নিজস্ব প্রতিনিধি
সম্প্রতি মিনার্ভা থিয়েটারের সামনে উৎপল দত্ত নামাঙ্কিত স্মরণিকা ভাঙ্গা অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। সেই ছবি সোস্যাল সাইটে আসার সাথে সাথে নাট্যমহলে তীব্র ক্ষোভের জন্ম হয়। সেই ক্ষোভের আকার বাড়তে বাড়তে গত রবিবার মিনার্ভার সামনে গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘ ও পিএলটি-র আহবানে বামপন্থী কর্মী সমর্থকদের সমাবেশে এক প্রতিবাদ সভা হয়ে গেল। প্রাথমিকভাবে সভা সফল এবং তা আগামীদিনে এক আন্দোলনের রূপ নিতে পারে বলে একাংশ মনে করছেন। সেই সভায় নাট্য ব্যক্তিত্বদের অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। যেমন অশোক মুখোপাধ্যায়, পঙ্কজ মুন্সি, অসিত বসু, রজত ঘোষ, কুন্তল মুখোপাধ্যায়, বিমল চক্রবর্তী, সীমা মুখোপাধ্যায়, মৈনাক সেনগুপ্ত, দেবদূত ঘোষ, সৌরভ পালধি প্রমুখ।
মিনার্ভা থিয়েটারের সঙ্গে উৎপল দত্তের সম্পর্ক কারোরই অজানা নয়। আর বাংলা থিয়েটারে এই মানুষটার অবদান আপামর বাঙালী ও ভারতবাসীর কাছে আদরণীয় হয়ে থাকা এক নাম। ফলত এরকম একটা সংবাদ নাট্যমহলে তীব্র ঘৃণা ও প্রতিবাদের জন্ম নেবে এটা আশ্চর্যের নয়। বিগত বামফ্রন্ট সরকার মিনার্ভা থিয়েটারের সঙ্গে উৎপল দত্তের পথচলাকে আগামীর কাছে স্মরণীয় করে রাখতে ২০০৫ সালে কলকাতা পুরসভার উদ্যোগে মিনার্ভা থিয়েটার সংলগ্ন রাস্তার নামকরণ করেছিল ‘উৎপল দত্ত সরণি’। রাস্তায় ভাঙা ফলকে আর একটি নাম ছিল। তিনি তৎকালীন বাংলা মেয়র বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য। এই ফলক উপড়ে ফেলার কারন হিসেবে যা উঠে আসছে তা হল, সরকার পক্ষ সেখানে একটা স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ে তুলছেন, সেই কাজের সুবাদে তারই অনতিদূরে থাকে ফলকটিকে তুলে রাস্তার পাশে ফেলে রাখা হয়েছিল।

এক সরকার ফলক বানায়, আর আরেক সরকার এসে তা উপড়ে ফেলে। অর্থাৎ আগের সরকারের কর্মকান্ড তাঁরা জনসমক্ষে রাখতে চান না। আর এর প্রমাণ কি নাট্যকর্মীরা আগে কখনও দেখেন নি? কলকাতা রাতারাতি নীল সাদা হয়ে গেল, দেখেন নি? ত্রিফলা আলোয় লন্ডন হল, দেখেন নি? অনেক স্টেশনের নাম পাল্টে ফেলা হল, দেখেননি? সরকারি দপ্তরের খোল নলচে বদলে ফেলা হল, দেখেননি? নাট্য আকাদেমি নামক দপ্তরে সরকারের প্রিয় পাত্ররা স্থান পেল, জানেন না? সরকারী হল পেতে নানান ফন্দি ফিকির আঁটা হয়েছে, জানেন না? ইতিহাস পাল্টে এমিউজমেন্ট ট্যাক্স এক থেকে দশ, তারপর পঞ্চাশ, তার ওপর যদি দলের কাছে বর্তমান সরকারের অনুমোদন না থাকে তাহলে নির্দিষ্ট হলের নির্ধারিত ট্যাক্স দিয়ে শো করা নির্দেশিকা চালু হল। জানতেন না?
