Saturday, July 12, 2025
Saturday, July 12, 2025
Homeনাট্য সাহিত্যচ্যাপলিন কোলকাতায়

চ্যাপলিন কোলকাতায়

সুব্রত কাঞ্জিলাল

পর্ব- ২

অনিতা।। মিঠু, তুই পাগলের কথায় কেন কান দিচ্ছি স?

মিঠু।। দেখ দিদি, সাগর কি বলছে। ওর নাকি কোন ঠিকানা নেই। এই বাড়িটা ওর না। ওকে নাকি সিদ্ধার্থের মত মানুষের ঠিকানা খুঁজতে বের হতে হবে।

অনিতা।।   কদিন ধরে খাওয়া দাওয়া হচ্ছে না ওর। তাই উল্টোপাল্টা বকছে। এই সাগর, এগুলো খেয়ে নে। তোর জন্য আমারও পেটে কিছু পরে নি।

মিঠু।। এতদিন তুমি যাকে আচলের তলায় লুকিয়ে রেখেছিলে সেই তোমার নয়নের মনি, আদরের ভাইটা রাস্তায় বেরিয়ে সুন্দরী মেয়েদের খুঁজে পেয়েছে। তারা সব ওর গান শুনে পাগল। ফোন নাম্বার চেয়েছে। চ্যাটিং করবে বলে। সত্যি কথা বলতো, ওইসব মেয়েগুলো দিদির থেকেও সুন্দরী?

অনিমা। তুই চুপ কর তো মিঠু। ওকে আগে খেতে দে। তেলাপোকার পাখা গজালে নিজেকে পাখি মনে করে।

সাগর।। (খেতে খেতে) সুন্দরী কিনা কি করে বুঝবো? মানুষকে উপর থেকে দেখলে কি কিছু বোঝা যায়!

মিঠু।। তার মানে বুঝতে পারছ দিদি—-

সাগর।। আজ তো নতুন নয়। আমি অনেক দিন থেকে সুন্দরের ঠিকানা খুঁজে বেড়াচ্ছি। সুন্দর মানুষ। একটা সুন্দর দেশ। যে দেশের কোন বেড়া থাকবে না। হিংসা থাকবে না। স্বার্থপরতা থাকবে না। ধর্ম আর রাজনীতির ভেদাভেদ থাকবে না—-

মিঠু।। শোনো দিদি শোনো! স্বপ্নটা ভালো। কিন্তু অবাস্তব।

অনিমা।। ওর কথা বাদ দে। যাকে এখনো মাঝে মাঝে খাইয়ে না দিলে খেতে পারে না। কখন খিদে পায়, ঘুম পায় কিছুই বুঝতে পারে না। নিজের কাজটা নিজের হাতে করবার মুরোদ নেই। তার কথা আমার শুনে কি লাভ?

মিঠু।। তা ঠিক। এইসব ছেলেরা খুব স্বার্থপর হয়। নইলে দেখো আমাদের কোন দিন গান শোনা য়? আমার বন্ধুরা কতদিন ওকে গান গাইতে বলেছিল। ও ডিনাই করে গেছে।

সাগর।। তখন আমার গান গাইতে ইচ্ছে করছিল না। ভেতর থেকে ইচ্ছে শক্তি জেগে না উঠলে কেউ কি কিছু করতে পারে? (খাওয়া বন্ধ করে দিয়ে) আমার যেমন আর খেতে ইচ্ছে করছে না এখন।

অনিমা।। খেতে ইচ্ছে করছো না মানে? বাইরে থেকে খেয়ে এসেছিস?

মিঠু ।। খেয়ে এলেও কি তোমাকে বলবে। ওর এখন কত ফ্যান ফলোয়ার। ওর গান শুনতে মেয়েরা ভিড় করে।

অনিতা।। কি হলো হাত গুটিয়ে আছিস কেন? তুই আর কত জ্বালাবি বলতো? দুধটা অন্তত খেয়ে নে—

সাগর।। তুমি রেগে যাচ্ছ দিদি। ছোটদের ওপর এতটা রেগে যাওয়া কি উচিত? বড়দের অনেক ধৈর্যশীল হতে হয়। সেদিন জামাইবাবু কেও বলেছি, তুমি নাকি অফিসে গিয়ে রাগারাগি করো। শ্রমিকদের মাইনে বাড়াতে চাইছো না। এটা কিন্তু স্বৈরাচারী মনোভাব। শ্রমিকদের জন্যই আমরা বড়লোকি চাল দেখাতে পারি। ওরা কাজ করে আমাদের বড়লোক করে দেয়। নিজেদের জন্য তেমন কিছুই থাকেনা।

অনিমা।। তুই আমাকে জ্ঞান দিতে আসিস না। তোকে আমি পেটে ধরি নি। তার মানে এই নয় যে, তুমি আমার সন্তান না। তোদের দুজনকে জন্ম দিয়ে আমাদের মা তো মরে গেল। সেই থেকে তোরা আমার কাছে মানুষ হয়েছিস। তোদের ভালো-মন্দ আমার চাইতে কে বেশি বুঝবে?

সাগর।। বেশ বেশ। তাহলে বলতো আমি এখন খেতে পারছি না কেন? হঠাৎ করে খিদেটা মরে গেল কেন?

অনিমা।। তোর তো পাখনা গজিয়েছে। পিঁপড়ের যেমন পাখনা গজায়।

সাগর।। পাখনা গজিয়েছে কিনা জানিনা। তবে চোখ ফুটেছে। অনেক কিছু দেখতে পেলাম। রোজ ই তো দেখতে পাচ্ছি। আজকে খুব ভোরে নদীর পাড়ে গিয়েছিলাম। তখন দেখলাম কাছেই শ্মশান। জেলে বস্তি। হঠাৎ শুনলাম বস্তির একটা বাড়িতে একসঙ্গে বাবা মা দুই ছেলে মেয়ে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে। ওদের কোন কাজ ছিল না। রোজগার ছিল না। খাওয়া জুটছিল না। এইসব নিয়ে পার ঘাটা য় অনেক আলোচনা চলছিল। খেতে বসে হঠাৎ এসব মনে পড়ে গেল। এইতো সেদিন কাগজে বেরিয়েছে, আমাদের দেশ এখন ক্ষুধার সূচকে বাংলাদেশ পাকিস্তানের থেকেও নিচের দিকে।

অনিমা।। এসব ভেবে তুই কি করতে পারবি?

