ময়ূরী মিত্র
পর্ব – এক
চলন্ত বাসে বসে ব্রিজের ওপর থেকে আশপাশের বাড়ির ঘর –রান্নাঘরের তাকে সাজানো বাসন পর্যন্ত দেখতে ইচ্ছে হয় বড়৷ কেন আমার এ অদ্ভুত ইচ্ছে –এই দেখা থেকে কী পাব আমি — কীই পা পাবে বাকি মানুষ তা বলতে পারি না৷ তবে চলমান ও দূর থেকে মানুষের সংসারের খুঁটিনাটি দেখার যে তীব্র ইচ্ছে সেইসময় তৈরী হয় আমার – তা থেকে কিছুতে রেহাই পাই না৷ হয়ত দীর্ঘদিন ব্যর্থ সফল থিয়েটারের অভিজ্ঞতায় জীবন দেখার ব্যাপারে একটা বিশেষ দর্শন জন্মেছে আমার:
— থিয়েটারকে যদি মানুষের কথা বলে মানতে হয়. তাহলে থিয়েটারের বিষয়ে কোনো না কোনোভাবে মানুষের জীবন আনা উচিত ৷ সেক্ষেত্রে একজন শিল্পী জীবনকে দেখবেন কিন্তু বেশ খানিকটা দূর থেকে ৷ নাহলে দৃষ্টিপাতের পরিসর বাড়ে না — এমনকি পরিসর নাও তৈরী হতে পারে৷ অর্থাৎ আপনি দেখলেন কিন্তু কী দেখলেন মনে রাখতে পারলেন না৷ কিংবা মানুষের জীবনের এত কাছে পৌঁছে গেলেন নিজের মতো করে দেখতেই পেলেন না৷ মানুষ তার সংসারকে এমনভাবে খুলে দিল মানুষের সেই দেখানোটাই আপনার দেখার ওপর কর্তৃত্ব করতে লাগল৷ এমনকি শিল্পীর যে নিজের দেখা হল না তা শিল্পী নিজেই বুঝতে পারলেন না৷
এই বিশ্বাস থেকে কিনা জানি না — সেদিন মিনারভা থিয়েটারে নাটক করে ফেরার পথটি ধরলাম গ্যালিফ স্ট্রিট ও বিবিবাজার সংক্রান্ত অঞ্চলের ওপরের ব্রিজ দিয়ে৷ এ কলকাতার চেহারা অন্য —৷ রেললাইনের আশেপাশে অনেক ফাঁকা জায়গা ৷ বস্তির ছেলেপিলে সেখানে স্ফূর্তচিত্তে খেলাধুলো করে ৷ এক খেলা থেকে দ্রুত অন্য খেলায় চলে যায় হাসতে হাসতে৷ কতদিন শীতের দুপুরে নীচে গিয়ে দেখেছি — অবাঙালী বউরা খোলা আকাশের নীচে রঙিন কাপড় শুকোচ্ছে৷ নির্বিকারে ধাড়ি ছেলেকে ড্রেনের ধারে হাগতে বসিয়ে দিচ্ছে৷ হাসতে হাসতে বর্জ্য পরিস্কার করে পাঁচ আঙুলে ডাল আলুর তরকারী দিয়ে ভাত চটকাচ্ছে৷ আলু খুব কুচি করে কাটা আর কটকটে লাল৷ শুকনো লঙ্কা শুকুতে দেওয়া ও রান্নায় দেওয়ার কোনো কমতি নেই কেবল৷ ঝাল ঠোঁটে বরের সঙ্গে গল্প করছে৷ দুই সভ্যের ব্যবধান এখানে নেই৷ খাটিয়ায় শীতের রোদ আর বর বউ পায়ে পা জড়িয়ে শুয়ে৷ শহরের বুকে বাসিন্দাদের মনের আনন্দে গড়া এইসব দৃশ্য ওই অঞ্চলের প্রতি আমার টান বাড়িয়েছে একটু একটু করে৷ তাই থিয়েটার করে ফেরার রাতে গাড়িকে ব্রিজের ওপর দিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলাম৷