আসলে কোনও কিছুতেই নাট্যকর্মীরা কিচ্ছু বললেন না। মেনে নিলেন। এই মেনে নেবার নেপথ্যে এক অলিখিত সত্য আছে, যা কি না নাট্যমহলে কানাঘুষোয় অনেকেই জানেন। অর্থাৎ সুবিধা পেয়ে যাবার সম্ভবনা। এতো রাষ্ট্রীয় চাল। আগে হয়তো রেখে ঢেকে হোত, এখন নির্লজ্জের মতো হচ্ছে। বছরে পঞ্চাশ হাজার টাকা পাইয়ে দেবার একটা সুযোগ করে দিয়েছেন সরকার। সেই টাকা কাদের দেওয়া হবে? দিলে কি করতে হবে? আর টাকা নিয়ে বিরুদ্ধাচারন করলে কি হবে সব, সব জলের মতো পরিস্কার নাট্যমহলে। কিন্তু ঐ যে- ‘কথা বোলো না, সব্দ কোরো না।’ আর এরকমই এক সন্ধিক্ষণে গায়ে হাত পড়লো উৎপল দত্তের ওপর।
একটু পিছিয়ে যান, একসময় পাড়া কাঁপিয়ে তৎকালীন সরকারের পর্দাফাই করে ‘উইংকল টুইঙ্কল নাট্য’ পরিসরে জায়গা করে নিয়েছিল। তারপর আর একটি নাটক যা উৎপল দত্তের লেখা, যা কিনা হুবহু কপি করে অন্য নাম দিয়ে, উৎপল দত্তের নাম উল্লেখ না করেই বিজ্ঞাপিত হয়েছিল, যে শো এর উদ্বোধনে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং উপস্থিত থেকে উদ্বোধন করেছেন। পরে একটা সংবাদপত্রে সেই কথা প্রকাশ হওয়ায় হৈ হৈ রৈ রৈ করে বামপন্থীরা ক্ষণস্থায়ী প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্তু তাতে সেই নাটকের শিরোনামে কি তাঁর নাম রাখা হয়েছিল? সেও তো এক ইতিহাস। আসলে রাজা বা রাষ্ট্র ক্ষমতা সব সময় স্বাপত্যের নিদর্শন রেখে যান। আর সেই সুবাদেই তৎকালীন বামপন্থী সরকারও স্বনাম প্রচারে বিরত থাকেন নি। (থাকা যেত, যেহেতু নিজেদের বামপন্থী দাবী করি)। হ্যাঁ এটা ঠিক সরকারী যে কোনও কাজে উদ্বোধনের ফলকে সরকার পক্ষের নাম থাকবে, থাকাই ন্যায্য। কিন্তু রাস্ট্র ক্ষমতায় বামফ্রন্ট কিন্তু কোনওভাবেই আলাদা নিদর্শন স্থাপন করতে পারেননি।
সে যাই হোক, তাই বলে বর্তমান সরকারের এই দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজের তীব্র ধিক্কার জানাবার কোনো প্রশ্নই ওঠেই। বরং এই প্রতিবাদ আবার প্রমাণ করে, বামপন্থীরা তাদের মননশীল জগতে এখনও অনেকটাই একই রকম আছেন।
তা না হলে এক শহীদ স্মৃতির মোচ্ছবের প্রাক্কালে, ঠিক আগের দিন মিনার্ভার সামনে এরকম একটা জমায়েত হতে পারে! জমায়েতে সকল বক্তাই কমবেশি তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ জানান।
