বিজয়কুমার দাস
থিয়েটারে নতুন প্রজন্ম : পর্ব ৩১
কোন্নগর কানাইপুরের মেয়ে পারমিতা সাহা। সেখান থেকে থিয়েটারের জন্য,থিয়েটারের প্রয়োজনে তার কলকাতায় নিত্য যাতায়াত। রবীন্দ্রনাথ সাহা ও অনিতা সাহার দুই মেয়ের অন্যতমা হল পারমিতা। যার ছোট থেকেই ইচ্ছে ছিল থিয়েটারে যুক্ত হওয়া। নিজের চেষ্টায় তার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। প্রতিদিনের অনেকটা সময় তার কেটে যায় থিয়েটারের জন্য, থিয়েটারের কাজে। শুধু অভিনয় নয়, থিয়েটারের অন্য কাজের জন্যও তাকে যাতায়াত করতে হয়। কিন্তু এই পরিশ্রমটা সে করে হাসিমুখেই। সে মনে করে, একটা শিল্পকে ভালবাসলে তার জন্য অনেকটা সময় দিতে হয়।
উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে কলেজে ভর্তি হলেও কলেজের পড়া সম্পূর্ণ হয়ে ওঠেনি পারমিতার। কানাইপুর কন্যা বিদ্যাপীঠ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে যদিও ভর্তি হয়েছিল শ্রীরামপুর গার্লস কলেজে। পারমিতা জানিয়েছে, কিছু কারণবশত তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা সম্পূর্ণ করতে পারেনি সে।
পারমিতার কাছে জীবনের সব ক্ষেত্রেই মা তার প্রেরণার উৎস। এই যে প্রায় ৮ বছর সে থিয়েটারে যুক্ত আছে, সে ক্ষেত্রেও মা তার প্রধান পথপ্রদর্শক। তাই পড়াশুনোর পাশাপাশি ছোট থেকেই সেলাই, নাচ, গান, আঁকা, আবৃত্তি ইত্যাদির সঙ্গে সে যুক্ত ছিল।শুধু তাই নয়,সবকিছুই সে গভীর ভালবাসার সঙ্গে করত। ঠিক তেমনই থিয়েটারে যুক্ত হয়ে শুধুমাত্র অভিনয় নয়,তার পাশাপাশি সব কাজেই সে প্রয়োজনে হাত লাগায়। বছর আটেক থিয়েটারে যুক্ত থাকার সূত্রে তার মনে হয়েছে, মঞ্চ, দর্শক, অভিনেতা, সেট, আলো, মিউজিক এগুলোর অদ্ভুত মিলনে থিয়েটার নামক শিল্পটা এক অদ্ভুত আনন্দের জগৎ। এখানে নিজেকে আবিষ্কারের একটা আনন্দ আছে।
কলকাতার টেন্থ প্ল্যানেট দলটির সঙ্গে সে বছর তিনেক যুক্ত আছে। ২০২২ সালের ২৯ জুন সে প্রথম এই দলে পা রেখেছিল। পারমিতা জানিয়েছে, যখন পুরোপুরিভাবে থিয়েটারে যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্তটা সে নিয়েই ফেলে তখন খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারে, বোনের বন্ধু নটধা দলে থিয়েটার করে। নটধায় তখন “মহাভারত ২” নাটকের জন্য দলে অভিনেতা অভিনেত্রী নেওয়া হচ্ছিল। যোগাযোগ করে পারমিতা জানতে পারে, ছ মাসের কর্মশালায় যোগ দিতে হবে।কিন্তু নানা কারণে সেটা হয়ে ওঠেনি পারমিতার। যদিও এই নটধা দলের প্রথম নাট্য বিদ্যালয়ের ব্যাচের ছাত্রী হতে পেরেছিল সে। সেখানে তিন মাস নাট্য বিদ্যালয়ের ক্লাসই তার অভিনয় জীবনের হাতেখড়ির সময়।