তখন রাত সাড়ে নটা ৷ রেললাইনের ধারে অনেক ল্যাম্পপোস্ট থেকে অনেক আলো ছড়াচ্ছে ৷ আকাশ ভর্তি তারা ৷ তার মধ্যে একটি পুরোনো বাড়ির চারতলার বারান্দায় বসে বাচ্চা মেয়ের চুল টেনে টেনে বেঁধে দিচ্ছে মা কিংবা মায়ের মত কেউ ৷ আলো সব নারীকে মা ভাবতে শেখায় ৷ তাই সে মুহূর্তে বড় মেয়েটিকে মা ই ভাবলাম ৷ বাড়িটার চারদিকে কোনো বাড়ি নেই ৷ আকাশ এখানে ঢাকনা পরেনি ৷ তারাগুলো বাড়িটার ছাদে খেলছে –রাস্তার আলোও বারান্দায় ছড়িয়েছে এনতার ৷ ঘর থেকেও আলো ছিলকাচ্ছে ৷ এত আলোর মাঝে কেবল মা মেয়ের গোটা শরীর –এমনকি চুল টেনে বাঁধার কিংবা মেয়েটির মাথা এদিকওদিক ঘোরানোটুকু কেবল আঁধারে ৷
আমার কিন্তু মনে হয়েছিল –মানবের ক্রমবর্ধমান বায়বীয় সভ্যতায় সে রাতে দুটো মাত্র আলোকোজ্জ্বল প্রাণী –মা ও মেয়ে ৷ আকাশ থেকে মাটি -সবের আলো শুধু তাদের সেবা করে যাচ্ছে ৷
পর্ব –দুই
জানি, প্রকৃতি ও জীবজগত সিনেমার মতো মঞ্চে সরাসরি আসে ৷ reality পূর্ণভাবে মঞ্চে এলে সে আর মায়া থাকে না ৷ নিখাদ সত্যে কল্পনা মুখ লুকোয় ৷ তাই কাঠের কাণ্ডে খবরের কাগজের পাতা লাগিয়ে রঙ দিলেই সে সবুজ পাতা হয় ৷ বুড়ো মানুষের ধুতিতে নীল রঙ দিলে ধুতি নদীর মতো বই ৷ এইসব মজা যে কতদিন ধরে গা মাথায় মাখছি গো আমি ৷ তাই হঠাৎ হঠাৎ উল্টো চলি — ভাঙা বাড়ি , শিব মন্দির , জঙ্গল যে কোনো জায়গাকে মঞ্চ ভেবে নিই ৷ আসলে ভাবতে আনন্দ পাই বলেই ভাবি ৷ যে ভাবনায় নিজেই স্বচ্ছন্দ নই – সে ভাবনা বেশিক্ষণ ভাবা যায় না ৷ কোনো শিল্পীই পারেন না ৷ এ বিষয়ে দুটো গপ্প বলি ৷
সেবার — ব্রিজের ওপর দুপুর ৷ চাকা চাকা রোদ্দুর ৷ বেশ ম্যাচ করে গেছে আমার কটকটে হলুদ শাড়িতে ৷ বাস থেকে দেখা যাচ্ছে , ভাঙা বাড়িটা সবুজ গাছে ভরা ৷ বাড়িটায় এতদিন ভাঙার নোটিস ঝুলছিল ৷ ভাঙা পড়েছে তাও দেখেছি যাতায়াতের পথে ৷ জানি না শুধু , ভাঙা বাড়ির সবুজে ভরে ওঠার গল্পটাকে ৷
ছাদ ভাঙা হয়ে গিয়েছে৷ ঘরগুলোর দেয়াল ক্ষয়ে আসছে৷ সে দেয়ালে ছেয়ে যাচ্ছে অটুট সবুজ৷ বর্ষা এত অল্প — তাও কত লতাগুল্ম ! — প্রতি ঘরের দেয়ালকে এমন আপনজনের মতো ঘিরেছে, মনে হচ্ছে , এরা সব গাছঘর৷ ওপরে রাংতার মত চকচকে আকাশ৷ কী সুন্দর! কী সুন্দর!
