Tuesday, November 19, 2024
Tuesday, November 19, 2024
Homeনাটকনাটক প্রতিযোগিতা : সামাজিক উপকারিতা

নাটক প্রতিযোগিতা : সামাজিক উপকারিতা

সুব্রত কাঞ্জিলাল

স্বাধীনতার পর দিল্লিতে প্রথম আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতামূলক চলচ্চিত্র উৎসব শুরু হয়েছিল।
এটা ছিল তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের উদ্যোগ। এই উৎসব সেই সময় সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন প্রমূখ আমাদের দেশের আরও অনেক চলচ্চিত্র প্রেমিকদের উদ্বুদ্ধ করেছিল। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে উঠেছিল ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলন।

আমাদের বাংলায় এই আন্দোলন যারা শুরু করেছিলেন তাদের মধ্যে সত্যজিৎ রায়দের ভূমিকা ছিল দেখবার মতো। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের উন্নত মানের চলচ্চিত্র প্রত্যক্ষ করবার পর তারা বুঝেছিলেন চলচ্চিত্রের ভূমিকা মানব সমাজে কিভাবে সমাজ পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে। এর বহু আগে রবীন্দ্রনাথ সোভিয়েত রাশিয়া ভ্রমণ করতে গিয়ে সেখানে নির্বাক চলচ্চিত্রের স্বাদ গ্রহণ করে তিনিও এই শিল্পের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেন। এই ঘটনার পর থেকে হাজরা মোড়ের চায়ের দোকানের আড্ডায় মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, ঋষিকেশ মুখার্জি এবং আরো অনেকের জীবনের গতি বদলে গিয়েছিল।

ভবানীপুরের থিয়েটার সেন্টার হলে তরুন রায়ের উদ্যোগে শুরু হয়েছিল প্রথম একাঙ্ক নাটকের প্রতিযোগিতা। সেই জয়যাত্রা বাংলা সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বিপুল আলোড়ন আন্দোলন বহন করে এনেছিল। মনোজ মিত্র, কিরণ মৈত্র, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় এমন অনেক মানুষকে রঙ্গমঞ্চের পাদপ্রদীপে এনে দিয়েছিল। জেলায় জেলায় শুরু হয়েছিল এই শিল্প নিয়ে নানা রকম গবেষণা, সৃষ্টিশীল কাজের উদ্যোগ। শুরু হয়ে গেল ছোট নাটক নিয়ে এক ধরনের শিল্প আন্দোলনের ভূমিকা।

উদারতা যৌবনের উন্মাদনায় হাজার হাজার যুবক-যুবতী ছোট ছোট নাটকের দল তৈরি করলেন। জন্ম হলো নাট্যকার, নাট্য পরিচালক, অভিনেতা অভিনেত্রীদের। বলা বাহুল্য এদের প্রধান অংশ আবেগ তাড়িত হয়ে এসেছিল। সে যুগের তিনজন বাঙালি যুবক এক টেবিলে মুখোমুখি হলে তারা দুটি জিনিস ভাবতেন। লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করা কিংবা একটা নাটকের দল তৈরি করা। এইসব নাটকের দলের আত্মপ্রকাশের জায়গা ছিল একমাত্র প্রতিযোগিতা মঞ্চ। নাট্য উৎসব মানে নাটকের প্রতিযোগিতা।

প্রবেশ দক্ষিণা দিয়ে এইসব মঞ্চে অভিনয়ের সুযোগ পাওয়া যেত। আর্থিকভাবে কোন পুরস্কার মূল্য ছিল না। ট্রফি সার্টিফিকেট এবং সেই সঙ্গে কোথাও কোথাও বই, সুটকেস ইত্যাদি পাওয়া যেত। অনেক পরে আর্থিক মূল্যে পুরস্কারের প্রচলন হয়েছিল। আমার মত যারা সে যুগের মানুষ এখনো বেঁচে আছেন, তারা জানেন যে পুরস্কার পাওয়া কি বা না পাওয়া, বাণিজ্যিক চিন্তাভাবনা, অর্থকরী লাভা লাভ নিয়ে কেউ চিন্তিত ছিলেন না। নিজেকে নাট্য আন্দোলনের শরিক ভাবাটা ছিল গর্বের বিষয়।