নটধার নাট্য বিদ্যালয় থেকে উত্তীর্ণ হয়ে কয়েকজন মিলে সপ্তনট নামে একটা দল তৈরি করেছিল তারা। সেখানেও কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে তার থিয়েটার সম্পর্কে। সপ্তনট গড়ে তোলার পরে থিয়েটারের কাজ করতে করতে তার মনে হয়েছিল, সেখানে সঠিক অভ্যাস হচ্ছে না। এই সময়েই এক বন্ধু মাধ্যমে সে জানতে পারে টেন্থ প্ল্যানেট দলের নাম। পারমিতা নিজেই যোগাযোগ করে টেন্থ প্ল্যানেট এর সঙ্গে। তার পর থেকে এখনও পর্যন্ত সে টেন্থ প্ল্যানেট দলের সঙ্গে যুক্ত আছে। সেখানেই থিয়েটারের কাজ করছে। অভিনয়ের পাশাপাশি থিয়েটারের আনুষঙ্গিক কাজের সঙ্গেও সে নিজেকে যুক্ত করেছে।

এই পারমিতা “চন্ডালিকা” নৃত্যনাট্যে স্কুলের হয়ে অংশ নিয়েছিল।যখন সে সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। চন্দননগর রবীন্দ্র ভবনে তাদের স্কুল থেকে সেই নৃত্যনাট্য হয়েছিল। পারমিতা মনে করে, সেখান থেকেই তার মঞ্চমায়া শুরু। সপ্তনট দলে যুক্ত থাকার সময় কলকাতার মুক্তাঙ্গন মঞ্চে “ক্ষত” নামে একটি নাটকে যুক্ত ছিল পারমিতা। এরপর টেন্থ প্ল্যানেটে আসার পর প্রথম “বীজ – a reconstrucotion” নাটকে অভিনয়। সেটা অভিনীত হয়েছিল অশোকনগরে অমল আলো র ইন্টিমেট স্পেসে।
পারমিতা জানিয়েছে, নাটকে চরিত্র নিয়ে তার বাছবিচার নেই। সব চরিত্রকেই সে প্রিয় চরিত্র মনে করে।তবে এখনো পর্যন্ত অভিনীত চরিত্রগুলোর মধ্যে টেন্থ প্ল্যানেট এর প্রযোজনা “এপিটাফহীন মৃত্যু” নাটকের “প্যালেগাঁ” চরিত্রটিতে অভিনয় করতে তাকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে বলে সে জানিয়েছে। “গ্যালিলিও” নাটকের ভার্জিনিয়া চরিত্র করতে যেমন পরিশ্রম করতে হয়েছে, তেমনি “থ্রী পেনি অপেরা” নাটকে লুসি চরিত্রে অভিনয় করতে সে বেশ মজা পেয়েছে বলে জানিয়েছে।
কয়েক বছর থিয়েটারে যুক্ত থেকে বিভিন্ন চরিত্রে মঞ্চে নেমে, দর্শক প্রতিক্রিয়ায় থিয়েটার জগৎ সম্পর্কে তার যে ধারণা হয়েছে তা তার কাছে অসাধারণ বলে মনে হয়েছে।সে অনুভব করেছে, মনের আনন্দে থিয়েটার করে যাওয়াটা এক অদ্ভুত আনন্দের জগৎ। তবে তার মনে হয়,শুধু থিয়েটার করে বাঁচা যায় না। সঙ্গে কিছু না কিছু করতে হয়।তার এই থিয়েটার জীবনে সে সবসময় মা ও বোনকে পাশে পেয়েছে। কিন্তু সে জানে, মধ্যবিত্ত সংসারে মেয়েদের যাই শেখানো হোক সবই বিয়ের তালিকায় মান বাড়ানোর জন্য। সেখান থেকে বেরতে অনেক ঝড় ঝাপটা সামলাতে হয়। তবু থিয়েটারটা করে যাচ্ছে পারমিতা।তার একদিন প্রতিদিন সবই এখন থিয়েটারকেন্দ্রিক। বাড়ির লোকে বাধা দেয় না, এটাই তার কাছে স্বস্তির বিষয়।
সপ্তনট দলে পারমিতা অভিনয় করেছে যেসব নাটকে সেগুলি হল : বন্দী, ক্ষত, ঈশ্বর কোথায়। শরণ্য দে-র টেন্থ প্ল্যানেটে তার অভিনীত নাটকগুলি হল : বীজ – a reconstruction, গ্যালিলিও, ম্যাকবেথ, ঠান্ডা গোস্ত, এপিটাফহীন মৃত্যু, গাংচিল। নটধা তার কাছে থিয়েটার শেখার প্রথম ক্ষেত্র। আর টেন্থ প্ল্যানেটে নির্দেশক শরণ্য দে র কাছে সে প্রতিনিয়ত শিখে চলেছে বলে জানিয়েছে।
এভাবেই থিয়েটারের সঙ্গে জুড়ে আছে পারমিতা। জুড়ে থাকতে চায়।