দুলাল চক্রবর্ত্তী, ফারাক্কা
প্রতিদিন কাগজের পাতায় বর্তমান রাজ্য সরকারের লুটপাট, দূর্নীতি, এবং দলের গোষ্ঠী দ্বন্দ্বে চলা খুনের যে ভয়ংকর বাস্তবতার খবর আমরা অবগত হই, যা সকালবেলার তাজা চোখে দেখতে পাই। তারই জ্বলন্ত মঞ্চভাষ কল্যাণী সৌপ্তিক প্রযোজনা ‘দাগ’-এ দেখতে পেলাম। বহরমপুরের নাট্যমোদি দর্শক মহলও চাক্ষুষ করলো। কারণ ঘুরিয়ে কান না দেখিয়ে, সময়ের উত্তাপ নিভিয়ে দিয়ে, বিক্রিত এবং বিকৃত চারপাশের নেভা ছাই হয়ে আপোষ করে, রাজনৈতিক সন্ত্রাসের ভয়ে ভীতু হ’য়ে সৌপ্তিক শুধু সখের নাট্যঈঙ্গিত দিয়ে খ্যাতিমান নাট্যদল হতে চায় নি।
পুরো নাটকের শরীরের ভাষায় তা স্বাক্ষরিত। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ব্যভিচারের বিরুদ্ধে, কিছু কথা সরাসরি বলার প্রয়োজন অনুভব করেছে। তাই, এক বলিষ্ঠ চিন্তায়, ২০১৮ সালের আগেই, প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য লিখিত মূলগল্প ‘ব্রজ বিজন ও লালু’ গল্প আশ্রিত, সরাসরি ওনারই কলমে লেখা নাটকে চলে গেছে। একদম পোস্টার সাঁটিয়ে, ‘পক্ষীশ্রী– পাখির বাসা’ ভাকুরিয়া পর্যটন আবাসন, শিলান্যাস ইত্যাদিতে মুখ্যমন্ত্রীর উল্লেখে, কেমিক্যাল হাব তৈরি নিয়ে লুটপাট ভিত্তিক কায়েমি স্বার্থের ঈঙ্গিতে, ঘটনা, সংলাপ সবই চলমান এই ফ্যাসিবাদ রাজত্বের বিরুদ্ধেই গেছে। মানুষের না বলতে পারা চাপা আর্তনাদ উঠে এসেছে। তাই নির্ভীকতায় মঞ্চের উপর দেখানো এই নাটকের সবটাই হয়ে উঠেছে এক দুঃসাহসিক তৎপরতার প্রযোজনা। এ নাটক যেন, এই সময়ের নীল দর্পণ। আরো সাংঘাতিক ব্যাপার, এমন নাটক গড়ে উঠেছে একেবারে এই সময়ের কালে ও বহরমপুর সংলগ্ন ভূগোলের স্পেসে। বিদেশী ভাবানুবাদ করে নাটক নাটক খেলা, তাই দাগ নয়। এ নাটক ক্যামোফ্লেজ এ্যান্ড কনসিলমেন্ট নয় কোন মতেই। নয় অতীতে ঘটে যাওয়া বিনোদনের ছদ্মবেশে শুধু দায় যা আমাদেরও বলা কাহিনীর বৃতান্ত। এ দাগ প্রতিদিনের গর্ভে জন্ম নেওয়া স্থায়ী দাগ। ভোট থেকে ক্ষমতা দখলের রক্তাক্ত দাগ। গলায় এঁটে থাকা বেল্টের রক্ত শূন্যতার ছাপ ফেলা দাগ। ভিখারি হয়ে করুণা প্রার্থি বনে যাওয়ার দাগ। অজস্র, হাজার হাজার কোটি টাকা লুট হচ্ছে, কিন্তু চাকরি বিহীন গান্ধী মূর্তির পাদদেশে শিক্ষিত ছেলে মেয়েদের আর্তনাদ করে চলার দাগ। আমাদের বঞ্চিত করে কিছু ক্ষমতা বানের জমিদার বনে যাবার দাগ। রাজ্যের মানুষের ভোট নিয়ে, শুধু শূন্য হয়ে কুত্তার বাচ্চা বনে যাওয়ার দাগ। তাই রাজ তন্ত্রের ভাঁওতা বাজি ধরিয়ে দিতে এ দাগ প্রতিদিনের প্রতি জেলার সন্ত্রাসের বিশেষ সাক্ষর।