ভাবলাম নামি৷ কে আর দেখবে? ঢুকি সবুজের ঘর – দুয়ারে! সেখানে হয়ত দাঁড়িয়ে বেরং এক পুরুষ ৷ নাট্যকার যেমন নাটক লিখতে লিখতে হট করে কাহিনীতে ঢুকিয়ে দেন আপাত বেমানান কোনো চরিত্র ৷ ধীরে ধীরে অন্য চরিত্রগুলো তার সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতায় ৷ তারপর হয়ত বেমানানটাই সবথেকে মঞ্চে সবথেকে মানানসই হয়ে যায় ৷ ভয় হল ৷ সবুজ মঞ্চে আমি ঢুকলে যদি গুল্মের সঙ্গে আমার মিল না হয় ৷ অতএব যান চলল গন্তব্যে ৷ থাক শ্যামল ছায়ায় সে ৷
আরেকদিন সল্টলেকে সভ্রান্ত মানুষের সুন্দর বাগানবাড়িতে আরো একটি প্রকৃতিমঞ্চের দেখা পেয়েছিলাম ৷ পরিচয় আছে –জানি গাছ খুব ভালোবাসেন ৷ মাঠের মাঝে শপিং মল গজালে খুব রাগ করেন ৷ না — গাছকে ভালোবাসায় কোনো কপটতা নেই তাঁর ৷ কিংবা হয়ত বুঝতে পারিনি বৃক্ষপ্রেমীর মন মাঝারের ক্ষেতটুকু কতটা সত্য ছিল !
দেখলাম — তাঁর মালি একটি বড় দেবদারু গাছের মাথা ছাঁটছে ৷ কেশবতী কিশোরী বিধবা হচ্ছে ৷ অনেক সবুজের মাঝে ক্রমশ ছোট হতে থাকা সবুজ গাছ ৷ বললাম —
কাটছ কেন? পাতাগুলো ছিঁড়ছ কেন খামোখা? মালী বললে
—-বেশি পাতা হয়ে ঝাঁকড়া হয়ে গেছে গাছটা! কেটে সুন্দর করে দিচ্ছি৷
এবার মালিক৷
— গাছ খানিক বাড়ালেই হবে? দেখতে সুন্দর লাগবে –মানুষের চোখ আরাম পাবে —সেটুকু গাছই রাখতে হয় বাগানে!
সেকালের ভ্যানগখ এক সূর্যমুখীর কেশর ছড়িয়ে সারা মাঠটাকে করে ফেলেন লক্ষ সূর্যের মাঠ৷ আর একালের চিন্তাশীলের পেট বেয়ে গলগল ঢেউ দিয়ে সবুজের ধারা নামে৷ নিজের পছন্দে গাছের হাত পা মটকে সুন্দর করেন নিজ আবাস!
সুন্দর –তাও সে কেবল আমার? নির্ধারণ আমার! রক্ষণ আমার! শেষ করাও আমার ?
