দুলাল চক্রবর্ত্তী
থিয়েটার জেগে থাক টানা ২৪ ঘণ্টা, এই শিরোনামে কলকাতা মিউনাসের তত্ত্বাবধানে সম্প্রতি অবধি ২৫টি নাটক তপন থিয়েটারে অভিনীত হয়েছিল। তার মধ্যে কাব্যাঙ্গন হালতু সংস্থার বৈমাত্রেয় অভিনীত একটি কথা উৎপন্নকারী উপস্থাপনা। নির্দেশিকা বেবি সেন। এই উৎসবের সব কটি নাটকই ছিল মহিলা নির্দেশিকাদের নিজের নাট্যচিন্তার ফসল। এই মর্মেই উৎসব প্রাঙ্গনকে নাট্য নির্দেশিকাদের আলোকচিত্র দিয়ে চমৎকার ভাবে সাজিয়েছিল সংস্থা। মিউনাসের উৎসাহী শিল্পী কুশীলবেরাও কেউ বাদ নেই। সকলের আন্তরিক যোগদানেই তো ভু-ভারতে না হওয়া এমন টানা ২৪ ঘন্টার নাটকের আয়োজন হতে পেরেছে। তবে অতি অবশ্যই মাথার উপরে আছেন, অতীত থেকে ছিলেন এই উৎসবের উদ্ভাবক-উদ্যোক্তা সম্মানীর নাট্যকার সংগঠক উৎসব দাস স্বয়ং।
এই উৎসবের ৫ম তম অভিনীত নাটক ছিল বৈমাত্রেয়। আমি তপন থিয়েটারে যেকটি নাটক দেখেছি (সর্বমোট ১৫টি) তার মধ্যে এটাই একটা আত্ম-বিক্ষেপের আর্তনাদ সম্বলিত একক নাট্যায়ন। মহাভারতের প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কর্ণ কুন্তী সংবাদ’ অবলম্বনে নাটক বৈমাত্রেয়ের বক্তব্য কথা চারিত্রিক আলাপনের কথ্যভাষায় আনা হয়েছিল। প্রযোজনা কাব্যাঙ্গন হালতু সংস্থা। মঞ্চস্থ হয়েছিল রাত দশটায়। মাতৃত্বের স্বীকার অস্বীকার প্রসঙ্গের দোটানায় মঞ্চে এসেছিল মহাভারতের কুন্তী মাতা স্বয়ং। নাট্য রূপারোপে, মহাভারতের কথা অমৃত সমান মর্মেই, পরিবেশ পরিস্থিতি শর্ত সংলাপ ইত্যাদি দিয়ে নাটক লিখেছেন পিনাকী চ্যাটার্জী। কথক, বীর কর্ণ এবং কুন্তী এই তিন চরিত্রেই, মঞ্চে রূপদান করেছেন বেবী সেন একাই। তাই এ কাজের ইচ্ছা সূত্রে তিনি ধন্যবাদ যোগ্য।
এই নাটকের প্রতিপাদ্যে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল যুদ্ধে পান্ডবদের জয় হবে এ-ই মর্মে একই মায়ের অন্য পুত্রদের জীবন রক্ষা করে অন্য এক প্রান্তিক সন্তানকে যুদ্ধে হত্যা করার অভিপ্রায়। কর্ণ কুন্তীর আখ্যান। সকলেরই জানা বৃতান্ত। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রাক্কালে, যুদ্ধক্ষেত্রের রণ-দামামার ঝঙ্কারিত পরিস্থিতিতে, কুরু সেনাপতি কর্ণের কাছে পান্ডব জননী কুন্তী এসেছেন, তাঁর অধীকৃত সে-ই অমরত্ব-কবজ কুন্ডল হাতাতে। যিনি এসেছেন মমতাময়ী মা সেজে নিজে, অবৈধ জন্মদাত্রী মাতৃত্বের অঙ্গীকার নিয়ে। যে মা সূর্যের ঔরসজাত নিজের অবৈধ সন্তানকে মায়ের কোল না দিয়ে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন অনিবার্য এক অনির্দেশক ভবিষ্যতের দিকে। হয়তো অন্তর্দ্বন্দ্ব ছিল। কিন্তু অবশ্যই আত্ম সম্মান, আত্ম রক্ষা এবং নিজেকে নিজের