নিজস্ব প্রতিনিধি
জলপাইগুড়ি উজান নাট্যদলের ১৫তম জন্মবার্ষিকীতে তারা আয়োজন করেছিল অণুনাটক উৎসব। বিগত ১লা জুন, ২০২৫ রবিবার এই উৎসবে স্থানীয় বান্ধব নাট্য সমাজ মঞ্চে মোট ৭টি নাট্যদল তাদের নাটক প্রদর্শন করে। প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের মাধ্যমে মঙ্গলালোকে অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা হলো প্রথাগত ভাবে। প্রতি বছরের মতো এবারও গুণীজনদের উজান সম্মাননা দেওয়া হয়। উজান সম্মাননা প্রাপকরা ছিলেন নাট্যাভিনেত্রী রত্না রায়, নাট্যকার নির্দেশক প্রসূন দাশগুপ্ত ও নাট্যকার নির্দেশক অভিনেতা শেখর মজুমদার। উজানের সভাপতি স্বাগত ভাষণ দেন। বিশিষ্ট অতিথিরা তাঁদের সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে উজান নাট্যদলকে শুভেচ্ছা জানান। উজানের সম্পাদক ডালিয়া চৌধুরী তাঁর বক্তব্যে বিগত বছরগুলোতে তাদের কাজের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে তুলে ধরেন এবং সকলের সহযোগিতার জন্য শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করেন।
ডালিয়া চৌধুরীর নির্দেশনায় উজানের ‘বাজল ছুটির ঘন্টা’ নামক শিশু কিশোর নাটক দিয়ে নাট্য উৎসবের সূচনা হয়। সময়ের প্রতিবিম্ব হিসেবে এই নাটকটি ছাপ রেখে গেল মনে। ছোটদের জীবন থেকে সবুজ মাঠ, নীল আকাশ, খোলা হাওয়া পালে লাগিয়ে পড়াশোনার অবকাশে একটু জিরিয়ে নেওয়া, ঠাকুরমার ঝুলির মনকাড়া সব গল্পের আস্বাদ নেওয়ার উজ্জ্বল দিনগুলো যে শৈশব থেকে ভীষণরকম ভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে তা সুন্দর অভিনয় ও নির্দেশনার গুণে নাটকটি সে কথাই বলে গেল।
অনামী থিয়েটার সেন্টার জলপাইগুড়ি সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের গল্প অবলম্বনে সমরেশ ঘোষের নির্দেশনায় উপস্থাপন করলেন তাঁদের অনু নাটক ‘ভারতবর্ষ’। এই নাটকে, এক বৃদ্ধাকে মৃত ভেবে ওনার সৎকার নিয়ে হিন্দু মুসলমানদের হানাহানি, টানাপোড়েন এবং অবশেষে সেই বৃদ্ধার আর্ত চিৎকারের বলিষ্ঠ উচ্চারণ যে তিনি একজন মানুষ আর এটাই সব মানুষের প্রথম পরিচয় এই বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে।
সুকুমার রায়ের গল্প ‘উকিলের বুদ্ধি’ অবলম্বনে দেবব্রত আচার্য্যর নাট্যরূপ ও নির্দেশনায় জলপাইগুড়ি মুক্তাঙ্গন নাট্যগোষ্ঠীর প্রযোজনায় ছোটদের এই নাটকটির হাস্যরস দর্শকদের মন ছুঁয়েছে। সন্দীপ ব্যানার্জীর রচনা ও তন্দ্রা চক্রবর্তীর পরিচালনায় জলপাইগুড়ি দর্পণ- এর প্রযোজনায় নাটক ‘সূর্যোদয়’ বর্তমান স্বার্থপর সময়ের প্রতিচ্ছবি। মাকে তাঁর স্বামীর বাসভবন থেকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর চক্রান্ত ও শেষে শুভাকাঙ্ক্ষীদের হস্তক্ষেপে মায়ের জয় ও নিজের ঠিকানায় বসবাসের আনন্দ ছবি রেখে গেল নাটকটি। জলপাইগুড়ি মাড়োয়ারি বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী একক অভিনয়ে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দেবী চৌধুরাণীর সংক্ষিপ্ত হিন্দি নাট্যরূপটি যে অসামান্য দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলল তা এককথায় অতুলনীয়।
উদীচী নাট্য সংস্থা প্রযোজিত সঞ্জয় কুমার ঘোষ নির্দেশিত ‘অনুরাগ’ নাটকটিও বিশেষ প্রাপ্তি হয়ে রয়ে গেল। রক্তের সম্পর্কের না হয়েও অনাবিল এক আত্মীয়তার বন্ধনের এক উজ্জ্বল ছবি এই নাটক।
‘হলদিবাড়ি কোলাজ’- এর শিশু কিশোরদের নিবেদন ‘প্রাসঙ্গিক’ অত্যন্ত সুন্দর ভাবনার একটি নাটক হিসেবে রয়ে গেল মনে। নাটকটির যাবতীয় বিষয় অর্থাৎ আবহ,মঞ্চ,পোশাক,রচনা ও নির্মাণ সবটাই করেছে দলের শিশু কিশোরেরা। রবীন্দ্র সঙ্গীত নিয়ে নানারকম বিকৃতিকরণের বিরুদ্ধে এই নাটকটি একটি উল্লেখযোগ্য প্রয়াস। সুন্দর বার্তাবহ নাটকটি ছাপ রেখে যায় মনে। জলপাইগুড়ি উজানের পক্ষ থেকে উৎসবে অংশগ্রহণকারী নাট্যদলগুলোকে শুভেচ্ছা স্মারক ও গাছের চারা দিয়ে সম্মান জানানো হয়।
মনোজ্ঞ এই নাট্যসন্ধ্যায় সম্পূর্ণ অনুষ্ঠান জুড়ে রুচির ছাপ, সুন্দর সঞ্চালনা, সর্বোপরি আন্তরিকতা ছুঁয়ে গেছে দর্শকদের। আরো অনেক পনেরোর উজানে পাল তুলে আলোর পথচলা জারি থাকুক । আরও বেশি মানুষকে মঞ্চ টেনে আনুক দর্শক হিসেবে।