাল হাসি দিয়ে তাঁকে বাস থেকে নেমে আসতে বলছেন। ছবি রায়ও নেমে পড়লেন। গাড়িতে বসতেই, উত্তমকুমার হাসতে হাসতে বললেন, ‘তোমাকে দেখতে পেয়ে কতক্ষণ ধরে হর্ণ দিচ্ছি, তুমি তাকাচ্ছই না? শেষে তোমার নাম ধরে ডাকলাম। দেখলে তো কতবছর হয়ে গেল, তবুও তোমায় ভুলিনি’। ছবি রায় অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। স্মৃতিচারনায় ছবি রায় বলেছিলেন, প্রয়াণের পর একদিন তিনি নাকি উত্তমকুমারকে স্বপ্নে দেখেছিলেন। তিনি তাঁর কাছে সে বলেছিলেন, ‘খুব খিদে পেয়েছে ছবিদি, কিছু খেতে দাও’। ঘরে তখন কিচ্ছু নেই। শুধু আম আর মিষ্টি। তাই দিলাম। তৃপ্তিভরে খেল। পরে চলে যেতে যেতে বললো, ‘দেখলে তো ছবি দি, মরণের পরও তোমায় ভুলিনি’।           

‘জীবন মৃত্যু’র শ্যুটিং ও সরকারী ডাকবাংলো    ‘  

জীবন মৃত্যু চলচ্চিত্রে শ্যুটিং হচ্ছে। এই সিনেমার লিড কাস্টিং উত্তমকুমার ও সুপ্রিয়া দেবী। শ্যুটিং এ তাঁদের বিশ্রামের জন্য ঠিক করা হয়েছে সরকারী ডাকবাংলো। উত্তম কুমার সেখানে গিয়ে অন্যান্য অভিনেতা অভিনেত্রীদের না দেখে, প্রযোজককে বললেন, ‘না না, শুধু আমরা কেন? বাকীরা কোথায়? এখানেই সবাই থাকুক’। প্রযোজক বললেন- ‘তাতে তো বহু খরচ’। তাছাড়া… উত্তমকুমার বলে উঠলেন, ‘তাহলে আমায় ছেড়ে দিন মশাই। আমি এই ছবিতে অভিনয় করবো না। যেখানে শিল্পী বলতে শুধুমাত্র প্রধান চরিত্রকে ধরা হয়। সেখানে মনে হয় না, আমার অভিনয় করা উচিত’। এই কথাতেই কাজ হোল। প্রযোজক সবার জন্য ব্যবস্থা করেছিলেন। দুপুরের আহারটাও সবাই একই সঙ্গে খেয়েছিলেন।  

রাজ্যপালের আমন্ত্রণ বনাম লাইট ম্যান কালীর মেয়ের বিয়ে    

একবার পশ্চিম্বঙ্গের তৎকালীন রাজ্যপাল হরেন্দ্র কুমার মুখোপাধ্যায় একটি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, উত্তমকুমারকে। ভাই তরুণ কুমারকে নিয়ে সেই নিমন্ত্রণে যাচ্ছেন। পথে যেতে যেতে মনে হল, তাঁর একটা ভুল হইয়ে গিয়েছে। রাজ্যপালের বাড়ির সামনে থেকে গাড়ী ঘোরাতে বললেন, ড্রাইভারকে। পাশে বসে থাকা তরুণকুমার বললেন, ‘তোমার হুঁশ থাকে না, নিশ্চই কিছু ফেলে এসেছো? আমি আগেই জানতাম’। উত্তম বললেন, ‘একবার টালিগঞ্জ যেতে হবে, জরুরী দরকার’। গাড়ি গেল টালিগঞ্জ। কেন? আসলে তিনি গিয়েছিলেন, লাইটম্যান কালীর বাড়িতে, কালীর মেয়ের বিয়ে খেতে।      

পশ্চিমবঙ্গের বন্যায় মহানায়কের অবদান      

পশ্চিমবঙ্গে দু-দুবার বন্যায় উত্তমকুমার পথে নেমেছিলেন। একবার ১৯৬০ সালে পথে নেমে চাঁদা সংগ্রহ করেছিলেন। আর নিজেও সাহায্য করেছিলেন। এরপর ১৯৭৮ সালে আরও একবার ভয়ংকর বন্যায় পথে নামেন উত্তম কুমার। কিন্তু যথেষ্ট টাকা না ওঠায় তিনি একটি ক্রিকেট ম্যাচের আয়োজন করেন। ১৯৮৯ সালে বম্বের তারকাদের আমন্ত্রণ জানান। টলিউড ও বলিউডের ক্রিকেট ম্যাচ, যেখানে উত্তম নেতৃত্ব দেন, বাংলাকে। আর দিলীপ কুমার নেতৃত্ব দেন, বম্বেকে। এই ম্যাচ থেকে বিপুল টাকা উঠে আসে। যা তিনি তুলে দিয়েছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে।  

শেষ কথা     

উত্তমকুমার নিজে বেশীদূর পড়াশুনা না করতে পারায় আক্ষেপ ছিল তার সবসময়। তিনি চাইতেন দেশের ছেলেমেয়েরা যেন উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়। তার জন্য অনেক গরীব বাচ্চাদের স্কুলের বই কিনে দিয়েছিলেন। ১৯৬৮ সাথে দুস্থ শিল্পীদের সাহায্যার্থে গড়ে তুলেছিলেন, শিল্পী সংসদ। এরই ব্যানারে বন পলাশীর পদাবলী নির্মান করেছিলেন, যা থেকে বিপুল অর্থ উঠে এসেছিল, যে অর্থ দুস্থ শিল্পীদের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছিলেন।

একজন মানুষ বড় হন তাঁর কাজে। উত্তমকুমারের কাজ ছিল অভিনয়। যে অভিনয় আজও বাংলা তথা দেশে বিদেশে সমাদৃত। নিজেকে অভিনয়ের এক শিখরে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন এই উত্তমকুমার। কিন্তু অভিনেতা উত্তম আর মানুষ উত্তম এই বিভাজনের মাঝে এসে আমাদের থমকে যেতে হয়। তাঁর ব্যাবহারিক কাজেও তিনি তার মহানত্ব দেখিয়েছেন। বহু ঘটনার সমাবেশ ছিল তার জীবনে। তা থেকে মাত্র ১২ টি ঘটনার উল্লেখ থাকলো এখানে। এবার এখন শিল্পীর সামাজিক দায়বদ্ধতার হিসেবটা মেপে নেওয়া আপনাদের ভাবনা।  

RELATED ARTICLES
- Advertisment -

Most Popular