বিচারকদের বিশ্লেষণ শুনবার জন্য প্রায় সকলের আগ্রহ ছিল প্রবল। এইসব নাটকের মধ্যে বিচারকরা কিভাবে কোন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নাটক বিচার করতেন? বিশেষজ্ঞদের সবাই কি সুশিক্ষিত ছিলেন? ক্রিকেটের আম্পায়ার, ফুটবলের রেফারির মত ট্রেনিং নিয়ে আসতেন? তাহলে কারা ছিলেন এইসব প্রতিযোগিতা মঞ্চের বিচারক?

প্রথমত রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের একটা অংশ এবং ওইখানকার বেসরকারি বিচারক সমিতি গড়ে উঠেছিল। অহীন্দ্র চৌধুরী, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, শম্ভু মিত্র, এই ছেলের একটা অংশকে দেখা যেত। তারপর অভিনয়, গণনাট্য, গ্রুপ থিয়েটার, শিল্পীসেনা ইত্যাদি পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত এবং ফ্রিল্যান্সার শ্রেণীর মধ্য থেকেও বিচারকদের উঠে আসতে দেখা গেছে। প্রতিযোগিতা মঞ্চের সংখ্যা যত বেড়েছে সেই অনুপাতে বিচারকদের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য ছিল। এই কারণে দেখা গেল দূরবর্তী জেলা এবং গ্রামাঞ্চলে বাংলার মাস্টারমশাই, পুরনো দিনের যাত্রা অভিনেতা, এবং প্রবীণ থিয়েটার প্রেমীদের বিচারকের আসনে বসিয়ে দেওয়া হতো।

কমবেশি এরা সবাই নাটক নির্বাচনের ওপর গুরুত্ব দিতেন। সেই নাটকের সামাজিক মূল্য, রাজনৈতিক অর্থনৈতিক দিকগুলো খুঁজে দেখা হতো। হালকা রুচির, শ্রেণী দ্বন্দ্বহীন, আধ্যাত্মিক মৌলবাদী দৃষ্টিভঙ্গির নাটকগুলোকে বাতিল করে দেওয়া হতো।

নিছক প্রেমের গল্প যার সঙ্গে সমাজের কোন দ্বান্দিক সম্পর্ক নেই এমন নাটক রচনা করবার কোন আগ্রহ দেখানো হতো না। যে নাটকের মধ্যে সমাজ পরিবর্তনের কথা, মানব জীবনের উজ্জীবনের কথা, পাওয়া যেত না সেই নাটক বিচারকদের কাছে অনুমোদন পেত না। কারণ যুগটা ছিল বামপন্থী রাজনৈতিক আন্দোলনের সুতীব্র জোয়ারের যুগ।

কথাসাহিত্য, কাব্য রচনা, সংগীত, চলচ্চিত্র এককথায় শিল্প মধ্যম গুলোর প্রত্যেকটি সমাজের আয়না হয়ে উঠেছিল। শিল্পের জন্য শিল্প এই তত্ত্ব বাতিল হয়ে গিয়েছিল। শিল্প মানুষের জন্য। মানুষের জীবন সংগ্রামের শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল এই সব শিল্প মাধ্যমগুলো। কলকাতা রাজধানীর বুকে তখন বহুরূপী, এল টি জি, পিএলটি, নান্দীকার ইত্যাদি প্রথম শ্রেণীর দলগুলোর প্রভাব ছিল তীব্র। সর্বপরি রবীন্দ্রনাথের নাটক এবং দর্শন প্রতিটি শিল্পকর্মীকে শক্তি জোগাত। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কোথাও জীবন বিরোধী নিম্নরুচির প্রাধান্য ছিল না। ঋত্বিক ঘটক তাইতো বলতেন, আগে সত্যনিষ্ঠতা। তারপর রূপ নিষ্ঠতা। সত্যজিৎ রায় থেকে শুরু করে তখনকার সিনেমা জগতের এমন কেউ সম্ভবত ছিল না যার সৃষ্টিকর্মে স্থুল রুচির প্রকাশ ঘটেছে।

