মৈনাক সেনগুপ্ত
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শুরু হওয়ার ঠিক প্রাক মুহুর্তে (কৃষ্ণ ও অর্জুন)
অর্জুন।। (ধনুক নামিয়ে রেখে) এ যুদ্ধ আমি করতে পারবো না মাধব।
কৃষ্ণ।। এমন কথা বীরের মুখে শোভা পায় না পার্থ।
অর্জুন।। সসাগরা পৃথিবী যেন এক মহাপ্রলয়ের অপেক্ষা করছে বাসুদেব। এত মানুষ, তবু কোথাও কোনও শব্দ নেই।
(হঠাত একটা মোবাইল বেজে ওঠে। পরিচিত টেলফোন রিংটোন, কৃষ্ণ বিরক্ত হয়ে ব সামনে তাকায়।)
অর্জুন।। (নীচু গলায় কৃষ্ণকে) Improvise, improvise থামিস না।
কৃষ্ণ।। কোথায় নিস্তব্ধতা পার্থ? ঐ শোনো রণভেরী (ফোনটা বেজে ওঠে)
অর্জুন।। বাজে আজ যেন কোন অচেনা সুরে!
কৃষ্ণ।। আজ যে চেনা, কালই সেই অচেনা অর্জুন। প্রকৃতপক্ষে এই বিশ্বসংসার মায়া।
(কৃষ্ণের সংলাপ শেষ হতে না হতেই আর একটি মোবাইল তীব্রভাবে বেজে ওঠে। এবারের রিংটোন ‘মা তুঝে সেলাম’।)
কৃষ্ণ রেগেমেগে কিছু বলতে গিয়ে সামলে নেয়। এবার অর্জুন ইশারায় তাকে শান্ত হতে বলে।
কৃষ্ণ।। মা, মা অর্থাৎ জননী মানে কুন্তী।
অর্জুন।। কুন্তী তো তোমার পিসি সখা।
কৃষ্ণ।। আপৎকালে পিসি কেন, ওপাড়ার মিস্টার বিশীকেও মা বলতে হয়।
অর্জুন।। (নিচু গলায়) জগা, ডায়লগ -এ আয়। (উঁচু গলায়) কেশব আমার আমার বিচলনে তুমি বিচলিত হচ্ছ কেন? সমগ্র ভূবনের ভার তোমার উপর। বিস্মৃত হও
কৃষ্ণ।। স্মরণ করো, তোমার মাতা কুন্তীর অবর্ণনীয় দুর্দশার কথা।
(আবার মা তুঝে সেলাম বেজে ওঠে, এবার অল্প সময়ের জন্য। কৃষ্ণ কথা হারিয়ে ফেলে।)
কৃষ্ণ।। কি যেন বলছিলাম।
অর্জুন।। কার মা-কে নিয়ে কি যেন বলছিলে?
কৃষ্ণ।। কার মা? মনে পড়েছে। কর্মা, কর্মযোগ। ‘মা ফলেষু কদাচন’।
দর্শক আসন থেকে এক মহিলা কন্ঠ শোনা যায়। ‘ও পুটু, পানিফল খাবি?’
অর্জুন।। পানিপথের যুদ্ধ কি তখনই হয়েছিল মধুসূদন?
