দুলাল চক্রবর্ত্তী
সম্প্রতি ইমন মুখোপাধ্যায়ের লেখা চুঁচুড়া সারথির ‘Home শান্তি Home’ নাটকের বেশ কয়েকটি অভিনয় মঞ্চে হয়ে গেল। নাটকের নির্দেশক সংস্থার প্রবীণ ও অভিজ্ঞ অভিনেতা সমীর সেনগুপ্ত। Home শান্তি Home নাটকের গল্পটা বেশ মজার। বিষয় উপস্থাপীত হয়েছে সাংসারিক শান্তিকে কেন্দ্র করে।
এক পরিবারে বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় জর্জরিত এক স্বামী সুবল অধিকারী, প্রায়শই শয্যাশায়ী থাকেন। তার দুঃখ কষ্টের খবর কেউ রাখে না। সুবলের এই বেলা শেষের উপেক্ষিত জীবনের গল্পই বলেছে এই নাটক। কেননা শুধু নিজেরটুকু নিয়েই স্ত্রী শান্তিপ্রদায়িনী দেবী মসগুল। তিনি নামেই শান্তি, এমনিতে ঝগড়ুটে বউ। তিতিবিরক্ত স্বামীর প্রতি। কথায় কথায় বিতন্ডা বিবাদ। নির্দয় নির্মম। ওদিকে একমাত্র মেয়ে অরিস্মিতা চারটে মোবাইল, সাথে এক ডজন বয়ফ্রেন্ড নিয়ে আনন্দে মেতে আছে। তার সাথে সর্বক্ষণ রয়েছে হিপি কাট অর্ধ নারীশ্বর ন্যাওটা কাম ফ্যান, কাম প্রেমিক অরিন্দম। যে আবার ব্যগে মোমবাতি নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। সখের বিপ্লব আর পরিবর্তন আনার এক দেবদূত হয়ে মুখরোচক সংবাদ খুঁজে বেরানোই যার কাজ। বাড়িতে এই তিন প্রাণীর ঘনঘন উপস্থিতি। নিত্যনৈমিত্তিক তামাশা ফাজলামো ছেলেখেলা চলে। অবান্তর বৃদ্ধ সুবল অধিকারী। দরকারে কেউ থাকে না পাশে। অবাক বিস্ময়ে শুয়ে থাকে। আবদার করে কিছু চায়। কিন্তু পায় না। অগত্যা অসহায় ভাবে নাক ডাকিয়ে ঘুমায়।
তারই যন্ত্রণা নিয়ে গড়ে তোলা হাসির আড়ালে লুকিয়ে থাকা গভীর আবেদন গিয়ে পৌঁছেছে যমরাজ এবং চিত্রগুপ্তের দরবারে। সুবল বাবুর নিত্যকার উক্তি, যমের নজর নেই, এতো লোকের মরন হয় আমার হয় না, আমাকে যমেও নেয়না, এখন মরলে বাঁচি ইত্যাদি আকুতিতে সারা দিয়ে তাই যমরাজ স্বয়ং ঘটনার সার সত্য বুঝতে এসেছেন। সাথে চিত্রগুপ্তও আছেন। তাদের জানা দরকার সুবলের মৃত্যু আসন্ন কিনা। মৃত্যু অনিবার্য কিনা, সংসারের লীলা শেষ হয়েছে কিনা, এইসব মিলিয়ে দেখতে খতিয়ান হাতে চিত্রগুপ্ত হাজির। অতএব এই ভোগবাদী জীবন যাত্রায় আনন্দের মধ্যেই চারপাশের সংসারে বৃদ্ধ বৃদ্ধারা যেভাবে ক্রমে ব্রাত্য হয়ে যাচ্ছেন। এই নাটক রঙ্গ রসিকতার প্রহসনে তাকেই দেখাতে চেষ্টা করেছে। আমাদের মনে হাসির খোরাক, তবু সম্পর্কের বাঁধনে সংসারকে মন্দির করে গড়ে তুলতে গভীর দর্শনের কিছু ভাবনা ‘Home শান্তি Home’ দিয়েছে।
