মানসিক বিপর্যয় থেকে দেবব্রতকে ঘুরে দাঁড়াতে শিখিয়েছে থিয়েটার

- Advertisement -

বিজয়কুমার দাস

থিয়েটারে নতুন প্রজন্ম : পর্ব ৮

মেদিনীপুরের জাহালদা গ্রামের ছেলে দেবব্রত দাস জীবনের বিপর্যয় থেকে ঘুরে দাঁড়াতে থিয়েটারের দলে এসে ভিড়েছিল। সেই থিয়েটারকে অবলম্বন করেই জীবনযুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে দেবব্রত।  ১০ বছর সে জড়িয়ে আছে  থিয়েটারে। অথচ থিয়েটারে আসার কথা নয় তার।  দেবব্রতর বাবা পেশায় চিকিৎসক। কিন্তু ভাগ্যের চাকা সবসময় সঠিক পথে ঘোরে না। ২০১৩ সালে দেবব্রতর চিকিৎসক বাবার একটা বড় ধরণের পথ দুর্ঘটনা ঘটে। দেবব্রত তখন একাদশ শ্রেণির ছাত্র। কিন্তু পারিবারিক এই বিপর্যয়ের কারণে দেবব্রত আর পড়াশুনো চালিয়ে যেতে পারেনি। তাই মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিল দেবব্রত সহ পুরো পরিবার। মা- বাবার চিন্তা বাড়ে দেবব্রতকে নিয়ে। সেইসময় সবকিছু থেকে মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া দেবব্রতকে ঘুরে দাঁড়ানোর পথ দেখিয়েছিল থিয়েটার।

ছোট থেকেই দেবব্রত নাচ গান অভিনয়ের সাথে যুক্ত ছিল। স্কুলের সমস্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তার অংশগ্রহণ ছিল আবশ্যিক। এ ব্যাপারে প্রশ্রয় ছিল তার মা- বাবার। কিন্তু পারিবারিক বিপর্যয়ের পর তার মা বাবা তাদের ছেলের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি দেখে তাকে প্রস্তাব দেন নাচ শেখার। শুরু হয়ে যায় নাচের প্রশিক্ষণ। নাচের সূত্রেই কলকাতা এসে থিয়েটার দেখা এবং অবশেষে থিয়েটারের সাথে যুক্ত হওয়া। থিয়েটারই হয়ে উঠল তার মানসিক অবসাদ দূর করার মোক্ষম ওষুধ – এ কথা জানাল দেবব্রত দাস। নিশ্চিন্ত হল তার মা বাবা।থিয়েটারে এসে নতুন করে বাঁচার মন্ত্র পেল একদা মানসিক অবসাদগ্রস্ত দেবব্রত।

থিয়েটারে যুক্ত হওয়া নিয়ে দেবব্রতর একটা গল্প আছে। কলকাতায় তাকে নিয়ে এসেছিল নৃত্যশিল্পী রুদ্র মিশ্র ও স্বর্ণাভ মিশ্র। এদের মধ্যে রুদ্রবাবু যুক্ত ছিলেন কলকাতার নাট্যদল রাজীব বর্ধনের যাদবপুর মন্থন দলের সাথে।রুদ্রবাবু তাকে নিয়ে আসে এই দলে। ঠিক তার কিছুদিন পরেই মন্থনের একটি নাটকের শো ছিল। “শুন মনসা কথা” নামে সেই নাটকটি দেবব্রত গিরিশ মঞ্চে দেখতে যায়। কিন্তু ঘটনাক্রমে সেদিনের নাটকে এক শিল্পী অনুপস্থিত ছিলেন। অবশ্য অভিনয়টা ছিল “কোরাস” এ। দলের কর্ণধার রাজীববাবু মুশকিল আসান হিসাবে দেবব্রত নাচ জানে বলে তাকে নিয়েই বাজি ধরে সেই শো তে।সেখানেই রাজীববাবু তাকে ভূমিকাটা বুঝিয়ে দিলে দেবব্রত সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে। প্রথম মঞ্চে ওঠে রাজীব কোরাস এর দৃশ্যে অভিনয়ে। সেভাবেই যাদবপুর মন্থনের সাথে তার অভিনয়ের গাঁটছড়া বাঁধা হয়। এই রাজীব বর্ধনের প্রশিক্ষণেই ১০ বছর মন্থনের সাথে জড়িয়ে দেবব্রত। জীবনে নতুন করে বাঁচার মন্ত্র পেল সে।

এই দলেই রাকেশ ঘোষের লেখা রাজীব বর্ধনের নির্দেশনায় “শুন মনসা কথা” তার অভিনীত প্রথম নাটক। এছাড়াও সে অভিনয় করেছে সুচরিতা বড়ুয়া চট্টোপাধ্যায় এর মাচার মানুষ, নির্দেশক দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের সংসৃতি, নির্দেশক অশোক চট্টোপাধ্যায়ের নান্দীমুখ। নির্দেশক অতনু সরকারের থিয়েলাইট, নির্দেশক দীপঙ্কর সেনের দুর্গাপুর ভীমরতি প্রভৃতি সুখ্যাত নাট্যদলে কৃতি নির্দেশকদের নির্দেশনায়।