চল্লিশের দশকে বিমল রায়ের উদয়ের পথে থেকে শুরু হয়েছিল সমাজ বাস্তবতার আলেখ্য রচনা। অজয় করের সুচিত্রা উত্তম ইত্যাদি প্রেম কাব্যের সিনেমাগুলোর মধ্যেও সামাজিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিক দ্বন্দ্বের প্রতিফলন ঘটেছে। তরুণ মজুমদার বারবার বলতেন, মাথার উপর সত্যজিৎ ঋত্বিক বাবুরা ছিলেন। আমাদের কারো পক্ষে সম্ভব ছিল না হালকা রুচির সিনেমা বানানো।

অন্যদিকে, গোটা দেশে শ্রমিক কৃষক মধ্যবিত্ত জীবনের প্রবাহে গড়ে উঠেছিল প্রতিষ্ঠান বিরোধী উত্তাল আন্দোলন। একদিকে যেমন ভিয়েতনাম, ল্যাটিন আমেরিকা, রাশিয়ার অক্টোবর বিপ্লব, চীনের লং মার্চ ভারতীয় শিল্প সাহিত্যে প্রভাব ফেলেছিল। অন্যদিকে ৭০-এর দশক ভারত ভূমিকে নকশাল আন্দোলন কাঁপিয়ে দিয়েছিল। এই আন্দোলনের রাজনৈতিক ভুল ভ্রান্তি থাকা সত্ত্বেও শিল্প কর্মে এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। আমাদের বাংলার একাঙ্ক নাটক এই প্রভাব থেকে মুক্ত ছিল না। পরবর্তী সময়ে বামফ্রন্ট সরকারের সংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ঐতিহাসিক ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। এই বঙ্গের অসংখ্য নাটক তৈরি হয়েছিল এই সরকারের রাজনৈতিক বিচ্যুতি গুলোর বিরুদ্ধে।

আমি আগেই বলেছি মূলত তরুণ প্রজন্মের যুবক যুবতীদের আত্মপ্রকাশের মাধ্যম ছিল ছোট নাটক প্রতিযোগিতার মঞ্চ। এক ধরনের শিক্ষার্থীর মত এইখানে কাজ করতে করতে তারপর অনেকেই চলে গিয়েছিলেন বড় নাটকের কাজে। আজও দেখা যায় বিগত এক দশক ধরে এই মঞ্চে যেসব নাটকের দল কাজকর্ম করছেন তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ নতুন প্রজন্মের যুবক-যুবতী। আমরা যেন ভুলে না যাই এরা কখনো আগের যুগে নাম যশ অর্থ প্রতিপত্তি ক্যারিয়ারের আকর্ষণে এখানে যুক্ত হতেন। সামাজিক রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা এদের প্রধানত উদ্বুদ্ধ করত।

দেশের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে থাকলো। বামপন্থী আন্দোলনের প্রভাব সীমিত হতে থাকলো। শুরু হয়ে গেল প্রতিক্রিয়ার যুগ। দক্ষিণপন্থী রাজনীতি, বাজার অর্থনীতি, পুজির বিশ্বায়ন, ডিজিটাল যুগ, মিডিয়ার একাধিপত্য, মানুষের মনোজগতে ভয়ংকর প্রভাব ফেলে দিল।

