দুলাল চক্রবর্ত্তী
নৈহাটি সংলগ্ন অঞ্চলের নাট্য প্রসঙ্গ চিরদিনই বিশিষ্ট সংবাদ। তার মধ্যেই, গরিফা নাট্যায়নের সম্বন্ধে কিছু লিখতে গেলেই, মনটা কেমন যেন ভাল হয়ে যায়। কারণ এই দল, নাটকে বড্ড যত্নবান। কিছু করে দেখাতে উদ্বেল এবং ইচ্ছা নির্ভর। তাই শহরতলী অঞ্চলের ছোট নাটকের গড়া পেটায়, ঐতিহ্য ধরে নাট্য পরম্পরা বুঝে, সে-ই ঈপ্সিত ধারণায়, শিশৃক্ষু এমন বিনয়ী শিল্পী কুশীলবদের সমন্বিত দল কমই দেখেছি। যারা জেনে গেছেন নাটকের উদ্দেশ্য বিধেয় এবং করণীয় কর্তব্য কী হওয়া উচিত।
অতি সম্প্রতি এই দলের কয়েকটি নাটক দেখে এবং শিল্পীদের সাথে পরিচিত হয়ে, আমি এই উপলব্ধিতে এসেছি। সম্প্রতি নৈহাটি ঐকতান মঞ্চে ফিনিকের মিলন সাংস্কৃতিক উৎসবে দেখলাম গরিফা নাট্যায়নের সাম্প্রতিক নির্মাণ, ‘অতিরিক্ত’ নাটকটি। নাট্যকার শান্তনু মজুমদার। তিনি গভীর মননে একটা সামাজিক রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সময়’কে অনুভব করেই, ১৯৯২, কি ১৯৯৪ সাল নাগাদ এই নাটকটি লিখেছিলেন। সে সময় কাঁচরাপাড়া সংঘমিত্রা দলের অন্যতম বিশিষ্ট অভিনীত নাটক ছিল এটি। নাট্য প্রতিযোগিতায় সাড়া ফেলা নাটক ছিল। শান্তনু বাবু অন্য অনেক নাটকের সাথে, এই নাটকের অভিনয়ে, চালনায় দক্ষতা দেখিয়ে তখন নিজের পরিচিতির সীমা বাড়িয়েছিলেন।
এখন পেরিয়ে এসেছি সেই ফেলে আসা আর্থ-সামাজিক টানা পোড়েনের ৩০/৩২টা বছর। কিন্তু এই অতিরিক্ত নাটক, আজো কি অসম্ভব প্রাসঙ্গিক। যখন স্বার্থপরতার চূড়ান্তে মানুষ বিচ্ছিন্ন সবার থেকে। শুধু তাই-ই নয় আজকের আত্মকেন্দ্রিক যাপনের মধ্যে সবাই উদবৃত্ত উপত্যকার একক গ্রহ। তাই এই অতিরিক্ত নাটকের সবটুকুই এই সময়ের সামাজিক জটিলতার জ্বালায় বোঝাপড়ার ধূসরতাকে দর্শায়। নাটকের সরল চলনে এসবই অনুভব করলাম প্রেক্ষাগৃহে বসে।
গরিফা নাট্যায়নের নির্দেশক দেব কুমার দাসের খুব ভাল চালনার নজীর এই অতিরিক্ত নাটক। আবার এই নাটকের সামগ্রিক পরিকল্পনায় যুক্ত আছেন ফিনিক-প্রধান কনক মুখোপাধ্যায় স্বয়ং। তিনি মফস্বল বাংলার প্রবীণ একজন ছোট নাটকের অভিজ্ঞ চালক ও সুচারু নাট্য নির্মাতা। গরিফা নাট্যায়নের সাথে তাঁর এক যুগের অভিজ্ঞতা আছে, এও এক বিরাট সংযোগ।
এই নাটক লেখার পরিপ্রেক্ষিতে আছে বিশ্বায়নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থমকে যাওয়া প্রথম ইতিহাস। সে সময় সবে কম্পিউটারের ব্যবহার শুরু হচ্ছে। মানুষ নিজের কাজ হারাচ্ছে। নীচু তলার কর্মীরা বাড়তি কর্মচারী বিবেচিত হচ্ছে। লেনিন গ্রাদ থেকে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশা মুর্তি নেমে আসতে চলেছে। গ্যাট চুক্তিতে ভূবণের বাণিজ্য জাহাজ সব সম্পদ লুটে নিয়ে মুনাফা-পূঁজির এক মেরুতে চলে যাচ্ছে। এই নাটক তখন লেখা, যখন মানুষ বুঝে উঠতে পারছিল না, তাদের সামনে কি ভীষণ অন্ধকার এসে মুক্ত আকাশকে গ্রাস করছে। শান্তনু মজুমদার সেই প্রেক্ষিতকে বাবা ছেলে মেয়ের একাত্মতায় একটি পারিবারিক গল্পে ধরেছিলেন। যেখানে পারস্পরিক সম্পর্কগুলি ছিঁড়ে যাচ্ছিল, অবুঝ অ-সুখের দোলায়। কেউ কাউকে কাছে টানতে পারছে