কৃশণ।। (নিচু গলায়) ইতিহাসের সাড়ে চুয়াত্তর করিস না পল্টা, (উঁচু গলায়) স্থান, কাল, পাত্র সবই তুমি বিস্মৃত হয়েছ পার্থ। বর্তমানে ফিরে এসো। ঐ দ্যাখো সামনে আঠারো অক্ষোহিনী কৌরব সেনা, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে।
(হঠাত সামনে দিয়ে একজন দর্শক ঢোকে, একদম প্রথম সারিতে।)
অর্জুন।। কৃষ্ণবাক্যও মিথ্যা আজ। ঐ দ্যাখো, কৌরব সেনা অস্থির, যেন কোনো গভীর সন্ধানে নিয়োজিত।
(পিছন থেকে আওয়াজ আসে- ‘বসে পড়ুন ভাই’)
অর্জুন।। একি শুনি কৃষ্ণ, যুদ্ধ শুরুর আগেই কৌরব বসে পড়ছে! আসলে এ যুদ্ধ কেউ চায় না, এ যুদ্ধ পুরুষকে দেবে মৃত্যু, নারীকে দেবে আজীবনের সন্তাপ, আর্যাবর্তের সমস্ত শিশু শোকে নির্বাক হয়ে পড়বে।
(দর্শকাসন থেকে বাচ্চার আওয়াজ। ‘মা- হিসু পেয়েছে’)
(কৃষ্ণ রেগেমেগে অর্জুনের ফেলে দেওয়া ধনুকটা নেয়। অর্জুন তাকে কোনোভাবে সামলে)
অর্জুন।। কত জল বয়ে গেছে, গঙ্গা, গোদাবরী নর্মদা দিয়ে বয়ে যাবে আরও কত জল! তবু এ যুদ্ধ কাউকে দেবে না কিছু। আত্মীয় হননের শেষে পড়ে থাকবে নিস্তব্ধ চরাচর, দূর থেকে শোনা যাবে কেবল পাতার মর্মধ্বনি।
(পলিথিন প্যাকেট খোলার আওয়াজ)
অর্জুন।। ওই শোন মর্মর
কৃষ্ণ।। চড় চড়।
অর্জুন।। না সখা, ধনুক যখন সম্বরণ করেছি, আমি কাউকে চড় মারতেও পারবো না।
কৃষ্ণ।। হতভাগা! আমি চড় মারবো তোকে!
অর্জুন।। তুমি আমাকে চড় মারবে? এ কথা তো মহাভারতে কোথাও লেখা নেই!
কৃষ্ণ।। এতক্ষণ ধরে যা যা বললাম, মহাভারত কেন, ভু-ভারতে কোথাও লেখা নেই।
অর্জুন।। সে তো ইম্প্রোভাইস করার চেষ্টা করছিলাম,
কৃষ্ণ।। শিবের অসাধ্য।
অর্জুন।। এই সিনে শিব কোথায় এল? আমরা কি কাশীধামে, এটা তো কুরুক্ষেত্রে আছি নাকি!
(দর্শকাসন থেকে প্রথমে একজনের তারপরে আরেকজনের সম্মিলিত কাশির আওয়াজ পাওয়া যায়)
কৃষ্ণ।। এতো সাক্ষাৎ কাশীধাম, স্বয়ং কালীশ্বর বিশ্বনাথ অনেকের কন্ঠে অধিষ্ঠান করছেন।
অর্জুন।। এতো পরম সৌভাগ্য কৃষ্ণ, এমন যুগান্তকারী ক্ষণে স্বয়ং মহাদেব উপস্থিত।
কৃষ্ণ।। প্রলয় ঘটাতে
অর্জুন।। আমাকে বিশ্বরূপ দর্শন করাও জনার্দন। সমস্ত জাগতিক মায়া কাটিয়ে আমি যেন কর্তব্যে স্থির হতে পারি। উর্বশী, মেনকা, রম্ভা, যেন আমার মনঃসংযোগ ব্যাঘাত ঘটাতে না পারে।
(আবার মোবাইল ফোন বেজে ওঠে- ‘লায়লা ও লায়লা…)
কৃষ্ণ।। নাও ব্যঘাত ঘটাতে সানি লিওন চলে এসেছে।
(কৃষ্ণ মঞ্চের সামনের দিকে এগিয়ে যায়)
কৃষ্ণ।। শুনুন ভাই। (অর্জুন থামাতে যায়) আপনারা বরং খাওয়া দাওয়া, হাঁটাচলা, মোবাইল বাজানো চালাতে থাকুন, আমরা নাটকটা বন্ধ করে দিই।
(দর্শকদের মধ্যে হৈ চৈ বেঁধে যায়।)
অনেকজন দর্শক একসাথে।। কয়েকজনের জন্য সবাইকে বঞ্চিত করবেন না, প্লিজ- আমরা, আমাদের সময় অর্থ সব খরচ করে নাটক দেখতে এসেছি, কথা দিচ্ছি আর এরকম হবে না।
কৃষ্ণ।। পাক্কা?
দর্শক।। পাক্কা।
অর্জুন।। প্রমিজ।
দর্শক।। প্রমিজ।
অর্জুন।। নে জগা নাটক শুরু করতে বল।