মিঠু।। এই ছেলেটাকে তুমি বাড়িতে আটকে রাখতে পারবে না দিদি। সিদ্ধার্থর মত ঠিক একদিন বেরিয়ে যাবে । তার আগে ওর একটা বিয়ে দিয়ে দাও। এমন একটা সুন্দরী মেয়েকে আনতে হবে, যাকে ছেড়ে ও পালাতে না পারে।

অনিমা।। তুই খেপেছিস মিঠু। ওর নারী নক্ষত্র আমি জানি। কোন মেয়ের সঙ্গেই ওর বোনবে না। কাউকে ওর পছন্দ হবে না।

সাগর।। ডজন ডজন সুন্দরী মেয়ে আছে দিদি। তবে আমি জানি, আমার জন্য একজন একদিন না একদিন ঠিক আসবে। (স্বগত)

মিঠু।। তাই নাকি। ও দিদি কি বলছে দেখো।

সাগর।। তোর এত মোটা মাথা কেন রে মিঠু? আমরা কি শুধুমাত্র আমাদের নিজের জন্য? আমরা তো সবার জন্য। একা যেমন বাচা যায় না। তেমনি আমি আর তুই দুজনেও কি বাঁচতে পারি আমরা? আমাদের মাথার উপরে আকাশটার মত মনের আকাশটা ও বড় করতে হয়।

মিঠু।। তুই তাই কর বাবা। আমি চানে যেতে হবে। আজকে ফ্যাক্টির ি ভিজিট করতে হবে। প্রাকটিক্যাল ক্লাস যাকে বলে।

অনিমা।। আরে শোন শোন। জরুরি কথা আছে।

মিঠু।। এতক্ষণ বললে না কেন। আমার হাতে সময় নেই। পরে শুনবো।

অনিমা।। পরে হবে না। তোদের জামাইবাবু রাতে এসে জানতে চাইবে তোদের মতামত।

মিঠু।। আমাদের মতামত মানে?

অনিমা।। রোজই তো জামাইবাবু জানতে চাইছে। আমারই আর বলা হয়ে উঠছে না।

মিঠু।। কি এমন জরুরী কথা তাড়াতাড়ি বল।

অনিমা।। তোদের জামাইবাবু বলছিল যে, বাবার রেখে যাওয়া স্থাবর অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি আমাদের তিন ভাই বোনের মধ্যে ভাগ করে নিতে।

মিঠু।। এ আবার কি কথা। আমরা তো এসব নিয়ে কখনো কিছু ভাবি নি।

অনিমা।। আজ ভাবিস নি। কাল তো ভাবতে হবে। তোর বিয়ে হবে। সাগরের বিয়ে হবে। তখন নতুন মানুষ যারা আসবে তারা নিশ্চয়ই ভাববে। প্রশ্ন করবে।

সাগর।। কেউ আসবে কিনা জানিনা। কেউ কখনো যদি আসে, তাকে আমি পরিষ্কার বলে দেবো, আমার কিছু নেই। মানে ঘর নেই বাড়ি নেই। রোজগার নেই। কিচ্ছু নেই। ‌

অনিমা।। তুই কি বলবি মিঠু?

মিঠু।। তুমি আর জামাইবাবু আমাকে যা বলতে বলবে সেটাই বলব। আমি বাথরুমে ঢুকলাম। এসব আমাদের কাছে কোন জরুরী কথা নয়। জামাইবাবুকে মাথা খারাপ করতে বারণ করো।

অনিমা।। তোদের জামাইবাবু, ভালো মানুষ বলেই, তোদের ফাঁকি দিতে চায় না। এটা কেন বুঝতে পারছিস না? সম্পত্তি বিষয় আশয় এসব নিয়েই তো যত গন্ডগোল। মামাকে ফিরে আসতে দেখা যাবে।

অনিমা।। এই যে মামা, তুমি ওদের একটু বুঝিয়ে বলবে। তোমাদের জামাই তোমাকেও তো বলেছিল, বাবার সম্পত্তি তিনজনের মধ্যে ভাগ করে দেবার কথাটা।

মামা।। বলেছিল। এরা কি বলছে?

সাগর।। আচ্ছা মামা, আগে কি রাজার ছেলে রাজা হত? ব্রাহ্মণের ছেলে কি ব্রাহ্মণ হতো?

মামা।। তা হতো না। ইংরেজরা আসবার আগে দেশের জমি জমার মালিক ছিল দিল্লির সম্রাট। আর বৈদিক যুগে ব্রাহ্মণের ছেলে ব্রাহ্মণ হতো না। ইংরেজরা আসবার আগে রাজার ছেলেও রাজা হতো না। সেই জন্য দেখবি, সম্রাট অশোক রাজা হবার জন্য তার দশ ভাইকে হত্যা করে ছিল। মোঘল শাসকদের মধ্যেও এইসব ঘটতো।

সাগর।। তাহলে আমার বাবা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে সম্পত্তি রোজগার করেছে, আমরা কোন অধিকারে তার মালিক হতে চাইবো?

মামা।।‌ খাঁটি প্রশ্ন। লাখ টাকার প্রশ্ন।

অনিমা।। এটাই তো আইন মামা।

মামা।। আইন তো বানায় মানুষ। ভগবান এসে তো কোন আইন বানায় না। সাগর যদি তার বাপের সম্পত্তি না গ্রহণ করতে চায়, তাহলে আমাদের বলবার কিছু থাকে না। এ ব্যাপারে আমি ওর সঙ্গে একমত।

অনিমা।। এসব কথা তোমরা তোমাদের জামাইকে বুঝিয়ে বল। এসবের মধ্যে আমিও আর থাকতে চাই না।

মামা।। তোর মামী তোদের জন্য ‌ খাবারদাবার পাঠিয়েছে। আর তোর বরদা বোম্বে থেকে তোদের জন্য এইসব এনেছে। এগুলো নিয়ে যা অনিমা।

অনিমা।। তুমিও আবার এগুলো নিয়ে আসার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লে কেন? আমরাই গিয়ে নিয়ে আসতাম!

