দুলাল চক্রবর্ত্তী
উত্তর কলকাতার থিয়েটার পুস্পক সংস্থা প্রযোজিত ‘যাঃ, সব ভন্ডুল’ শীর্ষক নাটকটি দেখলাম। বর্তমানে কমেডি নাটকের সংখ্যা হাতে গোনা। চিরদিনই এই অভাব আছে। সেই অভাব দূর করল এই ঘণ্টা খানেকের হইহই নাটকটি। তপন থিয়েটারে ২৭ জানুয়ারি রাত্রি প্রায় পৌঁনে বারোটায় এই নাটকের মঞ্চায়ন হয়েছিল। এদিন এই নাটকের ৮ম অভিনয় হয়েছিল। অনেক গুণী শিল্পী-সহ নতুনদের সবাইকে নিয়ে নির্দেশিকা আলোকপর্ণা গুহ নাটকের কাজে তাঁর নৈপুণ্য দেখালেন। সঙ্গ দিয়েছেন বিশিষ্ট নির্দেশক এবং অভিনেতা মুরারী মুখোপাধ্যায় ও বিশিষ্ট প্রবীণ মহিলা পরিচালক তথা অভিনেত্রী ভদ্রা বসু স্বয়ং।
‘থিয়েটার জেগে থাক সারা রাত এবং জেগে থাক ২৪ ঘণ্টা’ এই মর্মের, কলকাতা মিউনাস সংস্থা আয়োজিত মহিলা পরিচালিত ২৫টি নাটকের অভিনয় উৎসবের ৭ম মঞ্চায়ন এই নাটক। এক কথায়, নির্মল আনন্দে ভরা দমফাটা হাসির নাটক “যাঃ সব ভন্ডুল”। উল্লাস মল্লিকের গল্পের সরাসরি ইম্প্রভাইজড সৃষ্টি। নানা রকমের মজাদার দৃশ্যের ইম্প্রেশন রেখে গেল যাঃ, সব ভন্ডুল নাটক। তবে শেষের কিছু বাজারি-হাজারি চটুলতা এসে মজার কিছুটা তরলও করে ছিল। যা বাদ দিলে এমন চমৎকার নাট্য নির্মাণ সচরাচর চোখে পড়ে না। সকলের অভাবনীয় অভিনয়, যার সম্পদ। কেউ কারো থেকে কম নন। চরিত্র অনুযায়ী চমৎকার অভিব্যক্তি, সুন্দর বডি লাঙ্গুয়েজ, দুরন্ত উদ্ভাবনী সব ম্যানারিজম এবং বিহেভ প্যাটার্ন। অতি অল্প সময়েই নতুন সমস্যার দৃশ্য সৃজন, যেমন গড়ছে, তেমনই ভেঙ্গে আবার নতুনভাবে গড়ে উঠছে।
এই ভাঙ্গাগড়ায় আমাদের এই সময়ে শহুরে সম্পর্ককে লজ্জা দিয়ে যায় সহজ সরল রাজনীতিহীন কিছু নবীন প্রবীনের অটুট বাঁধুনি। যেখানে সমবেত পারা না পারার লজ্জা থাকলেও নেই তেমন একাকী হবার সম্ভাবনা। এসো মিলেমিশে থাকি, হারি-জিতি এই প্রজ্ঞায় যাঃ সব ভন্ডুল, শুধু হাসির আড়ালে বিচিত্র বোধের মিলনাত্মক ভাবনাও দিয়ে যায়। গল্পটা ছিল এরকম, আমোদপুর গ্রামের নাট্য দল “লঘু গুরু নাট্য সম্প্রদায়”। তারা দুর্গা পূজার সময় পূজা প্যান্ডেলে মঞ্চস্থ করার তাগিদে প্রতিবছর সৌখিন নাটক তৈরি করে থাকে। এটা গ্রাম্য চর্চা। অভিনয় হবে। কিন্তু অভিনয়ের বিন্দুবিসর্গ কেউই জানে না। তথাপি এদের নিয়েই নাটকের চর্চা চলে। সেই চর্চার জন্যে নির্ধারিত মহলার স্থানের বড্ড অভাব। নেই কিছুই। কিন্তু ইচ্ছা আছে। আছে সবার বার ঘর এক উঠোন জীবন যাপন। এমত অবস্থায় এবার মিছরি দিদার উঠোনের এক পাশে মহলা দেবার সিধান্ত হয়।
