বিজয়কুমার দাস
থিয়েটারের নতুন প্রজন্ম : পর্ব ৩
থিয়েটার গায়ে মাখে, নাকি মাথায় দেয়?… এসব না জেনেই থিয়েটারে এসেছিল হাওড়ার বালি রাজচন্দ্রপুরের মেয়ে রূখষা গোস্বামী। যখন প্রায়শই বলা হয় এই প্রজন্ম শুধু নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত, তখন রূখষা নিজের লেখাপড়ার পাশাপাশি একটা মাধ্যম খুঁজছিল, যেখানে নিজের প্রতিভার বিকাশ ঘটানো যায়। রূখষা জানিয়েছে, ছোট থেকেই মঞ্চে দাঁড়ানোর একটা ইচ্ছা ছিল। ইচ্ছা ছিল,থিয়েটার করার। থিয়েটারের বিষয়টা কতটা গভীর বা নিজের বোধের গভীরতা কতটা – এটা জানার জন্যই থিয়েটারে যুক্ত হয়েছিল রূখষা। সেই রূখষা ২০২০ সালে শেষ পর্যন্ত জড়িয়েই পড়ে থিয়েটারের সঙ্গে। ছোট বেলায় স্কুলে নাটক হলেই সবার আগে এগিয়ে আসত সে। আর তখন থেকেই থিয়েটার করার ইচ্ছেটা পাখা মেলতে থাকে তার মনের মধ্যে।
কলকাতার সবুজ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র তারুণ্যে ভরপুর একটি নাট্যদল। থিয়েটার নিয়ে তাদের নিত্য পরীক্ষা নিরীক্ষা চলে নির্দেশক রাজেশ দেবনাথের নেতৃত্বে। শুধু অভিনয় নয়, তার সঙ্গে প্রতিটি থিয়েটারকর্মীকে থিয়েটারের আনুষঙ্গিক বিষয়েও দক্ষ করে তোলার চেষ্টা করা হয়। তাই এই দলের সাথে যুক্ত হয়েছিল রূখষা। মাত্র চার বছরেই রূখষা দলের অপরিহার্য থিয়েটারকর্মী হয়ে উঠেছে বলে জানিয়েছে রাজেশ দেবনাথ। সামাজিক মাধ্যম সূত্রে এই দলের কথা জেনেছিল সে। দলের একটা পোস্ট দেখে নিজেই আগ্রহী হয়ে যুক্ত হতে চায় এই দলের সঙ্গে। রূখষার কথায়, মাত্র ৪ বছরের থিয়েটার জীবনে অনেক কিছু শিখেছি।
সবুজ সাংস্কৃতিক এর “গালি দিবেন না কাক্কা ” নাটকে রূখষার প্রথম অভিনয়। প্রথম অভিনয়েই নজর কাড়ে সে দর্শকের। এই নাটকে রাজ্যের মূল মন্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করেছিল সে। এখনও পর্যন্ত এই দলেই আছে।থাকতেও চায় এই দলেই। এ পর্যন্ত অভিনীত নাটকে প্রিয় চরিত্র নিয়ে জানতে চাইলে রূখষা জানিয়েছে, প্রিয় চরিত্র বলে কিছু হয় না। সব চরিত্রকেই প্রিয় মনে করতে হয়। যেহেতু থিয়েটার করতে এসেছে তাই সব চরিত্রকেই সে প্রিয় চরিত্র মনে করে। রূখষা মনে করে, শুধু অভিনয় নিয়েই থিয়েটারে থাকলে পরিপূর্ণ থিয়েটারকর্মী হয়ে ওঠা যায় না। থিয়েটারের সবটা অর্থাৎ আলো,আবহ,মঞ্চ,পোষাক সবকিছু নিয়েই থাকতে হয়। তাই অভিনয় ছাড়া ব্যাকস্টেজের কাজেও সে পারদর্শী বলে জানিয়েছে দলের নির্দেশক রাজেশ দেবনাথ।