তাই, শুধু কথায় মানুষের কল্যাণের নামে মুখোশ পড়ে, সত্যের বিপক্ষে নিয়ত উন্নয়ন দর্শানো পোস্টার দিয়ে ঢেকে রাখা বাণিজ্য মুনাফাখোরদের চক্রান্তের বিরুদ্ধতাকে হত্যা করে, পরিচালিত কায়েমি স্বার্থে মা মাটি মানুষের অস্তিত্ব লোপাটের ভণ্ডামি চালচিত্রে— দাগ অবশ্যই একটি অবিস্মরণীয় প্রচেষ্টা। যেমন নাটকের কাহিনি বৃত্ত, তেমনি ক্ষুরধার সংলাপ। বিজন হত্যা প্রসঙ্গে এসেছে, একবার শাসানি আর একটি গুলির আওয়াজ। অসাধারণ টেক্সট। অভিনব তার হ্যান্ডলিং। এ নাটকের প্রিসাইজড বক্তব্য ও অতি পরিশীলিত অভিনয় হয়েছে সম্পদ। যেমন চমৎকার মঞ্চ ভাবনা, তেমনই আলো এবং বুক হীম করা,আতঙ্কিত জিজ্ঞাসার আলো ছায়ায় সৃজিত আবহ সঙ্গীত। সারা নাটককে এরাই টেনে গেছে। তাছাড়া অভিনয়ে এতো আন্ডার টোন রিয়েলিস্টিক এবং অনুভবের জারনে জর্জরিত ও জ্যান্ত প্রতিক্রিয়া জেলা শহরের নাটকের প্রসেসিং-এ কমই আছে। ব্যক্তিগত ভাবে আমি মুগ্ধ। চমকিত। শিহরিত। দাগ একান্তই সার্থক একটা সার্বজনীন সার্থে উদ্বুদ্ধ করে তোলার নাট্যায়ন।
আর যেহেতু সুদীপ্ত দত্ত, শিপ্রা মুখার্জীর সাথে কয়েক বছর আগে আমিও সামান্যতম অভিনয় করেছিলাম। তাই আমি জানি এঁরা কত বড় মাপের নাট্য শিল্পী। এই আলোচনায় কাহিনী কথা একেবারেই বলবো না। বলবো কিছু তথ্য। জানবো বহরমপুরে যুগাগ্নির ৫০ বর্ষে পা রাখা মহৎ উৎসবে ‘দাগ’ অভিনয়ের প্রতিক্রিয়া সংবাদ। বস্তুত বন্ধু সুব্রত সেনগুপ্ত (ড্যাড) নিজে একজন গুণী এবং অনুসন্ধিৎসু মঞ্চ শিল্পী। তাই তাঁর অভিনয়ে মঞ্চের উপরের শাসক রাজনৈতিক দলের মন্ত্রী শ্যামাপদ চরিত্র প্রকাশের খুটিনাটি কারিগরিতে তিনি সফল। এই নাটকের একটা অংশের দ্বান্দ্বিকতা টেনে ধরে রাখা ছিল। এখানে তিনিই কৃতি নাট্যজন। সবচেয়ে বড় কথা, ড্যাডের আবহ আলো মঞ্চসহ নির্দেশনা একেবারে নিখুঁত। অন্যদিকে দলের ভেতরের রাজনৈতিক পার্টি কর্মী বিজনের ভূমিকায় সুদীপ্ত দত্ত আরেক মাইল স্টোন চরিত্রায়ন। সাথে বিজনের স্ত্রী ইন্দ্রানী হয়ে শিপ্রা মুখার্জীর দীর্ঘ নাট্য অভিজ্ঞতা অসাধারণ সাযুজ্য রক্ষা করেছে। শুধু তা-ই নয়, মধ্যমগ্রাম থেকে আসা স্নেহাশ্রী বকশীর এদিনের প্রথম মঞ্চায়নেই অন্যন্য অভিনয় ম্যাচিওরিটিও গড়ে ওঠা নাটকে সুস্মিতা