মামা।। তোর হাতে অনেকদিন কফি খাই না। তাই খেতে এলাম। আর সাগরের সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।

অনিমা।। বা ব্ বা! সাগর দেখছি এখন ভি আই পি হয়ে উঠছে। ঠিক আছে আমি কফি করে আনছি। দুপুরে এখানে খেয়ে যাবে কিন্তু। (ভেতরে যাবে)

মামা।। তোর মামি কে তাহলে একটা ফোন করে দে। অফিস যখন যাওয়া হল না, সাগরের সঙ্গে আড্ডা মেরে যাই।

সাগর।। আমার সঙ্গে তো কখনো কেউ আড্ডা মারে না মামা। আমার কোন বন্ধু নেই। সবাই আমাকে এড়িয়ে চলে। আমার নাকি মাথার গন্ডগোল আছে। তাইতো জামাইবাবু আমাকে মাঝে মাঝে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়।

মামা ।। আমিও একটা সমস্যায় পড়েছি ভাগ্নে। বুঝে উঠতে পারছি না কি করব।

সাগর।। আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারবো মামা?

মামা।। অন্তত সুপরামর্শ দিতে তো পারবি। অন্যেরা কি ভাবছে আমি জানিনা। তুই যে বড় হয়েছিস। নিজের পায়ে দাঁড়াবার কথা ভাবছিস। তোর যে অনেক বুদ্ধি বিবেচনা বোধ রয়েছে এর প্রমাণ আমার কাছে আছে। তুই যে আর পাঁচজনের মতো নয়, এটাই তো সবচেয়ে বড় কথা। ভেড়ার পালের মত সমাজের দেশের মানুষগুলো শুধুমাত্র একজনের কথায় নাচতে নাচতে কসাইখানার দিকে চলে যাচ্ছে। যাবার আগে একটুও ভাবছে না, যে দিকে যাচ্ছে সেটা ঠিক পথ কিনা।

সাগর।। ঠিক বলেছ মামা। এই যে পৃথিবীতে এত হিংসা, যুদ্ধ, হানাহানি, মানুষের লোভ এর তো একটা কারণ থাকবে। আমরা বিজ্ঞাপন কোম্পানিগুলোর বিজ্ঞাপন, আর রাজনৈতিক নেতাদের হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার পেছনে ছুটে চলেছি। আমাদের ঋকবেদ থেকে শুরু করে, গৌতম বুদ্ধ, যীশু খ্রীষ্ট, হযরত মুহাম্মদ, চৈতন্যদেব এদের কারো কথা আমরা শুনলাম না।

মামা।। আমি এখন যেটা তোর কাছে বলতে চাইছি, সেটা শুনে, তুই রাগ করবি না আমি জানি। তবে আমাকে ছোট ভাবতে পারিস।

সাগর।। তুমি বলো মামা, আমি তোমার কথা রাখার চেষ্টা করব। চটকল বস্তির একটা বুড়িকে আমি কথা দিয়েছিলাম যে, তাকে আমি দশ হাজার টাকা দেব। দিদি আমাকে প্রতি মাসে যে টাকাটা দেয় সেটা তো আমার খরচ হয় না। আমি সেই বুড়িটাকে দিয়ে দিয়েছিলাম। এখন মনে হয়—

মামা।। ভুল করেছিলি?

সাগর ।। হ্যাঁ। দিদি জামাইবাবুর টাকা অন্য কাউকে দান করবার কোন অধিকার আমার নেই। আমাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। রোজগার করতে হবে।

মামা ।। তুই তো জানিস আমার বড় ছেলেটা একটা গুজরাটি মেয়ে বিয়ে করে এনে ছে। ওরা এখানে থাকবে না। আমাকে বলছে, বাড়িটা বিক্রি করে ওর অংশের টাকা ওকে দিয়ে দিতে। আমার বড় মেয়েটা ও বাড়ির ভাগ চাইছে।

সাগর।। দিয়ে দাও। যুদ্ধ বা অশান্তি করে এসব সমস্যার সমাধান হয় না।

মামা।। আমার বাকি জীবনটা কিভাবে চলবে? আমি তো ভেবেছিলাম, ওদের তো অনেক কিছু আছে। তবুও কেন আমার বাড়িটার উপর ওদের লোভ? ওরা যদি চলে যায়, তাহলে বাড়ি ভাড়া দিয়ে আমি খেতে পারি। এক বছরের মধ্যে রিটায়ার করতে হবে আমাকে। এমন কিছুই হাতে পাব না। ছেলে মেয়েদের মানুষ করতে গিয়ে, বাড়িটা করতে গিয়ে, জমানো টাকার তেমন কিছু নেই। এখন আমি বলছি কি, তুই যদি তোর বাপের সম্পত্তির তোর ভাগটা আমাকে দিস-কথাটা শুনে সাগর চমকে উঠবে। চঞ্চল হয়ে ওঠে। উত্তর খুঁজে পায় না। পায়চারি করতে থাকে। তারপর বলে–

সাগর।। আমার নিজের যদি কিছু থাকতো, আমি সর্বস্ব তোমাকে দিয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু আমার তো কিছু নেই। বাবার জিনিস তোমাকে দেবার কোন অধিকার আমার নেই।

মামা রেগে যাবে। তারপর যাওয়ার সময় বলে যাবে—

মামা।। আমি জানতাম। এই কথাই বলবি তুই। আমি তোকে অন্যরকম ভেবেছিলাম। এখন দেখছি তুই অনেক বড় শয়তান। হৃদয়হীন। তুই একটা ভন্ড।

অনিমা মামার জন্য কফি নিয়ে ঢুকতে গিয়ে মামার আচরণে অবাক হয়ে যায়।

অনিমা।। কি হলো সাগর? মামাকে কি বলেছিস? ওভাবে চলে গেল কেন?

সাগর।। জানিনা তো!!!

