দুলাল চক্রবর্ত্তী, ফরাক্কা
ধুমধাম করে শুরু হয়ে গেলো বহরমপুর যুগাগ্নির ৫০ বর্ষে পা রেখে নাটকের উৎসব। উদ্বোধন করলেন প্রকাশ ভট্টাচার্য। সাথে ছিলেন অংশুমান ভৌমিক এবং দলের সভাপতি ড: উৎপল সিনহা চৌধুরী। এই এক বছর কাল সময়ে যুগাগ্নি দল বহু পরিকল্পনা নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে পঞ্চাশ বছরের চলে আসাকে স্মরণ করছে। বেশ কিছু একাঙ্ক নাটকের সাথে তিনটি পূর্ণাঙ্গ নাটক, রাতের অতিথি, স্বদেশী নক্সা এবং আরোগ্য নিকেতন অভিনীত হয়ে চলেছে। কিন্তু প্রথমেই চমৎকার চমকে চকমকে লাগলো যুগাগ্নিকেই। অনুষ্ঠানের শুরুতেই ২৩ নভেম্বর যুগাগ্নি প্রথম মঞ্চায়ন করলো বাদল সরকারের বাকি ইতিহাস নাটক। অসাধারণ টেক্সট হ্যান্ডলিং করে অনুপম নির্দেশনা দিয়েছেন দেবাশিস সান্যাল। আমার চোখে এই কাজে ওনার বৌদ্ধিক উত্তরণ মুগ্ধতা এনেছে। মনে হচ্ছে বাকি ইতিহাস ওনার এযাবৎ পরিচালিত সব নাটকের মধ্যেই শ্রেষ্ঠ। কারণ প্রচুর গুণী মানুষকে তিনি যুক্ত করে ভাবনার লেনদেন করেছেন। ব্যতিক্রমী অভিনয় স্কুলিং সকল অভিনেতার চরিত্রে প্রতিস্থাপন করেছেন। এমন সমসত্ত্ব অভিনয়ের আন্ডার টোন অভিব্যক্তি কমই মিলেছে বহরমপুরের নাটকে। নাটকটির সম্পাদনা করেছেন দীপক বিশ্বাস। মঞ্চ ভাবনায় সুহৃদ নির্দেশক হর প্রসাদ দাস ও ব্রতীনের কলা জ্ঞান আলাদাভাবে উল্লেখযোগ্য, সামগ্রিক সাফল্যের সাথে। সব মিলিয়ে ব্যতিক্রমী অনুভূতিতে বাকি ইতিহাসে জড়িয়ে গেলাম। এই লেখার দ্রুতি দ্রুততা কোন দিখাওয়া নয়। আন্তরিক দায়বদ্ধতা। কারণ, এই নাটকের আলোক চিন্তনও অন্য মাত্রা পেয়েছে। চালু সিস্টেমের আলো জ্বলা নেভার প্রচলিত গন্ডির বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে শ্যামা প্রসাদ বন্দোপাধ্যায়ের চিন্তা ভাবনা। তার সাথে শান্তনু মজুমদারের গম্ভীর সাঙ্গীতিক জ্ঞান যুক্ত হয়েছে। তিনি যান্ত্রিক শব্দের ব্যঞ্জনার মধ্যেই গভীর এক আর্তচিৎকার এবং গম্ভীর সুরের তানে মূল টেক্সট থেকে,…গন্ধের অন্ধকার গর্ত থেকে টেনে বের করেছেন শাব্দিক বোধগম্য অনুভব। খুঁজে পেয়েছেন আর্তনাদের অনুরণন। তাকে টেনে ধরেছেন নিজের জীবনে লালিত সীতানাথ অস্তিত্বে, ফুসফুসের ধ্বনিতে। যেখানে দর্শকের পালস রেট বেড়ে যাচ্ছে অনায়াসে। আগেই বলেছি এসেছে আ্যবসার্ড এবং রিয়েলিজম মিশ্রিত প্রতীকী মঞ্চ তাৎপর্য। ব্রতীন মনন, শুভদার চিন্তন চিত্রে চরিত্রেরই ভেতরের অসংখ্য ভাঙ্গা মুখের ভান্ডারের সমাহার মঞ্চে ছিল। সেই মর্মেই রঙ রেখার তাৎপর্যে ধরা হয়েছে প্রেক্ষাপট থেকে পরিপ্রেক্ষিতকে। যা চোখের সামনে আড়াই ঘন্টা ধরে ঝুলে থেকে যন্ত্রণা দগ্ধ আমাদের