— না বাবা ! আমি থাকি গাধি হয়ে৷ মঞ্চে প্রাণপণ জড়িয়ে রাখি অঙ্কহীন বিশালকে ! —- হঠাৎ লম্বা হওয়া জঙ্গল এক সে৷ সেই আমার মাথাভর্তি চুলওয়ালা BABY রে ! — বারবার জন্মাতে থাকা বাচ্চাটা আর আমার নয়৷ কখন সে প্রেক্ষাগৃহে —-
পর্ব -তিন
সর্বাঙ্গে ফান্টাস্টিক চিকনগুনিয়া নিয়ে ভেলাভেদা জঙ্গলে গিয়ে পৌঁছলাম ৷ ভেলাভেদা গুজরাতের জঙ্গল –কৃষ্ণসার হরিণেরা সেখানে গর্বে ঘুরে বেড়ায় ৷ দুধ-চা রঙের হরিণেরা সেখানে আছে বটে তবে কৃষ্ণ হরিণ তাদের পাত্তা দেয়না ৷ সুন্দরের অসুন্দরকে গুরুত্ব না দেওয়াটা পশুজগতেও যে সমানভাবে আছে -বুঝেছিলাম ভেলাভেদায় ৷
হেমন্তের সে দুপুরে যখন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে জিপ যাচ্ছিল – রোদে কড়া তাপ ৷ তবে রোদটা দেখতে ভালো ৷ রোদের রূপ আমায় জ্বর ভোলাল ৷
ফরেস্ট বাংলোতে প্রাসাদের মতো বাথরুম৷ কালো পাথরের সিঁড়ি বেয়ে বাথটবে নামতে হয় ৷ নামে টব – আসলে সেটা ঘরের মধ্যে পুকুর৷ ঘরপুকুরের জল ঘষে গায়ের গরম একদম তুলে ফেললাম৷ এখনই শীতল গায়ে কৃষ্ণসার দেখতে যাব৷
বাইরে এসে দেখলাম —বাংলোর গায়ে একটি মাটির শিবমন্দির ৷ রোদটা ঢুকে যাচ্ছে মন্দিরে — দেবতার আসাযাওয়ার পথে হাঁটাহাঁটি করবে এখন রোদটা ৷ — ভেতরে চমৎকার টানা চোখের শিবমূর্তি৷ হরিণের দেশে আমার হরিণ -শিব ৷ দুধমাখা লিঙ্গে
বড্ড ঘেন্না! মুগ্ধ হই শিবের চোখ –নীল গাল দেখে ৷
গুজরাতী দুপুর বসে আছে শিবের কাছে — সঙ্গে আমিও – অনেকক্ষণ ৷ শিব বিরাট –কোলটাও বিরাট ৷ হাত বোলালাম মাটির জটায় – দুটো সবল কাঁধে ৷ কী ব্যাপার হে শিব ? হরিণ-শিবের চোখে হেমন্ত ৷
গোধূলি এল উল্টো পথে –ঝোড়ো হাওয়ায় ৷ কী বৃষ্টি কী বৃষ্টি ৷ মাটির শিব — বাংলোতে পোষা নীলগাই -জঙ্গলের কৃষ্ণসার — দুধ-চাহরিণ সব ভিজল ৷ বারান্দায় বসে চোখ বুজে দুলতে দুলতে একগাদা অদেখা প্রাণীর সিক্ত শরীর কল্পনা করছিলাম ৷
জঙ্গলে যাওয়া হল না বলে সবাই হতাশ ৷ কেবল আমি কীসের যে অপেক্ষায় ছিলাম ! লালচে মেঘ সরে সরে চাঁদকে জায়গা দিচ্ছিল ৷ চাঁদ সেদিন বড়ো রোগা -তবু চাঁদেরই তো মঞ্চ গো ! নাটক শুরু হচ্ছে —চন্দ্ররশ্মি শত চরিত্রে ছড়িয়ে যাচ্ছে পথিকের নিবাসে – মাটির দেবতার শরীরে ৷ আলো সুন্দর হরিণ আর কম সুন্দর হরিণের বন্ধুত্ব বাঁধছে ৷ কৃষ্ণসার যেন জড়িয়ে ধরছে দুধ -চা রঙকে ৷
আমার নাদেখা হরিণের দল – আমার বিশ্বাস না করা ভগবান –সবাই আজ আমার সঙ্গে একাসনে
চাঁদনাট্যের দর্শক ৷
সকালে টুরিস্ট বাংলোর ম্যানেজার বললেন –ইস এখনই তো চলে যাবেন ৷ বৃষ্টির জন্য পুরো LOSS হল ৷
কিছু দেখা হল না —-৷
হাসলাম ৷
তারাও ………৷
সমাপ্ত