বিজয়কুমার দাস
থিয়েটারে নতুন প্রজন্ম : পর্ব ১২
কলকাতার ছেলে রাহুল বোস থিয়েটারে জড়িয়ে আছে ১০ বছর। তার এই থিয়েটারে জড়িয়ে যাওয়াটার একটা গল্প আছে। আসলে ছোটবেলায় থিয়েটার নয়, রাহুলের আগ্রহ ছিল অঙ্কনে। ছোট থেকেই তার ছবি আঁকার শখ ছিল। বাবাকে রাহুল হারিয়েছিল ছেলেবেলায়। মায়ের কাছে বাবার গল্প শুনতে শুনতে সাদা কাগজে আঁকিবুকি কাটা রাহুল হঠাৎই জড়িয়ে গেল থিয়েটারে। কলকাতার কসবার ছেলে রাহুল।সেই কসবায় বেশ কিছু নাটকের দল তো ছিলই রাহুলের কৈশোরকালে, যৌবনে। একদিন পাড়াতেই একটা ছবি আঁকার প্রতিযোগিতায় যাওয়ার পথে চোখে পড়ল একটা নাটকের পোস্টার। খ্যাতির বিড়ম্বনা এবং একান্নবর্তী পরিবার নাটক হবে। নির্দেশক জয়ন্তদীপ চক্রবর্তী ও কৃতি কাঞ্জিলাল। পারিবারিক সূত্রে জয়ন্তবাবু রাহুলের চেনা। সেই জয়ন্তদীপবাবুর হাত ধরেই থিয়েটারে যুক্ত হয় রাহুল। আঁকায় অভ্যস্ত রাহুলের মনে ইচ্ছা জাগে থিয়েটারে যুক্ত হয়ে নিজেকে সবার কাছে আরো মেলে ধরার। সেই জয়ন্তদীপ চক্রবর্তীই তার থিয়েটারের প্রথম পথপ্রদর্শক। তিনি তখন সুনীলনগর ড্রামা সেন্টার এবং তিলজলা ঋতু দলের নির্দেশক। জয়ন্তবাবুর হাত ধরে থিয়েটারে যুক্ত হয়ে পড়ল রাহুল। থিয়েটার নিয়ে আরো বেশি করে জানা, নিজেকে থিয়েটারকর্মী হিসাবে গড়ে তোলার ইচ্ছাটা তার বাড়ল বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। জয়ন্তবাবুর কাছেই রাহুল জেনেছিল, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক নিয়ে পড়ার সুযোগ আছে। রবীন্দ্রভারতীর নাটক বিভাগে স্নাতক স্তরে (২০১৬-১৯) সুযোগও পেয়ে গেল। শুরু হল থিয়েটারকর্মী হয়ে ওঠার লড়াই। পাশাপাশি থিয়েটারে অভিনয়ও চলতে থাকল।একটা নতুন জগৎকে যেন আবিষ্কার করে ফেলল। শুরু করল নাটকের ফ্রীল্যান্সিং। জয়ন্তদীপবাবুর নির্দেশনায় বেশ কিছু নাটকে অভিনয়ও করল। ছদ্মবেশ দলে করে: অলৌকিক সংলাপ, এস এন ডি সি দলে এখনো রাজর্ষি, হিং টিং ছট, তিলজলা ঋতু দলে বাঘরাক্ষসের বৃত্তান্ত, অন্য রাজার গল্প, জামাই আদর, ধনকুঁন্দরা, এত রক্ত কেন?…. তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। তবে নির্দেশক হিসাবে জয়ন্তদীপ চক্রবর্তীই তাঁর এইসব নাটকের নির্দেশক ও প্রেরণাদাতা হিসাবে যুক্ত।
রবীন্দ্র ভারতীতে পড়তে পড়তে থিয়েটারের জগৎটা রাহুলের কাছে একটা আকাশের মত উন্মীলিত হয়ে উঠল। এখানে ড: তরুণ প্রধান, সিদ্ধার্থ চক্রবর্তী, মোনালিসা চ্যাটার্জীর মত নাট্যজনের সান্নিধ্যে সমৃদ্ধ হল রাহুলের থিয়েটারের জগৎ। এই সময় বন্ধু কলিঙ্গ ও শুভময়ের মাধ্যমে শুভজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে যোগাযোগের সূত্রে তাঁর দলের তোমার ডাকে এবং নাথিং টু শে নামে দুটো নাটক দেখে আধুনিক থিয়েটার সম্পর্কে রাহুলের একটা আগ্রহ জন্মায়। একবার নয়, অন্তত এই নাটকের ১০-১২ টা শো দেখে রাহুল। শুভজিৎবাবুর সঙ্গে আন্তরিক যোগাযোগ ঘটে। তিনি তাঁর নিজের দল থিয়েটার শাইন এর একটা কর্মশালায় রাহুলকে যুক্ত করেন।