দুলাল চক্রবর্ত্তী, ফরাক্কা
কোচবিহার স্বপ্ন উড়ান সংস্থার প্রযোজনায় নির্মিত নাটক নির্জনতা। যে নাটকের সবটাই বর্তমান নাটজগতে সকলের প্রিয় নির্দেশক দেবাশিসের অন্তর-মন নিঃসৃত একটি হৃদয় কাব্য।
যেখানে আছে নিঃসঙ্গ অস্তিত্বের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা অন্ধকার আর নিশ্চুপ ভালবাসা। না বলা কথারা যে কাব্যে গুমরে মরে থেকেছে ৮০ মিনিট সময় জুড়ে তা নাট্য প্রকট। একটু বায়বীয় ইচ্ছার আকার চাওয়ায়, বিনিময়ে না পাওয়াকেই বালিশ করে মাথার তুলে রেখেই, জীবন নিজেই অকারণে চলে আসা বিনিদ্র রাতের রক্তচক্ষুকে চুমু খেয়ে বুঝেছে, অবুঝ ইচ্ছারা কত তেতো। ভেতরে জমা অনুচ্চকথায় অব্যক্ত অভিমান, এই বিশ্ব চরাচরের রোদ ঝড় বৃষ্টি কুয়াশায় কাদামাটিতে গড়াগড়ি খেয়েছে। ভূপতিত অধিকার বাসনা পেয়েছে কঙ্কালের একাকীত্ব। নির্জনতা, বিষন্নতা, বিপন্নতা তবু কেউ পায় নি।
অস্তিত্বের চিন্তা ভাবনা ক্রমে রঙ পাল্টে উল্টে পড়েছে কবিতার ঝর্ণা ধারায়। হারিয়ে ফুরিয়ে, পুড়িয়ে দিয়েছে ইচ্ছার বারুদ। তবুও বিস্ফোরণ ঘটেনি। ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরি মনের মানে জানে না। তাই এখানে আগুনের ঝলকা পোড়াতে পারে না। কিন্ত মরে এবং মারে। হারে আর ইলেক্ট্রিক হাই টেনশন লাইনে বিদ্যুৎ পৃষ্ঠ চিলের ঝুলে থাকা পাখনার দোল খাওয়ায় কামনার কামাল কেয়ামত দেখতে পায়।
এই শব্দ হীন হীনমন্যতায় আবিষ্টমন, তাকেই অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়েছে বুকে। কী আছে বৈধ পথে? কী মেলে দলের দখলে থাকা অসহিষ্ণু অধিকারে? জানি না কেউ! কেননা কথারা এসেছে পাঁচিল টপকে। যখন মানুষের স্বাভাবিক প্রকৃতি আচমকা অস্বাভাবিক বদলে ভিন্নতা পায়। সভ্যতা মানুষকে কুশলী হতেই শিখিয়েছে। তাই চেহারার মতো মানুষ তার মনকেও বিচিত্র রূপে সাজিয়ে নিতে পারে। সেই সাজানো চেহারা ততটা বিপজ্জনক নয়, যতটা বিপজ্জনক সাজানো মন। একটা নাগরিক দূর্যোগের ঘনঘটা চারিপাশে। ভিড়, চিৎকার, ধাক্কাধাক্কি, ধোঁয়া ধুলোতে বেপথু গন্তব্য, তবুও ট্রেনে বাসে গায়ের সঙ্গে জোঁকের মতো ঠেসে লেগে থাকা মানুষ আর মনুষ্যত্ব ভূলন্ঠিত বিকাশে কোণঠাসা।
সভ্যতা শীর্ষে, তবুও তারা নীলাকাশ কোনদিনই হলো না। অতএব নিস্তন্ধ আর অব্যক্ত ব্যবচ্ছেদে বিচ্ছিন্ন বিচ্ছিরি ভাবে চাপা পড়ে যায়, চলমান জীবন—পিচ ঢালা রাস্তায়, ঘাড়ের পাশ দিয়ে, কান ঘেঁষে তারস্বরে হর্ন বাজিয়ে ছুটে চলা উন্মত্ত যানবাহনের গতি দ্রুতিকে স্বীকার করে নিতেই হয়। বিপন্ন যেখানে শ্রুতি আর স্মৃতি।