অনিমা।। আমি যে মামাকে খেয়ে যেতে বললাম।

সাগর।। বোধহয় মামা খিদে হারিয়ে ফেলেছে। কিংবা কাকে বলে খিদে সেটাই বুঝতে পারে না।

অনিমা।। কি জানি বাবা, তখন যে কার কি হয় (ভেতরে চলে যাবে। ঠিক এই সময় আসল চ্যাপলিনকে ঘরের এক পাশ থেকে সাগরের কাছে আসতে দেখা যাবে)

সাগর।। তুমি! এখানে? কিভাবে এলে?

চ্যাপলিন।। দারুন। মার্ভেলাস। যাকে বলে নির্ভেজাল অভিনয়। বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠা।

সাগর।। তোমাকে ওরা দেখে ফেললে বিচ্ছিরি কান্ড ঘটবে!

চ্যাপলিন।। ওরা কেউ আমাকে দেখতে পাবে না। ওদের কাছে আমি ইন ভিজিবল । তোমার কাছে আমি এইরকমটাই চাইছিলাম। হবে হবে। তোমাকে দিয়ে আমার ছবিটা হবে।

সাগর।। তোমার ছবি তে আমি কতটা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারব জানিনা। তবে এতক্ষণ যে কথাগুলো বললাম এর মধ্যে কোন মিথ্যা নেই। এসব আমার মনের কথা।

চ্যাপলিন।। জানি জানি। ভেতরে বাইরে তুমি এক হতে পেরেছো। তবে এই গল্পের আরো একটা পাঞ্চিং লাইন আছে। সেটা কিন্তু আরো অনেক ডেঞ্জারাস।

সাগর।। সত্যি? কি রকম?

চ্যাপলিন।। আগে থেকে জেনে কি লাভ? জীবনের পরীক্ষায় আগে থেকে উত্তর পত্র জানা যায় না। go on— আমি তোমার পাশে আছি–

সাগর।। একটা কথা। তোমার ছবিতে আমার কোন নায়িকা থাকবে না? তুমি তো বাবা নায়িকা ছাড়া একটাও ছবি কর নি—-

চাপলি।। থাকবে থাকবে। একজন খাঁটি বাঙালি নায়িকা থাকবে। এবার সেই নায়িকার দৃশ্য আসবে। এখানেই ঘটি যাবে এই গল্পের চূড়ান্ত ক্লাইম্যাক্স তোমার কাজটা কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য হওয়া দরকার।

সাগর।। তা আর বলতে।

দৃশ্যের পরিবর্তন।

পরের দিনের সকাল। কোথায় যেন বাঁশিতে আহির ভৈরব বেজে উঠেছে।

সাগর বাগানের একটা বিশেষ উঁচু মত জায়গায় বসে আছে। চোখে একটা কালো কাপড় জড়ানো। কিছুক্ষণ পর উঠে দাঁড়াবে। অন্ধের মত হাঁটাচলা করবে। মিঠু ঘরের মধ্য থেকে বেরিয় এলো। সে বাইরে যাচ্ছে।

মিঠু।। এ আবার কি কান্ড!! পড়ে যাবি যে—–

সাগর।। যাতে না পড়ে যাই সেই চেষ্টাই করছি।

মিঠু।। এর নাম মেডিটেশন? যত্তসব! (হাসবে)

সাগর।। দৃষ্টিহীনদের জগৎ কেমন হয় সেটাই বোঝার চেষ্টা করছি।

মিঠু।। আমাদের জীবনানন্দ দাশ তিনি তো বলেছিলেন, অন্ধরাই সব থেকে বেশি দেখতে পায়।

সাগর।। আমিও কান দিয়ে দেখার চেষ্টা করছি। তুই আজকে কি রংয়ের পোশাক পরেছিস, তোর হাতে কি আছে, ব্যাগে কি আছে সব বলে দিতে পারি।

মিঠু।। পিসি সরকারের ম্যাজিক? তুই আর কি কি পারিস বলতো?

সাগর।। মানুষের মনের খবর বলে দিতে পারি। কখন কোন অবস্থায় কে কি ভাবছে। বিশ্বাস হচ্ছে না? তাহলে পরীক্ষা প্রার্থনীয়—–

মিঠু।। তোর পরীক্ষা নেবার সময় আমর নেই। ফিরে এসে পরীক্ষা নেব।

সাগর।। ঠিক আছে তাই হবে।

মিঠু।। তারচেয়ে বরং তুই একটা গান ধর। আমার অটো‌ রিক্সা যতক্ষণ না আসছে আমি শুনতে পাবো।

সাগর আবার গান ধরে।

গান।। (এটা চ্যাপলিনের সিনেমার ইংরেজি গান। সঙ্গে নাচ ও হবে।)

এক মিনিট শোনার পরে মিঠুর রিকশা চলে এলো। সে নিঃশব্দে বেরিয়ে যাবে। তারপর আর একটা রিক্সা আসবে। সেই রিকশা থেকে নেমে আসবে একটি মেয়ে। অসম্ভব সুন্দরী মেয়ে। সে ও গান শুনতে দাঁড়িয়ে যাবে।

সাগর ।। কি হলো? তুই কি চলে গেছিস—-তাহলে আমার সামনে কে দাঁড়িয়ে আছে? কথা বলছিস না কেন? গান কেমন লাগলো বল না?

কথা বলতে বলতে সাগর এগিয়ে আসবে। মেয়েটাকে ছুঁয়ে ফেলবে। মেয়েটা বলে উঠবে দারুণ। আর ঠিক তখন সাগর মুখের কালো কাপড় সরিয়ে নেবে।

সাগর।। আপনি?

মার্গারেট।। এটা কি শুভঙ্কর সান্যালদের বাড়ি?

সাগর।। হ্যাঁ। জামাইবাবু তো ঘুমোচ্ছেন। আজ তো রবিবার। অফিস ছুটি। তাই একটু দেরি করে উঠবেন।

মার্গারেট।। আমি পুরুলিয়া থেকে আসছি। আমার নাম মার্গারেট ডি সুজা।

সাগর।। পুরুলিয়া। ওখানে পাহাড় আছে? নদী?