সভায় উপস্থিত নাট্যকার নির্দেশক অভিনেতা অশোক মুখোপাধ্যায় তাঁর স্বভাব ঢং এ ক্ষোভ উগরে দেন। তিনি বলে ‘…এমন দিন আর দূরে নয়, যে আমাদের যেটুকু কথা বলা স্বাধীনতা আছে সেটাও বন্ধ হয়ে যাবে। যার গায়ে তাঁরা হাত দিয়েছেন, তাঁকে আমাদের দেশের, আমাদের থিয়েটারের, আমাদের রাজনীতি থেকে মুঝে ফেলা বা অবহেলা করার ক্ষমতা কারোর নেই, কারণ সেটা ইতিহাসের বিপক্ষে যাওয়া হবে।’ তিনি মনে করেন গিরিশ চন্দ্র ঘোষের পরে এতো বড় নাট্য প্রতিভা আমাদের থিয়েটারে আমরা আর দেখা যায় নি। প্রতিরোধ শক্তি গড়ে তোলার কথা বলে। আর সেটাই হবে আসল লড়াই। এসবের কারণ হিসেবে তিনি সোচ্চার কন্ঠে বলেন- ‘তৃণমৌলিক যে অসভ্যতা, আমরা দেখছি, যারা কোনও কিছু মানে না, বোঝেন না, কোন মতাদর্শগত ভিত্তি নেই, যাদের কাজ হচ্ছে কোনও রকমে সারভাইব করা। এরকম একটা শক্তির সাথে লড়াই করতে গেলে আমাদের সাবধান হতে হবে, আমাদের ক্ষমতাকে বাড়াতে হবে।
বর্তমানে সরকার পক্ষে নাট্য মহলে উৎপল দত্তের নাট্য নির্মানের, বলা যেতে পেরে হিরিক পড়েছে। যেখানে উৎপল দত্তের নাটক সেখানে দর্শকের সমাদর পাওয়া খুব স্বাভাবিক ঘটনা। এরকম একটি ঘটনার দায় স্বীকার করে এখনও সেই পক্ষ থেকে থেকে কোনও প্রতিবাদ সংগঠিত হয়নি। কেনই বা হবে! যারা আশা করেছিলেন তাঁরা কি আসলে জেগে ঘুমোন? কোনওদিন কোনও অন্যায়ের দায় সরকার স্বীকার করেছেন? ইতিহাস কি বলে? এই বিষয়ে নাট্যকার নির্দেশক অভিনেতা সৌরভ পালোধি বলেন- ‘সরকারের নোংরামোতে আমরা অবাক হই না, কিছু মানুষ যারা সরাসরি তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষের মানুষ, নেতা তারা, তারা অত্যন্ত লিবারেল থাকার জন্য উৎপল দত্তের নাটক ধার করে, এবং এ পৌরসভা থেকে ওই পৌরসভা, জেলা ধরে ধরে হল বুক করে, বিনাপয়সায় মানুষকে নাটক দেখায়, এবং বলা হয় যে আমরা এতো শো করেছি। তার পর তাদের দলেরই কিছু দুস্কৃতি উৎপল দত্তের ফলক ভেঙ্গে দেয়, তখন তারা মুখ খোলে না। আবার এরকম আরোও কিছু মানুষ আছেন, যারা হয়তো সরাসরি তৃণমূল কংগ্রেস করেন না, সিজিনাল তৃণমূল কংগ্রেস করেন, প্রচুর আমাদের সিনিয়র ডিরেক্টররা, তারাও উৎপল নাটক ধার করে টিকিট বিক্রি করেন, তারাও কোনও বক্তব্য রাখতে পারেন না। সাহস করেন না। কারণ কখন কোনদিকে যেতে হবে…’
অর্থাৎ প্রতিবাদ সভায় একটা বিষয় স্পষ্ট সেখানে একতা ন্যায্য বিরোধিতা সংগঠিত হয়েছে। এই যে চুপ থাকা, অন্যায়ের প্রতিবাদে নিজেকে রাস্তায় না নামিয়ে আনা সম্পর্কে পালোধি বলে- ‘আমাদের কিন্তু মনে রাখতে হবে যে যারা সরাসরি এই কাজটি করছেন, এবং ইনডিরেক্টলি মদত দিয়ে চলেছেন, এই দুজনকে চিহ্নিত করতে হবে, কারণ আমি যদি খুব ভুল না হই, তাহলে আগামী কয়েকদিনের মধ্যে এই মিনার্ভার আশেপাশেই দেখতে পাব, নবরূপকার বলে মমতা ব্যানার্জীর নাম সহ আরও নেতা নেত্রীর নাম দেওয়া ফলক এখানে বসবে। তখন আমরা ভিড় করে এই ফলক ভাঙ্গব, এই কথা আমাদের দিতে হবে।’