নাটকের গড়নে কমেডি আছে। আছে আ্যবসার্ড নাটকের স্বাদ। পান্ডুলিপিতে সিরিও কমেডির চির পরিচিত রূপ। চুঁচুড়া সারথি ৩৯ বছর একনাগারে থিয়েটারের সাথে থেকে, অজস্র চমৎকার আবেদনের নাটক আমাদের উপহার দিয়েছে। এই নাটক তার থেকে ভিন্ন স্বাদের। সকলেই নাটকের অপরিহার্য চরিত্র হয়ে উঠতে চেষ্টা করেছেন। তবে গতি কমে যাচ্ছে বলে কিনা, মূল প্রসঙ্গের মধ্যে উপকাহিনীর ব্যাপকতা বেড়ে যাচ্ছে বলে, নাকি অভিনয়ের তাৎপর্যে বিচিত্রিতা আরো দরকার ছিল। এইসবের একটা অঙ্কে নাটকের রূপায়ণে কিছু জটিলতা আছে নাকি খতিয়ে দেখতে হতে পারে। আসলে প্রাঞ্জল কমেডির চাহিদার দাবিতেই এতসব ভাবতে হলো। নির্দেশক নিশ্চিতই বুঝে নেবেন সঠিক আলোচনা করলাম নাকি ভুল হয়ে গেল।
চমৎকার মঞ্চ ভাবনায় রবীন্দ্রনাথ দাস সফল। আবহে সমীর (সেনগুপ্ত)ও ইমন (মুখোপাধ্যায়) বেশ আন্তরিক। নাট্যকার ইমন মুখোপাধ্যায় ইতিমধ্যেই বিবিধ নাটকের রচনায় আস্থাশীল হয়ে উঠেছেন। তবে এই নাটকের দুটো ধারায় সুবলের সাথে মেয়ে বউয়ের টানাপোড়েন আরো বেশি প্রয়োজন আছে। সেখানে অরিন্দম অরিস্মিতা নিজেদের ভাগে বসার জায়গা বেশি পেয়ে গেছে বলেই মনে হয়েছে। যমের ভূমিকায় সুমন সিংহরায় নাটকের দুটো স্বত্ত্ব ধরেছেন। বহু দলের বহু চরিত্রের অভিজ্ঞ অভিনেতা তিনি। তাঁর কাছেই আছে এই নাটকের ছক্কা মারার স্কোপ। ব্যাটে বলে হলেই তিনিই মাতিয়ে রাখার শ্রেষ্ঠ শক্তি। পাশে আছেন অনবদ্য সুবল চরিত্রে সমীর সেনগুপ্ত নিজেই। অর্চিস্মান বণিক বেশ “না মানুষীদের” ঢংয়ে অরিন্দমকে মঞ্চে এনেছেন। মেয়েলী কথায় এই চরিত্রটি ভাল লাগে। তবে তার কীর্তি কলাপের তীব্রতায় বা আধিক্যে কিম্বা আধিপত্যে সুবলের পক্ষে বিপক্ষের বিচারে স্ত্রী কন্যার অভিযোগের নানা কথা কম এসেছে কিনা খোঁজা আবশ্যক।
নাটক বক্তব্য কথার প্রতিপাদ্যে চরিত্রের স্পেস সংকুলান না হলে, কেন্দ্রীয় তাৎপর্য স্ট্রেস হয়ে এলে ‘Home শান্তি Home’ সারথি’র অন্যতম প্রযোজনা হতে পারে। কারণ সুবল অধিকারী-ই, সবভাবে এই পরিবারের সদস্যদের মধ্যেই বিরম্বিত Home শান্তির পক্ষে প্রত্যাশিত ব্যক্তি। চিত্রগুপ্ত চরিত্রে অশোক দাস অসুস্থতার মধ্যেও সাবলীল উপস্থিতি। স্ত্রী শান্তিপ্রদায়িনীর ভূমিকায় কাকলী বিশ্বাস ও মেয়ে অরিস্মিতা মানিয়ে যান তাদের কথা ও আচরণে। সব মিলিয়ে জরুরী এবং মজার এক প্রহসন এই নাটক।