বিজয়কুমার দাস
থিয়েটারে নতুন প্রজন্ম : পর্ব ৩৩
এই মুহূর্তে বাংলা থিয়েটারের মঞ্চে নতুন প্রজন্মের যে কয়েকজন অভিনেতা অভিনেত্রী অভিনয় প্রতিভার নজির সৃষ্টি করেছে তাদের মধ্যে অঙ্কিতা দাস উজ্জ্বল মুখ অবশ্যই। থিয়েটারটা তার কাছে সৌখিন মজদুরি নয়, বেঁচে থাকার মন্ত্র। থিয়েটার করার ইচ্ছেটা তার জন্মেছিল সেই স্কুল জীবন থেকেই। অমলচন্দ্র দাস ও অপর্ণা দাসের মেয়ে অঙ্কিতা ছোট থেকেই দেখেছে, তার বাবা সরকারী চাকরি করার পাশাপাশি নাটক, যাত্রা করতেন। হয়তো সেখান থেকেই স্বপ্ন দেখা শুরু হয়েছিল থিয়েটার করা নিয়ে।যদিও একসময় ভেবেছিল, নাচ নিয়ে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনো করবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত থিয়েটারের পথেই হাঁটা শুরু হয়েছে অঙ্কিতার।
স্কুলে পড়ার সময় নাট্যচর্চার সঙ্গে তেমন যুক্ত না থাকলেও স্কুল জীবনেই তার প্রথম নাটকের জন্য মঞ্চে নামা। যদিও নাট্যচর্চা বলতে যা বোঝায়, তা শুরু হয়েছিল ২০১৭ সাল থেকে। তাই নাচ নিয়ে পড়াশুনোর ইচ্ছেটাকে সরিয়ে রেখে থিয়েটার নিয়ে পড়াশুনোর পথই বেছে নিয়েছিল সে। কলকাতার মঞ্চে অঙ্কিতা এখন দাপিয়ে অভিনয় করছে। বেথুয়াডহরিতে থাকার সময় সেখানকার দেশবন্ধু স্মৃতি পাঠাগারের আয়োজনে ৪৫ বছর ধরে যে একাঙ্ক নাটকের প্রতিযোগিতা হত, অঙ্কিতা ছোট থেকেই সেই উদ্যোগের সাথে জড়িয়ে ছিল।অঙ্কিতা মনে করে,হয়তো সেই সূত্রেই থিয়েটার করার ইচ্ছেপাখিটা তার মনের কুঠুরিতে বাসা বেঁধেছিল।
২০১৮ সালে কয়েকজন বন্ধু মিলে একটা নাটকের দল তৈরি করে নাট্যচর্চা শুরু করেছিল। নাটক নিয়ে পড়াশুনো করার ইচ্ছেটা তখন থেকেই।সাহস জুগিয়েছিলেন কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী। এছাড়া তার এক পিসি পুতুল চক্রবর্তী ও এক জেঠু কালিশঙ্কর কর্মকারকে দেখে এই পথে এগিয়েছিল অঙ্কিতা। আজ সেই পথে অঙ্কিতা নিজের কৃতিত্বের নিশান নিজেই উড়িয়েছে। কলকাতার বেশ কিছু নাট্যদলে অভিনয় করে নিজের জাত ও দক্ষতাকে চিনিয়েছে সে। The Selfish Giant তার অভিনীত প্রথম নাটক। সেই অঙ্কিতা বাংলা থিয়েটারের মঞ্চে চেতনা নামে ঐতিহ্যবাহী দলের সাম্প্রতিক প্রযোজনা সুজন মুখোপাধ্যায় নির্দেশিত “মেঘে ঢাকা ঘটক” নাটকে বঙ্গবালা চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকের নজর কেড়ে নিয়েছে। এছাড়া বেশ কিছু দলের বেশ কিছু নাটকে অভিনয় করে বুঝিয়ে দিয়েছে,সে থিয়েটারে থাকতেই এসেছে।
বেশ কিছু নাট্যদলে অভিনয় করেছে ইতিমধ্যেই। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল : সংস্তব, বীক্ষণ, সুন্দরম, কসবা অর্ঘ্য, চেতনা, কার্টেন কল, হিপোক্রিটস, ইচ্ছে কলকাতা, শ্যামবাজার নাট্যচর্চা কেন্দ্র, দেশবন্ধু স্মৃতি পাঠাগার, বালি অগ্লাম, বেথুয়াডহরি লিটল থিয়েটারের তিলোত্তমা ফোক প্রোডাকশন দোলতলা নাট্যশালা, বে – রে – থি। তালিকার দিকে তাকালে সহজেই বোঝা যায় থিয়েটারকে সে কতটা গভীরভাবে থিয়েটারকে গ্রহণ করেছে। এভাবেই থিয়েটারের পথে এগিয়ে চলেছে অঙ্কিতা।