জীবনের ইতিহাসকে খুঁজে গেছে। বাদল মানসের মন বীক্ষণ সঞ্জাত এই গবেষণা যত মঞ্চস্থ বাদল সরকারের নাটক দেখেছি, তাতে ইতিপূর্বে পেয়েছি বলে মনে হয় না। এক জীবনে শুধুই যুদ্ধ দেখলাম। একটু বেঁচে থাকতেই কঙ্কাল হলাম। খুশিতে ডগমগিয়ে অন্যের মৃত্যু কামনা করলাম। কেবলই বিশ্ব ব্যাপি চলা ধনতন্ত্রের তোয়াজ করে একটা ফায়দা লোভী ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়ালাম। তারপর……., তারপর? কীভাবে তুচ্ছতম কীর্তি সমাপ্ত করে জামার আস্তিন গুটিয়ে কলার উল্টে “ভাল আছি” বললাম। এ আমি কোথায় আছি?…..শেষে ফোঁপাতে ফোপাঁতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
এই মর্মের গল্পেই, বাসন্তীর কল্পনায় ক্ষনিকের গর্বের পর্বে কণার কণিকা চিন্তা ঘুরপাক খায়। যাতে পর্নো নায়িকা হবার স্পর্ধাও ছিল সাবলীল। অথবা তাও নয়। মধ্যবিত্তের মরন মনের মতন নয়। কিম্বা বিদ্রোহের ড্রাগ নেওয়া মুর্খ নেশা হয়ে থাকে যাপনের পেশা। তাই শরদিন্দুর গল্পেই সীতানাথ ভুলের ভুল জেদে বিপ্লব ভেদের ভাবনায়। তোৎলায়। বদলায়। আর পথ হাতড়ায়। শরদিন্দুর আত্ম সচেতন অর্থনৈতিক মানদণ্ডের ফাঁসে আটকা ফাঁকা ফাঁসির মঞ্চ গড়ে, নরকের নজরে পড়ে হাবুডুবু খায় সীতানাথ। যেন কুঁয়ো তলায় বালতি বালতি জল গায়ে ঢেলে দেহের তাপ না কমায় তাকে কুঁয়োয় ঝাঁপ দিতে হলো। হায় শরদিন্দু। এতো অরাজকতা, এতো হিংস্রতায় বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজ নির্ধারিত নাটকে দ্রোহ কি, তা জানে নি। জানে না আজও। দাম না পেয়ে, বাদল সরকার নিজেই এক পশলা বৃষ্টির শীতল জলের বিন্দুমাত্র অহংকার হয়ে রইলেন তাই কী?
অত্যন্ত সুন্দর গড়ে তোলা আন্ডার টোনে শিল্পী মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ উদ্দীপ্ত ছিল। তাই শানিত চেতনায় সকলের অভিনয় এমন সমসত্ত্ব অস্তিত্বে পাওয়া গেল। যা আগে যুগাগ্নির অনেক নাটকে পাইনি। তাই এই বাকি ইতিহাস এক ঐতিহাসিক নাট্য পর্যটন পরম্পরা হবে। বিতর্ক আছে, থাকবে। পীঠ চুলকানো দিয়ে সুন্দরের মুখোমুখি বসা যায় না। তাই এই নাটক, জেলা শহর বহরমপুরের বিশেষ জয়।
তবে শরদিন্দুর ঘটমান বর্তমানের আলাপে “ব্যক্তিত্বের-সংঘাত-জটিলতা” প্রচ্ছন্ন হলে ভাল হবে,– এই কল্পিত দ্বিতীয় গল্পে ললিতার ললিত আর্তনাদ আর সীতানাথের বিধ্বস্ততা প্রসঙ্গে। সুপ্রিয় মুখার্জী খুব সমর্থন যোগ্য চরিত্রায়ন নয়। তবুও ভিন্নভাবে তাঁর চিন্তায় রইতে হবেই। স্রষ্টার নির্দেশিত কম্পনে নাটকের ভূকম্প হলে সুপ্রিয়কে অস্থির গম্ভীর, এই তিন মনস্তত্ত্বকে মর্যাদা দিতেই হবে। অন্তত এই ঘরানার নাট্য বিক্ষণে। যা