ইয়োন ফসে
লেখক, নাট্যকার- নরওয়ে
(বাংলা অনুবাদক- ব্রতীন রায়, ভারত)
প্রত্যেক ব্যক্তিই অন্য কারোর মতো, তবু অনন্য। এটি বেশ ভালো যে আমরা অন্যের থেকে পৃথক। কিন্তু আমাদের প্রত্যেকের অন্তরঙ্গে কিছু আছে যা একান্ত নিজস্ব। আমরা এটাকে সত্তা বা মন বলেত পারি। আবার বিশেষ কোনো শব্দে না বেঁধে উন্মুক্তও রাখতে পারি।
তবে একে অন্যের থেকে পৃথক হয়েও আমরা সাযুজ্য বজায় রাখি। পৃথিবীর সব প্রান্তের মানুষই ভাষা, বর্ণ, চুলের রং নির্বিশেষ মূলগত ভাবে অভিন্ন।
এর মধ্যে হয়তো একটি বিরোধাভাষ আছে যে একই সঙ্গে আমরা সম্পূর্ণ এক এবং ভীষণভবে আলাদা। দেহ এবং মনের যে বাস্তবিক এবং ষ্পৃশ্য অস্তিত্ব তার সাথে আমরা সেতুবন্ধন করতে চাই পরমার্থিকের যা বস্তুগত সত্তাকে অতিক্রম করে এবং সেক্ষেত্রে মানুষের ভূ্মিকা অন্তর্গতভাবে বৈপরীত্যে পূর্ণ বলে প্রতিভাত হতে পা্রে।
শিল্প, বিশেষত অর্থপূর্ণ শিল্পকর্ম অনিন্দ্য সুন্দরভাবে অনন্যের সাথে বৈশ্বিক-এর মিলন ঘটায়। এটি আমাদের বুঝতে সাহায্য করে বৈশ্বিক হওয়ার সাথে সাথে তফাতের জায়গাটা কোথায় বা বহিরাগত উপাদানগুলি কি। এটি অর্জন করতে গিয়ে শিল্প ভেঙে ফেলে ভাষার সীমানা। পার হয়ে যায় ভৌগোলিক অংশ তথা দেশের গণ্ডি। এটি শুধুমাত্র প্রত্যেক ব্যক্তির স্বতন্ত্রতাকে একত্রিত করে না, বৃহদার্থে প্রত্যেক গোষ্ঠীবদ্ধ ও জাতিভুক্ত মানুষের ঐশী সত্তাকে যূথবদ্ধ করে।
এটা করতে গিয়ে শিল্প তফাৎ বা সাদৃশ্যের জায়গাগুলোকে একমাত্রিক করে ফেলে না, বরং দেখিয়ে দেয় আমাদের থেকে কোনটা পৃথক, সংযোগহীন বা দূরবর্তী। যেকোনো ভালো শিল্প-কর্ম এসব আপাত সংযোগহীনতাকে ধারণ করে যাকে আমরা পুরোপুরি অনুধাবন করতে না পারলেও কিছুটা আত্মস্থ করি। যেন এটা কোন রহস্যের ধারক যা আমাদের বিমুগ্ধ করে, তাড়িত করে নিজেদের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে এবং এই প্রক্রিয়ার মাধ্যেম সে জন্ম দেয় এক উৎকর্ষতার যা প্রত্যেক শিল্পের আধার এবং যার দিক শিল্প আমাদের নিয়ে যায়।
এভাবে বিপরীতমুখী উপাদানকে কাছে আনার চেয়ে ভালো কোন মাধ্যমের কথা আমার জানা নেই। আধুনিক বিশ্বে আমরা প্রায়শই দেখি হিংসাত্মক বিরোধিতা ধ্বংসাত্মক রূপ নিয়ে যা কিছু পৃথক, বহিরাগত এবং অনুপম তাকে মুছে দিতে উদ্যত। আর এই কাজে সহায়তা করে চূড়ান্ত অমানবিক সব আবিষ্কার, প্রযুক্তির দৌলতে যা আমাদের হাতের মুঠোয়। শিল্প ঠিক এর উল্টো কাজ করে। পৃথিবীতে সন্ত্রাসবাদ আছে, আছে যুদ্ধ কারণ মানু্ষের মধ্যে একটি জান্তবতা কাজ করে- যা প্রণোদিত হয় পৃথক বা ভিনদেশী যা কিছু তার সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা লাভের স্বাভাবিক প্রবণতা থেকে। পৃথক অস্তিত্বসমূহের কাছে এটি আতঙ্কের। একে কখনোই চিত্তাকর্ষক রহস্যের সাথে তুলনা করা যায় না।
এভাবেই আস্তে আস্তে হারিয়ে যায় বৈচিত্র যাকে আমরা ভিন্নতা বলি, রেখে যায় সামূহিক অভেদ যেখানে সকল পৃথকই একটা আতঙ্ক যাকে নিধন করতে হবে। বাইরে থেকে যাকে দেখলে পৃথক বলে মনে হয়, রাজনৈতিক মতবাদ, ধর্ম এসব যেকোনো ক্ষেত্রেই, সেগুলি সবই হয়ে ওঠে নির্মূল করার বা পরাস্ত করার লক্ষ্যবস্তু।
আমাদের অন্তরে যা কিছু নিমগ্ন রয়েছে অনন্য রূপে তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নাম হল যুদ্ধ। তাই লড়াইটা সরাসরি শিল্পের বিরুদ্ধে এবং সব শিল্পের গভীরে যা নিহিত আছে তার বিরুদ্ধে।
আমি এখানে বিশেষভাবে নাটক বা নাটেকের কথা না বলে সামগ্রিকভাবে শিল্প সম্বন্ধে কথা বলছি। কারণ, ইতিমধ্যেই যেটা বলেছি, সকল ভালো শিল্পকর্ম তার অন্তঃস্থলে একটা বিষয়কে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয় আর সেটা হলো যা সম্পূর্ণভাবে মৌলিক, নির্দিষ্ট সেই বিশেষকে শৈল্পিকভাবে প্রকাশ করে বহির্বিশ্বের সাথে সংযুক্ত করা এবং সর্বজনীন করা ; তার বিশেষতাকে নিশ্চিহ্ন না করে, তাকে জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করা – যাতে যা কিছু ভিন্ন, বহিরাগত, অচেনা তা যেন উজ্জ্বলতায় ভাস্বর হয়।
শিল্প আর যুদ্ধের অবস্থান বিপ্রতীপ, ঠিক যুদ্ধ আর শান্তির মতো। খুব সহজ করে বললে, শিল্পই হল সেই শান্তি।