এই প্রতিবাদ সভায় বিকাস রঞ্জন ভট্টাচার্য উপস্থিত থাকতে না পারলেও তিনি তার বক্তব্য লিখিত উদ্যোক্তাদের পাঠিয়েছেন। সেখানে তিনি এর জন্য তীব্র নিন্দা প্রসর্শন করে বলেন- ‘প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের ব্যারিকেড গড়ে তুলতে হবে।’
এরপর এই সভায় আহ্বায়কদের পক্ষ থেকে একটি দাবী পরে শোনানো হয়।
দাবীটি নিম্নরূপ-
‘আমরা উদ্বেগের সাথে জানতে পারলাম, যে মিনার্ভা থিয়েটার সংলগ্নে স্থাপিত, উৎপল দত্ত স্মরণিকা উপরে ফেলা হয়েছে। উৎপল দত্ত শুধুমাত্র নাটককার নির্দেশক, চলচ্চিত্রের শিল্পী নন, তিনি ভারতীয় সংস্কৃতির উজ্জ্বল আইকন। মিনার্ভা থিয়েটার সংলগ্ন রাস্তাটির নামকরণ হয়েছিল, উৎপল দত্ত সরণি, স্মরণিকা ফল উৎপাটিত করে ইতিহাস মুছে ফেলার আয়োজন চলছে, আমরা ক্ষুব্ধ, বিচলিত। আমাদের দাবী, এই স্মরণিকা ফলকটি অবিলম্বে অবিকৃত অবস্থায়, যথাস্থানে পুনস্থাপীত করতে হবে। এটাই আমাদের প্রস্তাব।’
অর্থাৎ এই ফলক কে কেন্দ্র করে প্রতিবাদ সংগঠিত হল, তা এক কথায় বেশ জোড়ালো। সকল বক্তাই তাঁদের ক্ষোভ প্রকাশ করে একই কথা বলেছেন। নাট্যকার, নির্দেশক অভিনেত্রী সীমা মুখোপাধ্যায় সোচ্চার কন্ঠে বলেন- আমাদের বর্তমান শাসক তারা মোটামুটি শিল্পের বিভিন্ন জায়গাকেই কিনতে পেরেছে। কিন্তু থিয়েটার, যাকে এখনও পুরোপুরি কিনতে পারেনি। আর থিয়েটারের মেরুদণ্ডটাকে এখনও নোয়াতে পারেনি বলেই এতো ভয়। আর তাই আমাদের থিয়েটারের পিতা, আমরা তাঁকে পিতা মনে করি, তারই স্মরণিকা এখন উপড়ে ফেলে দিয়েছে এমন নয়, বুলড্রোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার থিয়েটারের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে না বলে, শাসক দলের মন্ত্রীরা এই উৎপল দত্তের থিয়েটার করে, আর সেই উৎপল দত্তের নামের এই স্মরণিকা উপড়ে ফেলছে। তার নাটক করবে্ন, তার নাটক চুরি করবেন, আর তাঁরই স্মরণিকা উপরে ফেলবেন? আমাদের আন্দোলন জারি থাকবে যতক্ষন না এই স্মারক আবার এখানে রাখা হচ্ছে।
অর্থাৎ এখন দেখার সরকার ও পুরসভা কি পদক্ষেপ নেন। কারণ ইতিমধ্যে মেয়রকে একটা করা হয়েছে। এখন বিরোধী শিবিরে অপেক্ষা, ফলক পুনঃস্থাপীত হয় না কি না। না হলে বঝাই যাচ্ছে, একটি বৃহত্তর আন্দোলনের আকার ধারণ করবে। আর দাবি অনুযায়ী ফলক পুনস্থাপীত হলে প্রতিবাদ সফল হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হবে। নেটিজানরা এখন অপেক্ষা করছেন, সদ্য সমাপ্ত শহীদ স্মরণ উৎসব সমাপনের পর, সরকার কি এই প্রতিবাদকে আদৌ গুরুত্ব দিয়ে দেখবেন?