এ পর্যন্ত অনেক নাটকে অনেক চরিত্রে অভিনয় করলেও “অপরাজিতা” চরিত্রটি তার প্রিয় চরিত্র। রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার সময় নীতিশ সেনের “অপরাজিতা” নাটকে অভিনয় করেছিল। সেই অপরাজিতা চরিত্রটিই তার প্রিয় চরিত্র। তার কারণ হল, এই চরিত্রটি সংসারের জটিলতাগুলো খুব সহজে প্রকাশ করে দেয়। অবশ্য তার পরে বিভিন্ন মঞ্চে বিভিন্ন নাটকে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করলেও অপরাজিতাই এখনও অঙ্কিতার কাছে অপরাজিতা হয়ে আছে। থিয়েটারে মন প্রাণ সমর্পণ করে থিয়েটার করে চলেছে অঙ্কিতা। বিভিন্ন বিশিষ্ট পরিচালকদের অধীনে কাজ করে চলেছে।
কিন্তু থিয়েটার করে কি বাঁচা যায়? ….এই প্রশ্নের উত্তরে অঙ্কিতা জানিয়েছে, “আমি তো শুধু থিয়েটার করেই বেঁচে আছি।” …তবু সে মনে করে,এখনও অনেক শেখার বাকি আছে। সে মনে করে, এই মূহুর্তে থিয়েটার করে সে যেটুকু অর্থ উপার্জন করছে, তাতে কলকাতা শহরে থাকার পক্ষে হয়তো উপযুক্ত নয়, তবু সে আশাবাদী। সে বিশ্বাস করে, মন প্রাণ দিয়ে এই শিল্পের জন্য জড়িয়ে থাকলে নিশ্চয় একদিন এমন দিন আসবে যখন তার মনে হবে,থিয়েটার করেও বেঁচে থাকা যায়। …বাড়ির মানুষজনের যথেষ্ট সমর্থন আছে তার থিয়েটারে অভিনয় করার জন্য। সে মনে করে, এই সমর্থনটা না থাকলে এই শিল্পের সঙ্গে গাঁটছড়াটা দৃঢ় হত না।তাকানো যাক অঙ্কিতা অভিনীত নাটকগুলির দিকে : অরকূটে যুক্ত হল বাল্টিমোর আর নদীয়া, মগজ, উড়ন্ত তারাদের ছায়া, আন্তিগোনে celebration of the protest in the Actor’s body, ঘোড়ামুখো পালা, আতঙ্কের দিনগুলি, ভারত ভাগ্য বিধাতা, দুই বিঘা জমি, ঊরুভঙ্গম, ঝিলিমিলি আঁকাবাঁকা, মেঘে ঢাকা ঘটক, তবে তাই, গন্ধজালে পাগলা ঘোড়া, জোড়াসাঁকো, সাঁওতালবিদ্রোহ, ফিনিক্স, দুই সতীনের পালা, মহড়া বিসর্জন, বাদশা বেগম, প্রভাত ফিরে এসো, দন্তরঙ্গ, লোনা বালি তীর ধরে, তাহার নামটি রঞ্জনা, নিতান্ত ব্যক্তিগত, রাধারাণীর জীবন লীলা, স্বপ্নফেরি, ইনসাফ, এই মুহূর্তে, অন্য বসন্ত, লাহু, The selfish giant, চক্রান্তের ফাঁসে নারী সমাজ, দুমুখো, দেবী সর্পমস্তা, এক মুক্ত পৃথিবীর সন্ধানে, অষ্টক, বিষহারা, অপরাজিতা ইত্যাদি। “রাধারাণীর জীবন লীলা” নাটকটি তার পরিচালিত প্রথম নাটক। অভিনয় নিয়ে পড়াশুনো করা স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ অঙ্কিতা তাই অভিনয়কেই বেছে নিয়েছে বেঁচে থাকার জন্য। মা বাবার সমর্থন তার পাথেয় ও প্রেরণা। শিশু বিদ্যামন্দির, বেথুয়াডহরি জেএসএম হাই স্কুল এর পর রেণুকাদেবী কলেজ অফ এডুকেশন থেকে ডি এল এড, মুরাগাছা থেকে বাংলায় স্নাতক, পরে রবীন্দ্র ভারতী থেকে নাটক নিয়ে স্নাতকোত্তর অঙ্কিতা মন প্রাণ সমর্পণ করে এভাবেই এগিয়ে চলেছে থিয়েটারের পথে।