মার্গারেট।। আছে তো। ফাগুন মাসে কৃষ্ণচূড়া গাছে গাছে এত এত এত ফুল ফোটে চারিদিক তখন লালে লাল হয়ে যায়। আপনি হাঁটতে হাঁটতে মহুয়ার বনও দেখতে পাবেন। মহুয়া ফুলে ফুলে সমস্ত রাস্তা তখন লালে লাল কার্পেটের মতো মনে হবে।

সাগর।। তাহলে তো পুরুলিয়া যেতেই হবে।আপনি আসছেন, আমার দিদি জামাই বাবু নিশ্চয়ই জানেন?

মার্গারেট।। হ্যাঁ । কাল রাতেও ফোনে কথা হয়েছে।

সাগর ।। তাহলে আর কি। আপনি এখানে বসুন। এই সময়টা আমি বাগানের গাছেদের মধ্যে ঘোরাফেরা

করি। ওদের সঙ্গে কথা বলি। ওদের গান শোনাই।নাচ দেখাই। বলছিলাম যে—- আপনার গান ভালো লাগে তো?

মারগারেট।। কার না ভালো লাগে গান? আপনার গলা কিন্তু অপূর্ব। নাচ ও চমৎকার। চার্লি র সিনেমাতে দেখেছি।

সাগর।।‌ আপনাকে দেখতেও অপূর্ব সুন্দরী। না না আপনাকে আমি খুশি করার জন্য কথাটা বললাম না। আমার মনের কথা বললাম। আমি মানুষের মন পড়তে পারি। আপনার মনটাও খুব সুন্দর। আপনি চা খাবেন? নাকি কফি খাবেন ? আমি অবশ্য ওসব কিছু খাইনা । মন চাইলে মাঝে মাঝে খা ই। এই যেমন এখন মন চাইছে। যদি অবশ্য আপনি খান।

মার্গারেট।। আপনি চা বানাতে পারেন?

সাগর ।। না। আমি কিচ্ছু পারিনা।আমার দিদি বানিয়ে রাখে আমার জন্য।

ফ্লাক্সে আছে। আপনি একটু বসুন আমি এক্ষুনি নিয়ে আসছি।

মার্গারেট।। আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না—-আমি বসেছি। সাগর দৌড়ে চলে যাবে। চায়ের ফ্লাক্স, দুটো কাপ নিয়ে ফিরে আসবে।

সাগর।। আপনাকে ঢেলে নিতে হবে। আমি ততক্ষণে আপনার জন্য গন্ধরাজ ফুল নিয়ে আসি।

মার্গারেট।। একটা কৌতূহল হচ্ছে । যদি কিছু মনে না করেন জানতে চাই ব।

সাগর।। আমি জানি কৌতুহলের কারণ। আমি চার্লির মত পোশাক পড়ে আছি কেন?

মার্গারেট।। নিশ্চয়ই অভিনয় করে ন?

সাগর।। একটা সিনেমার জন্য অফার পেয়েছি। হলিউডের সিনেমা। চার্লি ইন ক্যালকাটা।

মার্গারেট।। তাই নাকি! দারুন ব্যাপার দারুন ব্যাপার।

সাগর ।। আরো বড় দারুণ ব্যাপার হলো, এই ছবির ডিরেকশন চার্লি চাপলিন নিজেই দেবেন।

মার্গারেট।। সেটা কি করে হবে! তিনি তো অনেকদিন আগে—–

সাগর।। শরীরটা চলে গেছে। মানুষটা কিন্তু আজও আছে। ব্যাপারটা হল কলকাতার পটভূমিকায় গল্প লেখা হয়েছে। তাই আমি এই পোশাকটা পরে চার্লি হবার মানে হয়ে ওঠার চেষ্টা করছি।

মার্গারেট।। হয়ে ওঠা। হ্যাঁ। খুব কঠিন কাজ। আমরা কেউ কোন কিছু হয়ে উঠতে পারি না।

দৌড়ে গিয়ে গন্ধরাজ এর দুটো স্টিক নিয়ে আসবে। মার্গারেটকে উপহারের মতো করে দেবে।

সাগর।। এই বাগানে আরো অনেক রকম ফুল রয়েছে। তবে আমার গন্ধরাজ ফুল সবচেয়ে প্রিয়। আরো আশ্চর্য কি জানেন? ওই গাছে অনেকদিন পর মনে হচ্ছে আপনার জন্যই ফুটে উঠেছে। চার্লি চ্যাপলিন এইভাবেই তার মনের মানুষকে ফুল দিতে ন তাই না?

ভেতর থেকে শুভঙ্কর বেরিয়ে আসবে।

শুভঙ্কর।। আরে তুমি এসে গেছ। কতক্ষণ? আমাকে ডাকলে না কেন? ভেতরে এসো—

মার্গারেট।। এত সকালে আপনাকে ডিস্টার্ব করলাম!

শুভঙ্কর।। আরে না না। তা কেন। অসুবিধা হয়নি তো আমার বাড়ি চিনতে?

মার্গারেট।। আজকাল গুগল ম্যাপ ‌ থাকতে অসুবিধা হবে কেন—–

শুভঙ্কর।। তা ঠিক। তুমি ভেতরে এসো–

সাগর।। চা ঢালা হয়েছে। এটা খাবে না? সবে ঘুম থেকে উঠেছ। বাথরুম থেকে ঘুরে এসো। ততক্ষণ আমরা এখানে বস ছি—–

শুভঙ্কর।। তবে তাই হোক। আমি বাথরুম থেকে ঘুরে আসি (ভেতরে চলে যাবে)

সাগর।। এই যে ম্যাডাম,চায়ের কাপ নিয়ে আমার সঙ্গে আসুন। আপনাকে একটা আশ্চর্য জিনিস  দেখাবো। আসুন আসুন। এমন জিনিস দেখাবো যা কখনো আপনি দেখেন নি—–সাগর এমনভাবে বলবে, মার্গারেট বাধ্য হবে উঠতে। ওরা দুজনে চলে যাবে বাগানের একটা বিশেষ প্রান্তে।

এমন সময় অনিমা ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় এসে ওদের দুজনকে দেখে চমকে উঠবে। তারপর ভেতরে চলে যাবে। বসার ঘরে গিয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা নিয়ে বসবে। শুভঙ্করকে দেখে ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলবে।

অনিমা।। ওই মেয়েটা এখানে কেন?