প্রতিদিন মহলা চলে। গ্রামের স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা মায় শিক্ষক-শিক্ষিকারাও তাতে অংশ নেয়। পুজোর সময় বিনোদনের হেতুতে আনন্দিত জীবনের স্বাদ পেতেই সবাই জড়িয়ে পড়ে। মেতে ওঠে নিজেকে দশজনের সামনে কিছু করে দেখাতে। আর এই সততার জানান দিতেই শিক্ষক ছাত্রেরা নিজেদের ব্যক্তিত্ব ভেদাভেদ ভুলে নাটকের সাথে যুক্ত হয়। যাতে আবার সব রকম সাহায্য করে গ্রামের সব মানুষ। এ বছরের নাটক নির্বাচিত হয়েছে “লংকা পুরী ওলট পালট”।
এই শুরু হওয়ার এখন থেকেই নাটকের শুরু। মহলা থেকে মঞ্চায়ন অবধি। কাজেই নাটক ভাল করার খাতিরে চরিত্র বন্টন থেকে যথাযথ হয়ে ওঠার এক বিরাট পর্ব চলতে থাকে। ঝগড়া খুনসুটি বিবাদ বিতন্ডা এই সব নিয়ে….কি যে ঝম্পট চলে, কি যে বিড়ম্বনার সৃষ্টি হয়। নাটকের অভিনয়ের দিন সকলের অভিনয় শেষমেশ কি চেহারা নেয়। ইত্যাদি নিয়ে, শিক্ষক ছাত্রের ভেদাভেদ দূর করে এই দুর্দান্ত ঝামেলার কাজ সুসম্পন্ন করতে পরিচালককে কী কাল ঘাম ছোটাতে হয়! সেসব নিয়েই অনবদ্য মজার ও মজাদার সংলাপ-সহ বিবিধ বিচিত্র হাবভাব দিয়ে গড়ে ওঠা থিয়েটার পুষ্পক দলের এই চেষ্টা, দর্শকদের চোখের পলক ফেলতে দেয় না। গ্রামের ছেলে মেয়ে যুবক বৃদ্ধ থেকে, মা মাসি ঠাকুমারা কীভাবে নাট্যচর্চার অংশীদার হয়ে ওঠে, যাঃ,সব ভন্ডুল নাটক তার আদ্যোপান্ত অদ্ভুত মুন্সিয়ানায়, গড়ে উঠে দেখিছে।
বস্তুত একটি সার্থক নাটক সব দিক দিয়ে। আলো মঞ্চ আবহ সবই যথার্থ চয়ন। কিন্তু একেবারে শেষে, এই মজার রেশ ধরে মঞ্চ শিল্পী কুশীলবেরা চরিত্র হয়ে যে মজা করেছে। তা বড্ড বেমানান লেগেছে। এই নাটকের ভন্ডুল হওয়ায় এই মজা তাদের হতেই পারে না। কারণ দর্শকদের এই নাটকের দর্শন এমন উত্তেজিত করেছিল, মজা তাদের। শিল্পী কুশীলবদের নয়। সেদিন তপন থিয়েটারে অত রাতে মনে হচ্ছিল মুহুর্মুহু হাততালির পর, এবার সবাই বোধহয় বয়স কমিয়ে ধেইধেই করে নাচবে। এতটা আনন্দিত হয়েছিলেন হলে উপস্থিত তরুণ তরুণী প্রবীণরা সবাই। কিন্তু কেউ-ই মাত্রা ছাড়িয়ে বাড়াবাড়ি করেন নি। মধ্যের থেকে মঞ্চে কিছুটা অবান্তর বাড়াবাড়ি লাগলো শেষের ভণ্ডুল মর্মের চটুলতা। দর্শকদের মধ্যেই উল্লাসে রীতিমতো বিশৃঙ্খল হতে পারার কথা থাকলেও। আহ্লাদিত অবস্থায় বিভ্রাট কিছু হয় নি।