উন্নতিতে স্বার্থপরতা ছিলই। কারণ ধৃতরাষ্ট্রের পত্নী, কৌরবেয় শত পুত্রের জননী। নিজে খ্যাত হয়েছিলেন রাজনন্দিনী গর্বে। শুধুমাত্রই নিজের সম্মান সমৃদ্ধি চেয়ে কুন্তী গর্ভের অবাঞ্চিত পাপ বিদায় করাকেই নিজের সুরক্ষা বলে ভেবেছিলেন। যার কারণে কর্ণকে ঠেলে দিয়েছিলেন মাতৃ হীন দীন দরিদ্র অজাত কুলশীল আর সর্বপরি আত্মমগ্ন একাকীত্বের অন্ধকারে। আজ, এই সময়ের দাবিতে মহাভারতের একটি বিশেষ মুহুর্তের অন্তর্দাহ নিয়ে গড়ে তোলা এই নাটক ‘বৈমাত্রেয়’ কর্ণ এবং কুন্তীর জীবনের নানা আক্ষেপের কথা, বৈষম্যের বিবরণ জানায়। যা মহাভারতের মধ্যেই সীমায়িত থাকে না। ছড়িয়ে পড়ে দ্রুণ হত্যার দেশীয় বাস্তব সংবাদের মধ্যে। পেছনে থাকে ডাস্টবিনে ফেলে আসা জন্মানো সন্তানের রক্ত পুত্তলিকার সব আশা ভরসার কেন্দ্রীয় আশ্রয় হারাবার কান্না।
বর্তমানের আধুনিকতা এবং উত্তর আধুনিকতায় যুবসমাজের উগ্র আত্মসমর্পণ ক্রমে সম্পর্কের অবক্ষয় ডেকে আনছে। নানা সম্পর্কে ছেলে মেয়েদের ক্রমেই ভোগবাদীতায় নিমগ্ন করছে। নারী পুরুষের কামনা জগতের পুলকিত বাস্তবতায় মোবাইল ভিত্তিক সোস্যাল মিডিয়ার অপরূপ অপরাধ বিশ্ব প্রবাহিত এক ব্যাভিচারকে নিত্য সমর্থন করছে। বিশ্বায়নের ভয়াবহ প্রভাবে মুক্ত যৌন কামনা মূলক পাশ্চাত্য কালচার অসক্তি বাড়ছে। ক্রমে বেড়ে চলা এই পুলকিত জীবন যাত্রায় অবাঞ্চিত অবৈধ মাতৃত্বের স্বীকার অস্বীকারের দোটানায় গর্ভপাত এক জিজ্ঞাসায় যাচ্ছে। তাই এ নাটক যেমন গোপন গভীরে থাকা কর্ণ কুন্তী থেকে প্র্থিবীর সব প্রান্তেই মা ছেলের– পৃথকভাবে নিজের এবং উভয়ের কাঙ্ক্ষিত সম্পর্ক ভূমিকা দাবি করে। কিছু প্রশ্ন তোলে। তেমনি ভ্রুণ হত্যার নির্মমতাকেও দেখায়। বা ভূমিষ্ট সন্তানকে মা’য়ের কোল না দিতে পারার অক্ষম ডাস্টবিন অস্তিত্বকে পুষ্টতা দেয়। প্রহসনের তলায় দেশের সংবিধানের বিধানের পেছনে লুকিয়ে থাকা মাতৃত্ব কান্নাকেও দেখায়। তাই হয়তো কর্ণ এবং কুন্তীর এক গভীর একাকিত্বের এই কথ্য গল্পগাথা বা আলাপনকেও, আমাদের সমসময়কে চেনাতে সমর্থ্য হয়। অন্যভাবে আবার মহাভারত কথাও শোনায়।
তবে এ কথা প্রযোজনা দেখে মনে হয়েছে, এখানে কেবলই মহাভারত চর্চা উঠে এসেছে। জানা কথাই পূণরায় চর্বিত চর্বন হয়েছে। এই নাটকের মঞ্চায়নের উদ্দেশ্য কী নাটকাভিনয় অভিলাষ মাত্র? নাকি মহাভারত অবগতি দেওয়া? কিন্তু সেই কোনকালের অন্ধকার (কুপি হারিকেন) যুগ থেকেই রবীন্দ্রনাথ চর্চায় এই বৃতান্ত চলে আসছে। আজকে বাংলা নাটকের মঞ্চে কুন্তীর আসার পেছনে অবশ্যই মহার্ঘ্য বার্তা থাকা উচিত। কুন্তীর প্রেত এসে এই অকাল গর্ভপাতক অবস্থা দেখে শিউরে উঠতে