নির্জনতা নাটক বলেছে, মানুষের শরীর সত্যি। কিন্তু বাকি সব বানিয়ে তোলা। পোশাক মিথ্যে, ঘর মিথ্যে, সম্পর্ক মিথ্যে। এসব মানুষ বারবার পাল্টে ফেলে। নিজেরাই নিজেদের কল্পনাকে বিশ্বাস করে না। সমানে পাল্টাতে থাকে। আর পাল্টে যাবার পরে পুরোনো ফেলে আসা সময়টাকে নিয়ে হাহুতাশ করে। সে হুতাশও মিথ্যে। আমি সারা জীবন একাই ছিলাম। এক সঙ্গে থাকা মানেই এক হয়ে থাকা নয়। যে একা থাকেন পারে না। সে আসলে একাও নয়। সে শূন্য। আর সেই শূন্যতা ভরে দিতে সবসময় নানা মানুষের নানা ঘটনার দরকার হয়। আমরা দুজন আসলে পাশাপাশি ছিলাম শুধু। একের পাশে শূন্য হয়ে।
সব মিলিয়ে এক আধুনিক কবিতা এই নির্জনতা নাটক। কাব্য কথা কবিতা, একান্তের সংলাপ থেকে অভিনয় রীতি প্রকরণ, এবং আলো, মঞ্চ, আবহ, ধ্বনি, প্রতিধ্বনিতে দেওয়া নেওয়া, জাগতিক ও মানবিক অনুভূতির সাথে লেনদেন– সবেতেই অখণ্ড নির্জনতা। যা দেবাশিসের অন্যন্য নিজস্ব নাটক। ঝড় বৃষ্টির রাতে হত্যা নিঁখোজ কিম্বা জীবন মৃত্যুর দোটানায় ভালবাসাকে চেনা— সবেতেই দেবাশিসের জীবন বোধের গভীর থেকে উঠে আসা, এক অন্য সাহিত্যের মুখোমুখি হওয়া। যেখানে পোষ্য কুকুরও কথা বলে। যে নাটকে ঝড় ধুলো হতে বসা কাদামাটি, কুয়াশা, নির্জনতা, অন্ধকার আর ভালবাসা নিজেরা এসে জাগতিক জীবনের সাথে রিএ্যাক্ট করে। কথা বলে। কথা শোনে, মানে বোঝে স্বরের জ্বরের ঘোরে। চম্পা উইলিয়ামস, বদ্রীনাথের সম্পর্কের আঁচড়ে ছিন্নভিন্ন ব্যবচ্ছেদের তদন্তে হত্যা আর হত্যাকারীর অন্বেষণ চলে। এ আরেক অন্য স্তরের জীবন খোঁজার নাটক।
চন্দ্রানী ঘোষাল, প্রতিমা দেবনাথ আর পূজা দেবনাথ ছুঁয়ে যান হৃদয়। অন্ধকারে মানস নন্দন চক্রবর্ত্তী এক অসীমতট ধূসর গোধূলি বেলা হয়ে যান। তবে কুকুর ঝড় কাদামাটি অতটা নয়। পরিনাম পরিনতি প্রশ্ন তোলে। নিরুত্তর সময়। বিচ্ছিন্ন বিভিন্ন একক পৃথিবীর অধীশ্বর হয় যে গল্পে প্রতিটি আসবাব দেওয়াল কিম্বা প্রকৃতি। সেখানে অভিজিৎ শীল, অপূর্ব সিংহরায়, দেবাশিস চক্রবর্তী, বিশ্বজিৎ ভৌমিক, তনু দেবনাথ, অলোক রায়, রচিতা দেবনাথদের আরো কবিতায় মিশতে হতে পারে। জোৎস্না গায়ে মেখে একা রাতের অন্ধকারে কিছুটা পথ হেঁটে নির্জনতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিঃসঙ্গতা বুঝে নিতে হতে পারে। স্বরের তরঙ্গের ঢেউয়ে ভেসেও যেতে হতে পারে কোন অনির্দেশের দিকে, একেবারে এলোমেলো হয়ে।
স্বপ্ন উড়ান উড়ালপথ পেয়ে গেলো। নাকি এটা সেই উড়ান যে ওরায় মন পবনের নাও নক্সি কাঁথা বুনে ভালবাসাকে খুঁজে বেঁচে বর্তে থাকবে। আরো বহুদিন!