বিশ্বাসের পরবর্তীতে যুক্ত হয়ে চালু নাটকের হদিস মজ্জাগত করাও এক বিস্ময়। এই নাটকের কেন্দ্রে আছে আরেক সুন্দর চরিত্র। তার নাম ব্রজদা। যিনি চাপের মুখে বিরুদ্ধ সত্যের মুখ বন্ধ করেন, কিন্তু পর্যালোচনা করে চলেন। অন্যায়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজেকে বিচার করেন। রাজনৈতিক বক্তব্যের শ্রেষ্ঠ জীবন-শিক্ষক হয়ে যিনি নিজের গলায় শেকল বাঁধার কুকুর তুল্যরূপ দাগ আবিস্কার করেন। খুবই পরিণত অভিনয়ে এই চরিত্রটি উপহার দিয়েছেন কল্যাণীর বলিষ্ঠ ও বরিষ্ঠ অভিনেতা সমীর চ্যাটার্জী। এখানেই শেষ নয়। দাগ নাটকের শ্রেষ্ঠ চরিত্রায়ন ছিল সংলাপ হীন। প্রায় নির্বাক মঞ্চ উপস্থিতিতে কালিপদ চরিত্রে চিরঞ্জীব বিশ্বাসের বিভিন্ন মোটিভেটেড বোবা অভিব্যক্তি দর্শন দর্শক অভিজ্ঞান মিলে যায়। মাত্র দুটি শব্দ ব’লেও যে মঞ্চের উপর অভিনেতা হয়ে দিব্যি নিজেকে মেলে ধরা যায়। তিনি তা শিখিয়ে ছাড়লেন। গোবিন্দ চরিত্রে দলের সম্পাদক মনোতোষ বন্দোপাধ্যায়ের বিশেষ গুরুতর করণীয় ছিল না। যা ছিল সেটুকু তিনি যথাযথ করেছেন। মোদ্দা কথা, একটি জ্বলন্ত ও জ্যান্ত নাটক দাগ।
কাজেই সবই ভাল যে নাটকের, সেখানে বেশি কথা আর কি বলা উচিত? তবুও যে কথা না বললেও নয় তা হলো একটা প্রশ্ন কেগেছে মনে। উত্তর খুঁজে চলেছি। এই ধরনের নাটকে তার গুরু চণ্ডালী দোষ প্রয়োগে ঘটেছে কিনা, তা খুঁজছি। ব্রজদা আয়নায় নিজের মুখের বিজয় আবির তুলতে অপারগ হয়ে তার গলায় লালু আ্যালসেসিয়ানের মতো রাজনৈতিক কুত্তা বনে যাবার দাগ কী দেখেছিলেন? যদি দেখে থাকেন সেখান থেকেই বিজনের হ্যালোসেন্ট্রিক আবির্ভাব কী ঘটতে পারে না। বিজন যেভাবে ভুত হয়ে সেই তথাকথিত নাটকের মতো নাটক করতে আসছে, তা একেবারেই মিলছে না। এ-ই মুহুর্তে সুদীপ্ত দত্ত খুবই সুন্দর করে আর্তনাদ করছে। কিন্তু ব্রজদা কী এসব কিছুই বোঝেন না? নাকি দর্শকদের অবুঝ ভেবে ফেলা হচ্ছে? যে তাই এতোটা কথায় বিজনকে উলঙ্গ করা হচ্ছে, এইসব অন্যায় অবিচার প্রতিদিনের কাছ থেকে কেউ কী শেখেনি? কাজেই একটা গরম করে দেওয়া নাটক যে সমাপ্তিতে ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, তা ভাবা দরকার। সব কথা ব্রজদার মুখে আগে এলে, পরে সেই সূত্রে বিজন এলে, এসে সবই বলে দিলে, ব্রজদার আধো জাগরিত চোখ ও প্রজ্ঞাকে উন্মোচিত করে দেওয়া হয় নাকি? আমরাও জানা কথায় কিছুটা বেশি উত্তেজিত হতাম।