শুভঙ্কর।। ওতো একটা কাজে এসেছে—–

অনিমা।। এ বাড়িতে কেন?

শুভঙ্কর।। আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে–

অনিমা।। ও কি এখানে থাকবে?

শুভঙ্কর।। দু-একদিন থাকতেও পারে–

অনিমা।। (চিৎকার করে) না না না একদিনও ওর এখানে থাকা চলবে না।

শুভঙ্ক র।। আসতে বল। শুনতে পাবে যে—-

অনিমা।। পাক শুনতে। ওকে এক্ষুনি এখান থেকে বেরিয়ে যেতে বল।

শুভঙ্কর।। কি হচ্ছে অনিমা—এভাবে বলছ কেন?

অনিমা।। ও যদি এ বাড়িতে থাকে আমি এই মুহূর্তে বেরিয়ে যাব।

শুভঙ্কর অনিমাকে সামলাবার চেষ্টা করে। অন্য ঘরে নিয়ে যাবে।

আলো এসে পড়বে সাগরের কাছে। সে একটা আশ্চর্যজনক ফুল মার্গারেটের হাতে তুলে দেয়।

ফুলটা হাতে নিয়ে মার্গারেট অবাক হয়।

মার্গারেট।। এই ফুল এখানে!!! এটাতো এদেশে পাওয়া যায় না। কিভাবে এলো এখানে?

সাগর।। এসেছে। আপনি যেমন করে এখানে এলেন।

মার্গারেট।। আমি তো ফুল নই। আমি একটা মানুষ। আমার কোন পরিচয় নেই। অনাথ আশ্রমে আমি বড় হয়েছি। তারপর সেখান থেকে একজন খ্রিস্টান পাদ্রী আমাকে তার কাছে নিয়ে গিয়েছিল। তিনি আমাকে নতুন জীবন দিয়েছেন। বাঁচতে শিখিয়েছেন। আমার একটা পরিচয় দিয়েছে ন। একটা আইডেন্টিটি আমার হয়েছে। সেই খ্রিস্টান পাদ্রী র আদর্শে আমি এখন তার রেখে যাওয়া কাজ করে চলেছি।

সাগর।। কাজ? কি কাজ? মানে আপনি চাকরি করেন?

মার্গারেট।। আদিবাসীদের বাচ্চাদের নিয়ে একটা স্কুল চালাই।

সাগর।। তাই নাকি।। দারুন ব্যাপার।। ও হ্যাঁ, এই ফুল কিভাবে এখানে এলো তার কথা বলি। কয়েক বছর আগে কাশ্মীর থেকে এক পিতা পুত্রী আমাদের রাজ্যে এসেছিলেন জীবনের আরেকটা ঠিকানা খুঁজে পেতে। ওদের ওখানে খুব গন্ডগোল চলছে তো। শাল বিক্রি করতে এসে আমার সঙ্গে ভাব হয়েছিল। তারাই এই ফুলের বীজ আমাকে দিয়ে গিয়েছিল। বলেছিল গাছ হবে কিনা জানিনা। কোনদিন ফুল ফুটবে কিনা জানিনা। যদি ফোটে তাহলে তুমি ভাগ্যবান। আজ সকালে আপনাকে দেখে আমার এই গাছটার কথা মনে পড়ল। দেখলাম ফুল ফুটেছে। এখন আমার মনে হল, আপনার জন্যই ফুটেছে। (হাসি)

মার্গারেট।। সেই কাশ্মীরী পিতা পুত্রি তারা কোথায় গেল? তারা কি এখনো আসে এখানে?

সাগর।। না। কাগজে ছবি বেরিয়েছিল ওদের। ওরা এখানে এসে খুন হয়ে গেছে।

মার্গারেট।। খুন হয়ে গেছে!!!

সাগর।। কে খুন করল—কেন খুন হল—-আমরা কেউ জানি না! তবে আমার কাছে এখনো তারা বেঁচে আছে। এই গাছটার মধ্যে। এই ফুল টার মধ্যে।

মার্গারেট।। আমি জানি তারা কেন খুন হল। আমার অভিজ্ঞতা আমাকে বুঝতে শিখিয়েছে ওরা কেন খুন হয়। আমার জীবন দাতা, সেই খ্রিস্টান পাদ্রীও একদিন চার্চের মধ্যে খুন হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি যাজকের কাজ করলেও মানুষকে ভালবাসতেন। তবে এভাবে এই ফুলটা আমাকে দিয়ে আমাকে সমস্যাই ফেলে দিলে ন——এর পরিবর্তে আমি আপনাকে কি দেব? বাগানের এক কোনে চ্যপলিনকে দেখতে পেয়ে সাগর তার কাছে যাবে। জিজ্ঞেস করবে, তার অভিনয় ঠিকঠাক চলছে কিনা। তারপর দুই চ্যাপলিন আসল এবং নকল দুজনে মিলে মেয়েটাকে নিয়ে নাচ শুরু করে দেবে। মার্গারেট অপ্রস্তুত। বুঝতে পারছে না সে কি করবে।

এদিকে আলো এসে পড়বে ঘরের মধ্যে।

অনিমা।। তোমার কোন কথা আমি শুনতে চাই না। ওকে এখান থেকে চলে যেতে বল। নইলে আমি কুরুক্ষেত্র করব।

শুভঙ্কর।। একটু শান্ত হয়ে আমার কথা শোনো। আমাকে কটা কথা বলতে দাও।

অনিমা।। কোন কথা আমি শুনতে চাই না। আমি বুঝতে পারছি, ওই মেয়েটার সঙ্গে তুমি আমার আড়ালে যোগাযোগ রাখো। তুমি আমার সংসারে আগুন জ্বালাতে চাইছো।

শুভঙ্কর।। তুমি আমাকে ভুল বুঝছো অনিমা। আমি তোমার বাবার শেষ ইচ্ছের দাম দিতে চাইছি।

অনিমা।। বাবার শেষ ইচ্ছে মানে তো ওই মেয়েটার সামাজিক পরিচয় প্রকাশ করা। বাবার সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারা করতে গিয়ে ওকে যুক্ত করে নেওয়া। একটা মানুষ জীবনে অনেক ভুল করতে পারে। অনিচ্ছাকৃত পদ স্খলন ঘটতে পারে। তাই বলে তার মৃত্যুর পরেও তার জের টেনে যেতে হবে?