শক্তিশালী কণার ভিতর স্পার্কে আছে, যা নিয়ে কণা’য় সুস্মিতা সিনহা দে দুর্দান্ত দুর্দমনীয় আত্ম বিকাশ। পাশাপাশি স্কুল সেক্রেটারি শুভঙ্কর মুখার্জী কি স্তব্ধীকৃত আর্তচিৎকার, কোর্টের ফরমান বয়ে আনা অরূপ গোস্বামী কি ভয়ংকর সম্মান প্রত্যাশিত, কিম্বা একেবারেই নিজেকে ভেঙে ফেলে দশ বিশ টাকায় আত্ম বিক্রি করা দিলীপ রায়ের অসামান্য ভূমিকাগুলি ও বিচিত্র আচরণ বা বিহেভ প্যাটার্ন চমকে দেয়। দক্ষ তন্ময় সান্যালের সীতানাথ খুব স্বাভাবিক চরিত্রায়ন যদি-ও। তবুও দুইটি সিতাংশু আলাদা হতেই হবে। গল্পকারের দুই সত্ত্বাকে সম্মান দিতে। স্বর বৈচিত্র একটা পথ হতে পারে। বা বিহেভ প্যাটার্ন, এক্সট্রা ইনট্রো, যাহোক কিছু, অথবা নতুবা অন্য অনেক রকমারি ঝলকের ঝরা মেলার খুঁজে নেওয়া ঝামেলায় যা চির অনিবার্য প্রতিক্রিয়ায় উৎপন্ন হয়। প্রিয়াক্ষী ও সৌমিমা ইতিহাসের দুই কান্না হাসির অপূর্ব দোলায় জীবনের দ্যোতনা। মল্লিকা মন্ডল অভিনীত বাসন্তী চরিত্রের জীবন বোধ কিছুটা গোলমেলে ঠেকেছে। রান্না করা বাচ্চা বিয়ানোতে আটকে নেই এই মহিলা মনন। আশাপূর্ণা মহাস্বেতায় যেতে হবে, সুস্মিতা সিনহা দে অভিনীত কণাকে গল্পে জন্ম দিতে। তবে দেবাশীষ সান্যালের ও প্রশান্ত অধিকারী, সীতানাথ-বন্ধুর সহজ দুই সম্ভ্রমের দুটি চরিত্রের বেশ ভিন্ন মজাদার লাগে। কৌতুহল জমে। বেশ ভাল ভূমিকা এক ড্রাম চা বানিয়ে দেবার গল্পবাজ প্রতিবেশী চরিত্রে অতনু চক্রবর্তীর সবটুকু। কিছুটা বলা গেলেও সব অসম্ভব। তাই সব মিলিয়ে, আজ অবধি উৎসবে অভিনীত দাগ ও স্বাহা নাটক দুটির দুই মেজাজের টানা পোড়েনেও বাকি ইতিহাস বেশ উজ্জ্বল নাট্য দৃষ্টান্ত হয়ে জেগে আছে মনে। অনুষ্ঠিতব্য সূচিতে, আট দিনে এগারোটা নাটক মঞ্চায়িত হবে। যার অনেকগুলো প্রযোজনা আমি দেখেছি। সে-ই সূত্রে বলতে পারি বাকি ইতিহাস ভাবিয়েই ছাড়বে। তবে সীতানাথ না শরদিন্দু, কে কাকে ফাঁসিতে ঝোলাবে, ঝোলাতে যাবে, অথবা ঝুলিয়ে চলেছে…. এই বিতর্ক বাদল সরকারের নাটকের বিস্তৃত চিন্তায় সারা ভারতে বিভিন্ন প্রদেশেই ইতিপূর্বে হয়েছে। হচ্ছে। নব জাগরণের প্রাথমিক অভ্যাস এখানেই জমে উঠবে, যা আজ বড়ই ঘোলাটে নিজের মুখ দেখে নিতে। তাই হয়তো বা এই টানাটানিতে, উনি তাঁর নাটকে এই দ্বন্দ্ব তৈরি করতে পেরেই আমাদের জ্ঞানী হতে বলে গেছেন। যুগাগ্নি যুগান্তর নয়, তবুও গবেষণা যতটুকু করেছে, তাতে ফসলের ফসিল নাটকের বাকি ইতিহাস হলেও হতে পারে। কারণই অভিনয় প্রসেসিং। এতো ভাল প্রসেসড ড্রামা, মফস্বলের কম নাটকেই মেলে বলে আমার দুই চোখ আর মন এখনো বলছে। কাজেই অনুভুত আপ্লুত আশ্বাসের বিশ্বাস কথা বলতে দ্বিধা কী?