মধ্যের থেকে মঞ্চে চরিত্রগুলি তাদের স্বীয় গ্রাম্য সরলতা হারিয়ে হঠাৎ নব্য উত্তর আধুনিকতার তীব্রতায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে নানান দেহ ভঙ্গিতে সেল্ফি তুলেছে। যাতে গল্পের মান ক্ষুন্ন হয়ে যায়। এই নাটকের সামগ্রিক পার্সপেক্টিভ গত সমস্ত দিক খতিয়ে দেখলে এই প্রয়োগ কষ্টকল্পিত আরোপ বলে অনুমান হয়েই যায়। সব চেয়ে বড় কথা যারা আমাদের তাদের কার্যকলাপে আনন্দিত করছেন, তাদের সেই চারিত্রিক ক্ষমতা আমাদের যে আপ্লুতি দেয়, মুহুর্তে উল্টে তাদেরকেই যদি আমাদের চেয়ে বেশি আনন্দিত দেখতে হয়। তখন এতক্ষণ পাওয়া আমাদের আনন্দের বাস্তবতা লজ্জা পায়। এই অবস্থার অন্বেষণ করতে মন উল্টে ব্যস্ত হয়। হয়তো আনন্দের বিরুদ্ধে ঈর্ষান্বিত মানসিকতা এসেই যায়। একেবারে ফিলোসোফি ও সাইকোলজি ধরেই এই ব্যাপারে ভাবতে বলবো নির্দেশিকাকে। নাটক তৈরি করতে গিয়ে হওয়া সমস্যা এবং সেই সমস্যা গুলি ছেলেমানুষিতে ভরা।
এই কার্যকলাপ সমস্যাগুলির ছেলে মানুষি মোকাবিলার বিরুদ্ধে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে অন্যধরনের সজ্ঞানকৃত সাজানো বিধান এনে খাড়া করছে। আপত্তি এখানে। কারণ নাটকের নির্মল হাসির ছলছলানির সাথে ফল্গুধারার মতো বয়ে চলে রাগ, দুঃখ, অভিমান.. আমাদের মনে বিশেষ ভাবে রেখাপাত করে গেছে। এরপর যাই হবে, তা কিন্তু বাড়তি এবং অবান্তর। এই মর্মে আরো বিচক্ষণ নাট্যজনের অভিমত কাঙ্ক্ষিত।
চরিত্র অনুসারে সবাই অন্যন্য, তবুও নজরে পড়ে, ঘনশ্যাম পোদ্দার-দেবরূপ সেনগুপ্ত, নবীন কাকু-মুরারী মুখোপাধ্যায়, সুরবালা দেবি-ভদ্রা বসু, কৈকেয়ী-শ্রদ্ধা গুপ্ত, হেড স্যার-চন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ও মিছরিদিদা আলোকপ্ররণা গুহ। কিন্তু তাই বলে সুমিতা ও সীতা-স্বাগতা সেন, টুম্পা ও মন্দোদরী-গার্গী গাঙ্গুলী, তড়িৎ ও হনুমান-শুভাশিস বিশ্বাস, দেবু ও রাম-আয়ুষ গুহ, ভজা ও দশরথ-অনীশ বিশ্বাস, সুখময় জ্যাঠা ও জটায়ু-দীপাঞ্জন বক্সী, অনিতা ও কুঁজী মন্থরা-মানসী নন্দী, এঁরা দুরন্তপনায় কেউ কম নন। আবহ শুভ্রজ্যোতি গুহ, আলো সুদীপ সান্ন্যাল, মিঞ্চ রুদ্ররূপ মুখোপাধ্যায় এই নাটকের আটঘাট ভালোই বেঁধে দিয়েছেন।
সর্বপরি পোশাক ও রূপসজ্জা সহ নির্দেশনায় এই নাটকটি আলোকপর্ণা গুহের শ্রেষ্ঠ কাজ বলেই মনে করি। তাই আমার বাতেলা কথা ভুলে গিয়ে এই প্রতিবেদন যিনি দেখবেন, আগ্রহ করে হলে গিয়ে শেষ অব্দি নাটকের অভিনয় কেমন হয় জানতে হলে দেখতে ভুলবেন না। নির্মল হাসি প্রাণ দায়ক ওষুধের সমান তো। হয়তো এতক্ষণ কষ্ট করে যা লিখলাম… একি!”যাঃ, সব ভন্ডুল!”……..