শুভঙ্কর।। মার্গারেট তোমার সংসারে আগুন জ্বলতে আসেনি। সে একটা স্কুল চালায়। পুরুলিয়ার আদিবাসীদের নিয়ে অবৈতনিক স্কুল। আর তাই তাকে টাকা সংগ্রহ করতে মাঝে মাঝে কলকাতায় আসতে হয়। আমিও তাকে সাহায্য করি। মেয়েটা তোমার বাবা বা তোমাদের বিষয় কোন কিছুই জানে না। সে আজও জানে যে তাকে জন্ম দিয়ে তার মা একটা অনাথ আশ্রমে ফেলে রেখে গিয়েছিল। মেয়েটা জানে না তার জন্মের জন্য তোমার বাবা দায়ী। যতদূর ওই মেয়েটাকে বুঝতে পেরেছি , আর যদি সে কথা সে জানতে পারে, সে গোলমাল পাকাতে এখানে আসবে না। পিতৃপরিচয়ের দাবিও তুলবে না।

অনিমা।। কিন্তু তুমি ওই মেয়েটাকে তার জন্ম পরিচয় জানাতে চাও। বাবার সম্পত্তির ভাগ দিতে চাও।

শুভঙ্কর।। এটাই তো ছিল তোমার বাবার শেষ ইচ্ছে।

অনিমা।। তাহলে বাবার মৃত্যুর পর এতগুলো বছর ধরে তুমি চুপ করে ছিলে কেন?

শুভঙ্কর।। হঠাৎ করে আমি কিছু করতে চাইনি। আমি তোমাদের মন বোঝার চেষ্টা করেছি। আমি বুঝতে পারছিলাম না যে কিভাবে তোমার বাবার শেষ ইচ্ছের দাম দিতে পারব।

অনিমা।। বাবা আমাদের। আমি বলছি যতদূর এগিয়েছো আর এক পা ও তুমি এগোতে পারবে না। যদি তেমন কিছু মনে করো, মেয়েটা কে লাখ পাঁচেক টাকা দিয়ে বিদায় করে দাও। ও যেন এখানে আর কোনদিন না আসে। আমাদের সঙ্গে ওর কোনো সম্পর্ক নেই।

শুভঙ্কর।। মেয়েটা ভিকিরি নয়। নিজের জন্য ও কোন কিছুই প্রত্যাশা করে না। ওর মন জুড়ে রয়েছে আদিবাসীদের নিয়ে সেই স্কুল, যা ওখানকার একটা চার্চের ফাদার ওকে দিয়ে গেছে। তুমি হয়তো জানো না যে, তোমার বাবা মৃত্যুর আগে তোমাদের সম্পত্তির একটা ছোট্ট অংশ ওই মেয়েটার নামে রেজিস্ট্রি করে গেছে।

অনিমা।। আশ্চর্য। এত বড় কথাটা তুমি আমাকে এতদিন জানাওনি। চেপে রেখেছিলে। আর আজ—

শুভঙ্কর।। আমার বারবার মনে হয়েছিল, তুমি যেমন মিঠু আর সাগর কে ভালোবাসো, সেইভাবে সেই একই রকমভাবে ওই অভাগা মেয়েটিকে ও গ্রহণ করতে পারবে।

অনিমা।। না না আমি পারবো না। ওই দলিলটা তুমি ছিড়ে ফেলো। আমার সামনে তোমাকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। নইলে আমি —-। (বাইরে বের হওয়ার চেষ্টা করছিল। শুভঙ্কর তাকে বাধা দেবে।)

শুভঙ্কর।। কোথায় যাচ্ছ তুমি? মেয়েটাকে কোনরকম আঘাত করা বা অপমান করবার কোন অধিকার আমাদের নেই। কেন ভুলে যাচ্ছো যে আমরা কেউ নিজের ইচ্ছায় পৃথিবীতে আসি না। ওই মেয়েটাও নিজের ইচ্ছায় পৃথিবীতে আসে নি। ওর কোন দোষ নেই।

অনিমা।। সব দোষ আমাদের ভাগ্যের। সব দোষ আমার বাবার। তুমি কেন বুঝতে পারছ না যে, বাবার ওই কলঙ্কের কথা সাগরের কানে গেলে ওর মনটা ভেঙে যেতে পারে। ঠিক একইভাবে মিঠুর কল্পনার জগৎটা চুরমার হয়ে যেতে পারে। আর ঠিক এই কারণেই

শুভঙ্কর।। সব দোষ ওই মেয়েটার ঘাড়ে চাপিয়ে তুমি আমি আমরা সুখের সাগরে ভাসতে চাই এই তো? অনিমা, একবার নিজেকে ওই মেয়েটার জায়গায় নিয়ে গিয়ে ভাববার চেষ্টা করো। ওই মেয়েটা যদি জানে তার বাবা কোন এক দুর্বল মুহূর্তে একটা ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু শেষ জীবনে মৃত্যুর আগে নিজের অপরাধ স্বীকার করে, মেয়েটাকে পিতৃ পরিচয় দিতে চেয়েছিল। তাতে কি মেয়েটার মধ্যে মানুষের প্রতি বিশ্বাসের সেতুটা শক্ত হতে পারে না? । কান্নায় ভেঙে পড়ে অনিমা। সে বুঝতে পারে না কি করবে।

শুভঙ্কর।। আমার কথা শোনো অনিমা। নিজেকে স্বাভাবিক করে তোলো। চারপাশের কুয়াশা মুক্ত করতে হবে আমাদের। জীবনের নদীটা বহমান রাখতে হবে। আমার সঙ্গে বাইরে চলো। সহজ করে নাও সবকিছু। তোমার তো হারাবার কিছু নেই। তুমি এখন দিতে এসেছ। কেড়ে নিতে নয়। পেছনে ঘটে যাওয়া অন্ধকার আলোয় ঝলমল করে উঠুক তোমার অনন্ত ভালবাসার মধ্য দিয়ে।

এদিকে সাগর মেয়েটাকে নিয়ে বারান্দার দিকে এগিয়ে আসবে। শুভঙ্কর ও অনিমাকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো।

সাগর ।। দিদি দিদি, এই দিদি, পেয়ে গেছি রে, এতদিন পর আজকে পেয়ে গেলাম। আমার নিজের পায়ে দাঁড়াবার শক্ত মাটি।

শুভঙ্কর।। তাই নাকি। কোথায় পেলি?