থিয়েটার শাইন এর “অপেক্ষায় অপেক্ষায়” নাটকে অভিনয়ের সুযোগ পায় রাহুল। স্যামুয়েল বেখট এর waiting for godot অবলম্বনে অনির্বাণ সেনের লেখা নাটক এটি। এছাড়াও থিয়েটার শাইনে ম্যাকভূত, অন্বেষক দলে মারী the great (নাটক : অনির্বাণ সেন, নির্দেশনা : শুভজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়) নাটকে অভিনয় করে থিয়েটার জগতের এক নতুন দিগন্ত খুলে গেল রাহুল বোসের কাছে। ইতিমধ্যে রবীন্দ্র ভারতী থেকে “অভিনয়” বিশেষ পত্র সহ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি যুক্ত হল রাহুলের জীবনে।
থিয়েটার নিয়ে এভাবে মেতে ওঠা রাহুলের জীবনে এর পর কিছুকাল নানা কারণে বিরতি। হয়তো নতুন করে কিছু ভাবনা বা প্রস্তুতির জন্য এই বিরতি – এমনও হতে পারে। তার প্রতিফলন ঘটল বিরতির পরেই নিজেই বোস ক্রিয়েটিভ এন্ড পার্ফমিং আর্টস নামে নাটকের দল তৈরি করল। শুরু হল স্বতন্ত্র ভাবনার প্রকাশ থিয়েটারে ঘটানোর আর এক যাত্রাপথ। একক নাটক দিয়ে পথ চলা শুরু নিজের দলের। লাকিজি গুপ্তার থিয়েটারেও প্রভাবিত হল রাহুল। ২০২৩ এ নাইট মিরর নাটকে স্বতন্ত্রভাবে আত্মপ্রকাশ ঘটল নির্দেশক এবং দলের কর্ণধার রাহুলের। ছদ্মবেশ, সুনীলনগর ড্রামা সেন্টার, তিলজলা ঋতু, হাজরা অদিতি,থিয়েটার শাইন,পারমিক ব্যারাকপুর, দমদম স্বপ্নচারী, অন্বেষক (বজবজ) প্রভৃতি দল পরিক্রমার পর নিজের দলে থিতু হল রাহুল বোস।
থিয়েটারে একজন ভাল মানুষ হয়ে বাঁচার স্বপ্ন তার চোখে। স্টার তোষামোদ, গ্রান্ট নিয়ে দলাদলি থেকে মুক্ত হয়ে নতুনদের নিয়ে নতুন নাটক নির্মাণে নিজেকে নিযুক্ত করেছে রাহুল। নাইট মিরর এর অনেকগুলি শো হয়ে গেছে। হ্যালো শুনতে পাচ্ছ, প্রজাপতি ডট কম নামে দুটি নাটকও নির্মাণ করেছে বোস ক্রিয়েটিভ এন্ড পার্ফমিং আর্টস দলের প্রযোজনা হিসাবে। নাটকের রিহারসাল হয় তার নিজের বাড়িতেই। বাড়ির মানুষজন যথেষ্ট প্রশ্রয় দেয় বলেই থিয়েটারের এতটা পথ সে আসতে পেরেছে বলে জানিয়েছে রাহুল বোস।প্রায় ৩০ টা নাটকে বিভিন্ন দলে অভিনয় করার অভিজ্ঞতা নিয়ে নিজে দল তৈরি করেছে। পরপর শো হচ্ছে নাটকের।
তার থিয়েটার জীবনে জয়ন্তদীপ চক্রবর্তী ও শুভজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রভাব সে শতমুখে স্বীকার করে। তাঁদের হাত ধরেই ছেলেবেলায় সাদা পাতায় আঁকিবুকি কাটা রাহুল নামের ছেলেটি পরবর্তীতে যে থিয়েটারকে সে জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছে সেই ভাল থিয়েটারের জন্য লড়াইটা সে চালিয়ে যেতে চায়। ছেলেবেলার সেই আঁকিয়ে রাহুল এখন থিয়েটারের রাহুল বোস।