এ পর্যন্ত বহু নাটকের বহু চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ মিলেছে তার। কোন ছোট চরিত্রকেও সে ছোট বলে মনে করে না। তাই সব চরিত্রই তার প্রিয়। তবে অন্যতম প্রিয় চরিত্র অবশ্যই মন্থন দলের রাজীব বর্ধন নির্দেশিত সাদিক হোসেনের গল্প অবলম্বনে “মোকাম্মেলের অমিতাভ” নাটকের প্রধান চরিত্র মোকাম্মেল এর ভূমিকায়। এক হেরে যাওয়া মানুষ মোকাম্মেলের হারতে হারতে ঘুরে দাঁড়ানোর চরিত্র এই মোকাম্মেল। এক্ষেত্রে তার প্রেরণা সুপারস্টার অমিতাভ বচ্চনের অভিনয়প্রতিভা এবং দীর্ঘ সময় ধরে ফিল্মি দুনিয়ায় টিকে থাকা। তার মনে হয়েছিল তার মধ্যেও কোথাও একটা মোকাম্মেল বেঁচে আছে।

থিয়েটারব্জগৎ সম্পর্কে দেবব্রতর ধারণা এখনও পর্যন্ত ভালই। সমস্ত নির্দেশকের কাছে সে ভাল ব্যবহার পেয়েছে বলে জানিয়েছে।নির্দেশকরা সৎ পরামর্শ দিয়েছেন, সঠিক রাস্তা দেখিয়েছেন। সহযোগিতা পেয়েছে থিয়েটারের বন্ধুদের কাছে। তবে সে জানিয়েছে, তার বিশ্বাস আছে কোন বিপর্যয় এলে সে রুখে দাঁড়াবে। সে পরামর্শ সে পেয়েহে  নির্দেশকদের কাছেই। মেরুদণ্ড সোজা রেখেই সে থিয়েটারে কাজ করতে চায় সে জানে বাঁচার জন্যই সে থিয়েটারে এসেছে।তবে তার মনে হয়েছে থিয়েটার করে নিজে বাঁচা গেলেও সংসার যাপন কিছুটা কঠিন।যদিও কেউ কেউ পেরেছেন, কিন্তু সেটা ব্যতিক্রম।

দেবব্রতর বাবা তাকে শিখয়েছেন, যেটা করবে সেটা সততার সাথে করবে। তার মা বাবা প্রতিদিন তার থিয়েটারের খুঁটিনাটি নিয়ে খবর নেন।বাবা মা এবং রাজীব বর্ধনের উৎসাহে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক বিভাগের স্নাতকোত্তর পড়াশুনোর প্রস্তুতি নিচ্ছে সে।পরিবারের মানুষের উৎসাহ তার প্রেরণা।

অভিনীত নাটকের তালিকায় মন্থনের (নির্দেশক: রাজীব বর্ধন) শুন মনসা কথা, অর্ধেক আকাশ, ছেদবিন্দু, মিত্রা, ত্রিকাল, নক্সীকাঁথার মাঠ, মোকাম্মেলের অমিতাভ, মেঘমল্লার, সুমন্ত রায়ের নির্দেশনায় আগুনপাখি, সন্দীপ চট্টোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় odd ভূত সোহম সরকারের নির্দেশনায় ইলা, সুচরিতা বড়ুয়া চট্টোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় সাবিত্রীবালা, দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় সওদাগরের নৌকা, গুজরাট ধরমপুর মিশন প্রযোজিত জনার্দন ঘোষের নির্দেশনায় যুগপুরুষ, নান্দীমুখ প্রযোজনায় অশোক চট্টোপাধ্যায় নির্দেশিত সিংহাসনের ক্ষয়রোগ, থিয়েলাইট প্রযোজিত অতনু সরকারের নির্দেশনায় চুয়াচন্দন, দুর্গাপুর ভীমরতি প্রযোজনায় দীপঙ্কর সেন নির্দেশিত প্রতিদিন একদিন ইত্যাদি প্রযোজনা।

এই তালিকা প্রমাণ করে মেদিনীপুরের গ্রামের ছেলেটি একদা পারিবারিক বিপর্যয়ে বিপর্যস্ত হয়ে মানসিক অবসাদে বিপন্ন হয়ে থিয়েটারকে আঁকড়ে ধরে ঘুরে দাঁড়াতে শিখেছে। তাই থিয়েটারের খুঁটি আঁকড়ে ধরে থাকতে চায় দেবব্রত।

- Advertisement -
সাম্প্রতিক পোস্ট
এধরনের আরও পোস্ট
- Advertisement -