সাগর।। তুমি যদি সেদিন আমাকে ওইভাবে না বলতে,

তাহলে আমি আজও হয়তো ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে জুবু থুবু হয়ে বসে থাকতাম।

শুভঙ্কর।। ব্যাপারটা কি হল, হঠাৎ করে কিভাবে মাটি পেয়ে গেলি?

সাগর।। সে অনেক কথা শুভঙ্কর দা। তবে কদিন ধরে অনেক তো ঘুরলাম। অনেক কিছু নতুন দেখলাম।

অনেক কিছু বুঝলাম। তারপর আজকে এই মেয়েটা আমাকে মাটির ঠিকানা বলে দিল।

শুভঙ্কর।। কি ব্যাপার মার্গারেট? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না! তুমি তো আমার কাছে এসেছিলে, টাকার জন্য। আর কলকাতায় আরো কি সব কাজ আছে বলেছিলে—!

মার্গারেট।। আপনার কাছ থেকে আর তো টাকা নিতে পারবো না।

শুভঙ্কর।। সেকি! কেন?

মার্গারেট।। টাকার বদলে যাকে পেলাম, তার দাম টাকা দিয়ে পরিশোধ হবে না। আমার মনে হলো, এই মানুষটাও আমার মত অনেক দিন থেকে একটা কিছু খুঁজে বেড়াচ্ছিল।

সাগর।। এই মেয়েটার যেমন কোন দেশ নেই, ঘর নেই, সামাজিক পরিচয় নেই। এক অর্থে আমিও অনেকটা এইরকম। আমার স্কুল লিভিং সার্টিফিকেট নেই। আধার কার্ড নেই। ভোটার কার্ড নেই। প্যান কার্ড নেই। ঘর বাড়ি নেই। অনেকটা সিনেমার চার্লি চ্যাপলিনের

মত। যেন বিশ্ব পথিক।

অনিমা।। ওর মত তোর কি পিতৃপরিচয় নেই?

সাগর ।। ওটা সবারই থাকে। নইলে পৃথিবীতে এলাম কিভাবে? ওটা তো বড় কথা নয় দিদি।

মার্গারেট।। আমার স্কুলের জন্য ঠিক এইরকম একজন মানুষকে আমি খুঁজে ছিলাম। শুধুমাত্র

কিছু টাকার বিনিময় যে স্কুলের কর্মী হতে চাইবে না।

অনিমা।। সাগর, তুই ওর সঙ্গে চলে যাবি?

সাগর।। হ্যাঁ দিদি। আমি তো তোমাদের বারবার বলেছি, নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। জীবনের একটা অর্থ খুঁজে পেতে চাই। এই মেয়েটার মধ্যে বেঁচে থাকার মানেটা দেখতে পেলাম।

শুভঙ্কর।। মার্গারেট, তুমি যে বলেছিলে কদিন থাকবে এ বাড়িতে—

মার্গারেট।। আপনার বাড়িতে আমি থাকবার জন্য আসিনি শুভঙ্কর দা। আপনি সাগরের কথা আমাকে বহুবার বহু রকম করে বলেছিলেন। সেই জন্যই তো ওকে দেখবার কৌতুহল নিয়ে এসেছিলাম। এবং দেখলাম আপনার কথা কতটা খাঁটি। সাগরের সম্পর্কে আপনি একটুও অতিরঞ্জন করেন নি।

শুভঙ্কর।। ওর কথা আমি তোমাকে বলেছিলাম, তারও একটা কারণ আছে। আমি জানতাম, সাগর যেমন নদীকে আহবান করে, নদীও তেমনি ভাবে সাগর সঙ্গমে গিয়ে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে।

অনিমা।। সত্যি সত্যি তোমরা চলে যাবে!

সাগর।। হ্যাঁ হ্যাঁ দিদি। আর দেরি করা যায় না। আর দেরি করলে বড় ভুল হয়ে যাবে। তুমি তো জানো আমি ঠিকানাহীন মানুষ। পিছু ডেকে কোন লাভ নেই দিদি——-

অনিমা।। কিন্তু এই মেয়েটার সঙ্গে যে আমার অনেক কথা ছিল—

মার্গারেট।। আপনার কথা এতদিন যেমন প্রকাশ করেন নি, আজও না হয় অনুক্ত থাক । সাগরের মধ্যে দিয়ে যে সত্য প্রকাশ হয়ে পড়লো আজ না হয় আমরা সেটাকে গ্রহণ করি।

সাগর।। তাহলে দেরি কেন মার্গারেট, চলো আমরা

পুরুলিয়ার পথে পা বাড়াই। তোমার চোখে দেখা

পুরুলিয়ার রুক্ষ মাটি, সবুজ পাহাড়, গহন অরণ্য, কৃষ্ণ কালো আদিবাসীদের গ্রাম, আর ধূসর আকাশের সামিয়ানায় আমাদের ঠিকানা খুঁজে বেড়াই।

সাগর ছুটে গিয়ে তার ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে আসবে। ওরা দুজন যেন অনন্তের পথে পা বাড়ালো। গান শুরু হবে।।

ঘরের বাধন ছেড়েই যদি ঘনায় যদি রাত,

মরণজয়ী জীবন এসে বাড়িয়ে দেবে হাত।

নির্বাক শুভঙ্কর। সজল চোখে অনিমা ও বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে।

অন্যদিকে আসল চ্যাপলিন সাগর এবং মার্গারেট বিদায় জানাচ্ছিল। সারা আকাশ তখন রামধনুর রঙে রঙিন হয়ে উঠেছে।

সমাপ্ত

বি।দ্র। এই নাটকের সব রকম আইনি অধিকার নাট্যকারের কাছে থাকবে। নাট্যকারের লিখিত অনুমতি ছাড়া অভিনয় করা যাবেনা।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -

Most Popular