না। অসহায় বাবা সুনির্মল দত্ত মেয়ের আ্যপেন্ডিক্স এর অকারণ বৃদ্ধিতে হাসপাতালে ভর্তিতে চিন্তায় কাতর। আবার বার্ধক্যে নিজেও হৃদপিণ্ডের ব্যাধিতে আক্রান্ত। কিন্তু মেজ ছেলে সুকান্তর অমলিন হৃদয়বৃত্তিতে বাপিকে পাচ্ছেন না সংসারের মঙ্গলে। সে নিজেকে সুখী করতে, হতাশাজনক ভাবে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের উপার্জনের রাস্তা খুঁজে চলেছে। অসততা নির্ভর পাড়ার সমাজবিরোধীদের সাথে তার যোগদান ঘটে গেছে। তাই ছোট ছেলে ছোটকার সাথে আছে সুকান্ত মাত্র। ঘরে অসুস্থ বাবা। বাড়ির মেয়েটির চিকিৎসার জন্য নিজের চার ছেলেকে সুনির্মল ভালবাসাময় দেখতে পাচ্ছেন না। ইতিমধ্যেই সপরিবারে আলাদা হয়ে গেছে বড় ছেলে সুব্রত। তাহলে কীভাবে কী হবে? এর মধ্যেই বাপির দোসর বাবলু এসে হাঙ্গামা বাঁধায়। সেই মেয়ের প্রেমিক শানু তবুও দায় দায়িত্বেই এই বাড়ির একজন। কিন্তু শেষে কীভাবে এরা মিলিত আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রস্থলের পৃথিবী হচ্ছে। আরোপন হীনভাবে ঘটনার স্বাভাবিক ছন্দে সব চমৎকার মিলে গিয়ে প্রশান্ত উত্তরণে নাটক শেষ হয়।
নিজের ৭৭/৭৮ বছরে চমৎকার অভিনয়ে দেব কুমার দাসকে বাবা চরিত্রে পেয়ে শ্রদ্ধায় মাথা নুইয়ে গেল। মেজদা সুকান্ত চরিত্রে সুকদেব চক্রবর্তী প্রেমের অনাবিল প্রতীকী রূপ। তিনি দরদী নাট্য শিল্পী। বড়দা সুব্রত চরিত্রে রঞ্জিত কুমার দাস মানিয়ে যান গল্পে। ছোট ভাই ছোটকা চরিত্রে প্রীতম দেবনাথ মন্দ নন। তবে অকারণ হাত নেড়ে অস্বাভাবিক হয়ে, নিজেকে দুর্বোধ্য ও দুর্বল করেছেন। সব চেয়ে মুখ্য নেগেটিভ বাপি চরিত্রের অনেক কিছুই বেমানান লাগে। তার অসহায়তা এবং সময়ের তালে অসম ইঁদুর দৌড়ে হোটচ খাওয়া আর কোথায় কীভাবে আছি এই বুঝে নেওয়ার বিন্যাস পরিচ্ছন্ন নয়। নড়াচড়ায় বুদ্ধি দীপ্ত এবং বিশেষ অভিজ্ঞ অভিনয় স্কুলিং যুক্ত হতেই হবে। কারণ বাপি ক্রিয়ার উৎস। বাকিরা প্রতিক্রিয়া মাত্র। অতএব এই দামী চরিত্রটি যদি যথাযথ হয়ে ওঠে, তবে এই অতিরিক্ত নাটকের সাফল্য কেউ রুখতে পারবে না। কারণ নাটকীয় চেহারা দিতে আঙ্গিক খুব মজবুত। বাপ্পা সেনের আলো সুচিন্তিত ও সর্বাত্মক নাট্যে নিমগ্ন আছে। খুব ভাল সেটের ভাবনা। চরিত্রদের নিম্ন মধ্যবিত্ত পোশাক, ঘরের আসবাব, ও রূপসজ্জা। তাহলে খামতিটা কই? শুধু বাপিতেই আছে নাটুকে জার্ক। বাবলুকেও এই সময়ের খুন-খারাপি চালচিত্রে মডিফাইড হতে হবে। বাড়াবাড়ি লাগে খুন ভিত্তিক রাজনৈতিক বাতাবরণের নিত্যকার ঘটনা সংবাদে। এছাড়া বাকি সকলেই সংযতচিত্ত স্বাভাবিক। তার মধ্যে অসাধারণ লেগেছে রুগ্ন বৃদ্ধ হাসপাতালের কর্মী সুরেশ চরিত্রে সুধীর ভুঁইমালির দুর্দান্ত উপস্থিতি। তিনি যেমন তেমনই সুরেশ এক অধস্তন কর্মী। বিষয়ে অতিরিক্ত নাটক, অপাঙতেও, অবান্তর সম্পর্কের দিকে তাকিয়ে, যেন বিচ্ছিন্নতার ছেঁড়া তারে বাড়তি কান্নার সুর বাজিয়ে আমাদের ঘর গেরস্থালির চারিদিকে গজিয়ে ওঠা ফণিমনসার ঝোপঝাড়ের সন্ধান দিল। এই সময়ের অন্যতম বিশিষ্ট বক্তব্যে তাই গরিফা নাট্যায়নের অতিরিক্ত নাটকের সবটাই জীবন দর্পণে নজর অর্পণ হয়ে ওঠে।