দেবা রায়
সম্প্রতি মধুসূদন মঞ্চে অভিনীত হল রঙ্গলোক প্রযোজিত তাঁদের সাম্প্রতিক নাটক ‘সোনামাটি’। রূপার্ট ব্রুকের মূল গল্প ‘লিথুয়ানিয়া’ অবলম্বনে ও বিভূতি মুখোপাধ্যায়ের অনুসরণে রচিত এই নাটক। ‘সোনামাটি’র নাট্যরূপ দিয়েছেন স্বয়ং এই নাটকের নির্দেশক শুভ গুপ্তভায়া।
ট্র্যাজিক যুদ্ধের কবি এবং লেখক রুপার্ট ব্রুকের বিখ্যাত সৃষ্টি নাটক ‘লিথুয়ানিয়া’, রাশিয়ান শাসনের অধীনে একটি কৃষিপ্রধান দেশ — লিথুয়ানিয়ার উপত্যকায় বসবাসকারী একটি দরিদ্র পরিবারের বাড়ি চিত্রিত করে এ নাটকের বিষয়বস্তুতে।
আর অপর দিকে বিভুতি মুখোপাধ্যায় রচিত ‘কেয়াকুঞ্জ’ নাটক যেখানে বর্ণিত আছে এক দরিদ্র পরিবারের মাদকাসক্ত হয়ে ধ্বংস হয়ে যাবার করুণ কাহিনি।
দুই নাটকের গল্পের সুর ও ছন্দের এক অদ্ভুত সাদৃশ্য বর্তমান এই নাটকে। আর এই দুই নাটকের সূত্র ধরে রচিত ‘সোনামাটি’ যেন একদম সাম্প্রতিকতম আখ্যান হয়ে উঠেছে। নাটকের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নাট্য ছন্দের কোন পরিবর্তন ঘটেনি। নাটকের অভিনেতাদের বাচিক আর আঙ্গিক দক্ষতা নাটকের গতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ হয়েছে। আর সেই গতিকে যথাযথ দক্ষতার সাথে অনুসরণ করেছে আলো, আবহ এবং অবশ্যই মঞ্চ। একটি নাটক যখন এই ছন্দকে বজায় রাখতে সমর্থ হয় তখন সেই নাটকের সাফল্য আটকানো সম্ভব নয়।
সোনামাটিতে এমন একটি পরিবার যেখানে সেই পরিবারের যন্ত্রণা যা সামাজিক, অর্থনৈতিক এমনকি রাজনৈতিক পরিবেশকে চিত্রিত করে। পরিবারে কর্তা মাদকাসক্ত। পরিবারের বড় ছেলের উপার্জনের স্বার্থে অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়া। কর্তার দ্বিতীয় পত্নীর এক মাত্র সন্তানের নিরুদ্দেশ হয়ে যাবার যন্ত্রণা। সব মিলিয়ে এই তিন চরিত্রদের শিরদাঁড়া করে নির্মিত হয়েছে ‘সোনামাটি’।
সাম্প্রতিক নাট্যচর্চায় যখন পশ্চিমী নাট্যের প্রতি ঝোঁক দেখা যাচ্ছে তখন নির্দেশক শুভ গুপ্তভায়া এমন একটি নাটক নির্মাণ করলেন যেখানে আমাদের দেশজ সংস্কৃতি ও সংকট গভীরভাবে আঁকা হয়ে থাকলো। নির্দেশকের এই সামাজিক দায়বদ্ধতা বাংলা নাট্য নির্মাণের বিশেষ করে সঠিক বিষয়বস্তু নির্বাচনের দিক নির্দেশ করবে।
নাটকের ধাঁচা খানিক অপেরাধর্মী হলেও জীবনের আসল সত্যকে নিঙরে নিয়ে আসতে পেরেছে এই নাটক। পুরোপুরি ট্রাজিক ভাবে আবিষ্ট এই নাটকের অন্তঃসলিতে সুপ্ত থাকে এই অধঃপাতিত সমাজের প্রতি ঘৃণা আর ধিক্কারের বাণী।
কর্তারূপী শম্ভু চরিত্রের রুপকার দীর্ঘদিনের অভিনেতা শ্যামল সরকার মঞ্চে তার দক্ষতাকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। নেশায় বুঁদ হয়ে থেকে টাইম আর স্পেসকে ব্যবহার করে সংলাপ প্রক্ষেপণ যেন আমারই পাশের মানুষটির সংলাপ হয়ে উঠেছে। একদিকে খিদের যন্ত্রণা, অপরদিকে সংসারের নানা কুটকাচালি যা থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখা না রাখার মধ্যকার টানাপড়েন, যা ছোট ছোট শৈল্পিক দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। অপরদিকে আগের পক্ষের সন্তান কালু যার চরিত্রচিত্রণে কাজল শম্ভু তাঁর নিজস্ব ঢঙে প্রকাশ করেছেন তাঁর চরিত্রকে। মাপা আঙ্গিক অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে শুধু নাট্যছন্দকে বজায় রেখে অভিনয় করে গেছেন কাজল। তাঁর অভিনয়ে প্রাণ ছিল। আর এই দুই চরিত্রের পাশাপাশি যিনি তাঁর অভিনয় দক্ষতা দিয়ে পুরো নাটকের গল্পকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন তিনি কর্তার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী দূর্গা রূপে সোনালি চ্যাটার্জী। একদিকে সন্তানের কুমীর ডুবির জলে নিখোঁজ যাওয়ার যন্ত্রণা অপরদিকে পরিবারের স্বামী আর আগের পক্ষের ছেলের নানাবিধ কার্জকলাপ যাকে সামাল দেয়া তার যেন একারই কাজ। আপন সন্তান না হলেও তাকে আপন ভেবে আগলে রাখার মাতৃত্ব বোধ এবং স্বামীর প্রতি ভালোবাসা যা সাম্প্রতিক জনজীবনের দৈনন্দিন নারী চরিত্রের প্রচলিত রূপ। যাকে অপুর্ব দক্ষতায় এঁকেছেন সোনালী চ্যাটার্জী। এই তিন চরিত্রের পাশাপাশি অন্যান্য চরিত্র যেমন অনঙ্গ রূপে শিশির রায় ও রাধা রূপে শম্পা হোড় ছন্দ বজায় রেখেই কাজ করেছেন।
নাটকের আলোক সম্পাত ও ভাবনায় সৌমেন চক্রবর্তী নাটকের গতিকে অসামান্য দক্ষতায় উচ্চতায় পৌঁছোতে পেরেছেন। আর স্বপন বন্দ্যোপাধায়ের আবহ অনেক নাট্য মুহুর্তকে আলাদা মাত্রা এনে দিয়েছে। এই নাটকের মঞ্চকে আলাদা ভাবে দেখতে হয়। সেই বিষয়ে প্রশংসার দাবী রাখেন সন্দীপ সুমন ভট্টাচার্য। মঞ্চ বাস্তবানুগ হলেও তার ডিটেল ভীষণভাবেই চোখে পড়ার মতো। মঞ্চ-আলো-আবহ এই নাটককে আলাদা করেও ভাবাবে। যা নাটকের মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে।
আর সর্বোপরি এই নাটকের পরিচালক শুভ গুপ্তাভায়া যিনি অতি যতনে সাজিয়েছেন এই নাটক, তাঁর যোগ্যাতা ও দক্ষতার প্রকাশ এই ‘সোনামাটি’। এই নাটক সাম্প্রতিক বাংলা নাট্য সৃজনে আলাদা করে জায়গা করে নেবে বলেই বিশ্বাস।