পারে। যত্রতত্র, বিভিন্ন বিত্তেই সন্তানকে পেটে ধরে, সেই মা পরকীয়া লিপ্ত হয়ে পারিবারিক দ্বন্দ্বে তার ছেলেকে মেয়েকে হত্যা করছে। এমন সামাজিক কলুষতার বিরুদ্ধে এই নাটকের প্রেডিকশন দিব্যি যেতে পারতো। কিন্তু যায় নি। তাছাড়া বেবি সেন তাঁর ইচ্ছে সামর্থ্যের সবটুকু নিংড়ে দিয়েই চালনা এবং অভিনয় করেছেন। তথাপি বলতেই হচ্ছে আরো এনার্জি দরকার আছে। কারণ কুন্তীর অন্তর তাগিদের তীব্রতা কর্ণের কাছে আসতে, এবং সফল হবে কি না ভেবে, নিজের অভিসন্ধি চরিতার্থ করতে যথেষ্ট ব্যাকুল ও উদগ্রীব। এখানে কর্ণের অন্তর্গত স্থিতিশীল উদাস জীবন বোধ, আর পাপের দায়ে আত্ম গঞ্জনা মুখরিত কুন্তীর শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা এবং সেই কারণে উঠে আসা হাহকার কান্না এই নাটকে তীক্ষ্ণ তীব্র হয় নি। এই নাটক দেখতে বসে, বিজয় লক্ষ্মী বর্মনের যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল, স্বাতীলেখা সেনগুপ্তের সানু রায়চৌধুরী, সুমনা চক্রবর্তীর এক নারী কাদম্বরী, বা আহত অম্বা ইত্যাদি নাটকের কথা মনে পড়ছিল। অতএব বৈমাত্রেয় নাটকটির উদ্দেশ্য বিধেয় পরিস্কার হওয়া দরকার। মঞ্চের উপরে সূর্যের অবস্থান, সত্যের প্রতীক। চমৎকার আবহ। আলোক ভাবনায় প্রচলিত গন্ডির বাইরে আসা দরকার। এখন এটাও একেবারেই সত্যি, তা হলো কোনটা দরকার কোনটা অদরকারী, তা বাতলানোর আমি কেউ নই। দর্শক হয়ে যে টুকু চাওয়ার ছিল। তা ঘিরেই আরো একটি অনবদ্য উদ্দেশ্য জ্ঞাপক সময়ের বার্তায় এই বৈমাত্রেয় নাটক যাতে পরিপুষ্ট হতে পারে। তাই কিছু কথা অনিবার্য ভাবেই বলতে হলো।
এক পীড়াদায়ক অবস্থায় দর্শকদের পড়তে হচ্ছে। অধিকাংশ নাটকেরই ঔৎসুক্যতা, কৌতুহলময়তা, কৌতুকময় না হতে পারায় কোন নাটক কী বলবে, কীভাবে বলবে, কেন বলবে এগুলি প্রযোজনা অব্যবহিত আগে নির্ধারিত হচ্ছে না। তাই যুক্তি বিরুদ্ধ এবং আরোপিত নাটকের পরম্পরা ক্রম চর্চায় দেখে, দেখি চলতে চলতে এখন দুরন্ত বেগে ছুটছে। যেখানে নাট্য অনীহা কিছুটা হলেও বাড়ছে। বৈমাত্রেয় নাটক এই মর্মে মহাভারত থেকে উঠে এসে, শুধু কুন্তীর আর্তনাদ হাহাকারে অন্তত ছুঁয়ে যাক,—- সেইসব মায়েদের যারা কোন একদিন ডাস্টবিনে সন্তানকে ফেলে এসে দূর থেকে দেখেছিলেন, সে রক্তের দলাকে এক রাশ কুকুর ছিঁড়ে খাচ্ছে। আজকের কুরুক্ষেত্র, এই ভূবণজোড়া বিশ্বায়নীভবনে সম্পর্ক আছে শপিং মলের উঁচু মাথায়। সবই এখন বাজারে মেলে। একটু সুখের জন্যে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে লোভে লালসায় মাতৃত্বের সাথে সন্তান সন্ততি অপত্যস্নেহ ইত্যাদি সবই। মহাভারতে যা আছে ভূভারতেও তাই আছে এই টেকনোলজিস টেকনিকে।