থিয়েটার জগৎ সম্পর্কে ধারণা কেমন?… এ প্রশ্ন করতেই সে জানিয়েছে, থিয়েটার তার কাছে একটা যুদ্ধ। নিজেকে টিকিয়ে রাখতে এই জগতে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে যেতে হয়। আদিম মস্তিষ্ক নিয়ে থিয়েটার জগৎকে বোঝা যায় না বা এই জগতে টিকে থাকা যায় না। সেই ধারণা নিয়েই সে থিয়েটারের সবকিছু জানতে চায়, শিখতে চায়।থিয়েটারের সেট, প্রপস, মেক আপ সব কিছুই শিখতে চেয়েছে সে। মেক আপ করা শিখেছে এবং দলের শিল্পীদের রূপসজ্জাতেও হাত লাগায় রূখষা। দলের They and my Diary নামে একটি নাটকে “অর্ধেক সুধা” নামে যে চরিত্রে সে অভিনয় করে, সেই চরিত্রের মেক আপ সে নিজেই করে। থিয়েটারে আলোর ব্যবহার নিয়েও সে বেশ কিছু দক্ষতা অর্জন করেছে। রূখষা মনে করে, শুধু অভিনয় করাই আসল নয়। থিয়েটারের সবকিছু সম্পর্কে ধারণা অর্জন করে সবার আগে একিজন পরিপূর্ণ থিয়েটারকর্মী হয়ে উঠতে হয়। সেই লড়াইটাই চালিয়ে যাচ্ছে সে। এই মুহূর্তে পড়াশুনো নিয়েও ব্যস্ত আছে।ভূগোল নিয়ে সাম্মানিকের ছাত্রী। পরীক্ষা, পড়াশুনো সবকিছুই একসঙ্গে চালিয়ে যাচ্ছে। পড়া নিয়ে ব্যস্ত বলে থিয়েটার করব না, এই বিশ্বাসে মোটেই বিশ্বাসী নয় রূখষা। ভাল ছবি আঁকে৷ হাতের কাজে দক্ষ। একজন ভলিবল খেলোয়ার হিসাবেও এলাকায় পরিচিতি আছে।
বিভিন্ন সময়ে থিয়েটারের কর্মশালায় যুক্ত হয়ে অভিনয়ের পাশাপাশি থিয়েটারের নানা কাজ শিখে নিয়েছে। গিরিশ মঞ্চ, মিনার্ভা, তপন থিয়েটার, রবীন্দ্র সদন, তৃপ্তি মিত্র নাট্যগৃহ, সবুজ প্র্যাকটিস স্টুডিও, নৈহাটি ঐকতান প্রভৃতি মঞ্চে নাটক করেছে। একসময় স্কুল কলেজেও নাটক করে বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল।স্কুলে ডাকঘর, রাখাল আর বাঘের গল্প ইত্যাদি নাটকে অভিনয় কলেজে অভিনয়ের পাশাপাশি তার নিজের লেখা নাটকেও অভিনয় করেছে। থিয়েটার করে কি বাঁচা যায়?… এই প্রশ্নটা রূখষার কাছে খুব জটিল মনে হয়। তার কখনো মনে হয়, বাঁচা যায়। আবার কখনো মনে হয়, বাঁচা যায় না। অথচ যারা থিয়েটার করে বেঁচে আছে তারাই এক্ষেত্রে রূখষাকে প্রাণিত করে থিয়েটার করে বাঁচার ক্ষেত্রে।
তবে রূখষার থিয়েটার চর্চায় তার বাড়ির মানুষজন যথেষ্ট উৎসাহ দেয়। আর উৎসাহ দেয় বলেই থিয়েটারের কাজের জন্য, থিয়েটারের জন্য সে লড়াইটা চালিয়ে যেতে পারছে।
গালি দিবেননি কাক্কা, মরলে মরো ছড়িয়ো না, মিরর,They and my Diary, Platform No 5 প্রভৃতি নাটকে অভিনয় তো করেইছে, পাশাপাশি কখনো রূপসজ্জায় হাত লাগিয়েছে, কখনো আলোর দায়িত্ব সামলেছে,কখনো ব্যাকস্টেজের কাজে নিজেকে অপরিহার্য করে তুলেছে। Platform No 5 নাটকে নির্দেশনার দায়িত্বও সামলেছে। এভাবেই এই অস্থির সময়ে লক্ষ্যে স্থির থেকে থিয়েটারের দুনিয়ায় একটা নতুন জীবনের সন্ধান করে চলেছে রূখষা গোস্বামী।