এইটা শুরু হয়েছিল ৯ -এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে। এর রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ব্যাখ্যার জায়গা একটা নয়। তার জন্য অন্য প্রবন্ধ লিখতে হবে। যে কথাটা বলতে হবে তাহল, নাট্য আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত শিল্পকর্মীদের মনোজগতে এক ধরনের ভাঙ্গনের শব্দ শোনা গেল। নাটকের প্রতিযোগিতার মঞ্চে অর্থ মূল্যে পুরস্কার প্রাপ্তি ইত্যাদির সঙ্গে নাম যশ কেরিয়ারের প্রশ্নগুলো আন্দোলনের ভূমিকা অস্বীকার করবার প্রয়োজনীয়তা শুরু হয়ে গেল। নাটক করতে টাকা লাগে সুতরাং সেই টাকা তুলতে গেলে এক ধরনের বাণিজ্যিক কনসেপ্ট উঠে এলো।

প্রতিযোগিতায় সব সময় প্রথম পুরস্কার পেতে হবে, আমাদের নাটকের বিরুদ্ধ সমালোচনা শুনতে চাই না। আমিই সেরা। আমি সর্বজ্ঞ। কিভাবে নাটক জমাতে হয়, পাবলিক খাওয়াতে হয়, বাণিজ্য করতে হয় এইসব আমার জানা আছে।

এইখান থেকেই শুরু হয়ে গেল সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে সরে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়া। আদর্শবাদকে তুচ্ছ করে বাজার অর্থনীতির কাছে আত্মসমর্পণ করা। পুরস্কার পাওয়ার জন্য ম্যাল প্রাকটিস শুরু হয়ে গেল। একটি ক্ষুদ্র অংশের বিচারকরাও এরমধ্যে জড়িয়ে পড়ল। যদিও পতনের শব্দ তখনও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে নি। বামপন্থী শরিক দল গুলোর মধ্যে এবং অন্যান্য চরমপন্থীদের মধ্যে নানাবিধ রাজনৈতিক দ্বন্দ সংস্কৃতির অঙ্গনে প্রতিফলিত হলো। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো এটাই তো চাইছিল।

মানুষকে ভাগ করো এবং ভোগ করো। সাম্রাজ্যবাদীরা আজকাল আর সরাসরি অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করে না। অর্থনৈতিক শোষণের নানাবিধ রূপ তৈরি হয়ে গেছে। মানুষের মগজ দখল করবার কৌশল গুলো ওদের হাতে চলে এসেছে। মিডিয়া সন্ত্রাস, ডিজিটাল বিশ্ব, প্রমাণ করে দিয়েছে একটা সাধারণ ভাইরাস-এর ভয় দেখিয়ে কিভাবে মাসের পর মাস কয়েকটা দেশকে অন্ধকার করে দেওয়া যায়। ভারতবর্ষের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করা যায়।

প্রতিযোগিতার মঞ্চে মঞ্চে টার্গেট করা হলো সমালোচক এবং বিচারকদের। পুরস্কার না পেলেই ওই লোকগুলোকে বয়কট করো, মানসিক নিগ্রহ করো। আমি একবারও বলছি না যে সমস্ত রকম সমালোচক এবং বিচারকরা অসুস্থ মানসিকতার শিকার। আমি এ কথাও বলতে চাই না যে, সমস্ত নাটকের দল অসুস্থ মানসিকতার শিকার। প্রত্যেকের মধ্যে মূল্যবোধের অবক্ষয় দেখা গেছে। আমার বলবার কথা হচ্ছে এই যে, রাজনৈতিক ক্ষমতা যেমন মস্তিষ্কে পচন ধরায়।

একইভাবে সংস্কৃতিক কর্মীদের একাংশ ক্ষমতার অলিন্দে বিচরণ করবার মানসিকতা নিয়ে মার্কেট ইকোনমির দূষিত ভাইরাস মস্তিষ্কে বহন করতে শুরু করে ছিল। এবং একইসঙ্গে আমাকে বলতেই হবে, বামপন্থী রাজনীতির আন্দোলনহীনতা সমাজ ব্যবস্থার প্রতিটি স্তরকে দিশাহীন করে দিয়েছে। সংসদীয় গণতন্ত্রের অবক্ষয়ে সংস্কৃতিক কর্মীদের বহু ক্ষেত্রে পচন ধরাতে পেরেছে।

ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার প্রথম যুগে অর্থনীতিতে এক ধরনের সুস্থ প্রতিযোগিতা বজায় ছিল। পরবর্তী সময় মনোপলি ক্যাপিটাল স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে। সুস্থ প্রতিযোগিতাকে অস্বীকার করে। একইসঙ্গে সমাজ জীবনে এই ধরনের স্বৈরাচারী সংস্কৃতির আবহাওয়াও ঘটিয়ে তোলা হয়। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, অনুদানের সংস্কৃতি, নানা রকম পুরস্কারের প্রলোভন, প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করে টিকে থাকার ইঙ্গিত গুলো নানাভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়।

এইসব ক্ষেত্রে মিডিয়ার একটা বড় ভূমিকা থাকে। ক্ষমতার কাছাকাছি অবস্থান করলে নানা ধরনের প্রচার, সুযোগ-সুবিধা যে পাওয়া যাবে, সংস্কৃতিক ব্যক্তি কিংবা সংগঠনগুলো সেলিব্রেটি হয়ে উঠবে। বলা বাহুল্য আদর্শহীন শিল্পকর্মীরা খুব সহজেই এইসব ফাঁদে পা বাড়িয়ে দেয়।

বামফ্রন্ট সরকারের ৩৪ বছরের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে এইসব দুর্বলতা গুলো থেকে গিয়েছিল। শতফুল বিকৃত হবার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এই কারণেই আগাছার নির্মূলীকরণ সম্ভব হয়ে ওঠে নি। হয়তো সেটা সম্ভবও ছিল না। তার অন্যতম কারণ সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতি এক ধরনের মোহ। বলা বাহুল্য এই মোহ বামপন্থী দল গুলোকেও বিপন্ন করে তুলেছে।

ভোট সর্বস্ব রাজনীতিতে সুস্থ প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনী ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে তুলেছে। ভোটে জেতবার জন্য ভোটারদের সরাসরি নানা রকম উপঢৌকন, টাকার প্রলোভন চালু হয়ে গেছে। ভোটের নামে প্রহসন, মারদাঙ্গা, ভোট সন্ত্রাস ক্রমশ বৈধতা পাচ্ছে। মানুষের পরিচয় এখন সে ভোটার। ভোটারদের কনজিউমার ব্যবস্থার অঙ্গ করে ফেলা হচ্ছে। বুদ্ধিজীবী শিল্পী সাহিত্যিকদের গরু ছাগলের মত কিনে ফেলা হচ্ছে । সংস্কৃতিক কর্মীরাও নিজেদের বিক্রি করতে বাজারে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছে।

আরো বিচিত্র এবং আশ্চর্য ঘটনা যে মস্তিষ্ক বন্ধক না দেওয়া তথাকথিত নকশালপন্থী, র‍্যাডিক্যাল, সিভিল সোসাইটির যে অংশটা কে আমরা দেখতে পাচ্ছি, তারাও কিন্তু মেরুদন্ড সোজা করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছেন না। এক ধরনের আপোষকামী মনোভাবের পরিচয় এদের মধ্যেও পাওয়া যাচ্ছে। এদের আবার অনেকে আজও বামফ্রন্ট সরকারের মুন্ডু পাত করে চলেছেন। এই বিপদজনক রাজনীতির আড়ালে দুর্বৃত্তরা জল বাতাস পেয়ে যাচ্ছে।

এখানে হিরোশিমা বাতাসে শ্বাস গ্রহণ করতে করতে যেসব নাটক থিয়েটার তৈরি হচ্ছে সেখানেও সৃষ্টিশীল
মানবতাকামি মানুষের জয় গান ধ্বনিত হচ্ছে না। শিল্পকর্মীদের মধ্যে ধৈর্যের অভাব দেখা যাচ্ছে। পড়াশোনার আগ্রহ বা প্রয়োজন বোধ অনুভূত হচ্ছে না। পরমত সহিষ্ণুতা হারিয়ে যাচ্ছে। অতীত ঐতিহ্য থেকে নিজেকে বিচ্যুত করবার চেষ্টা চলছে। নিজেকেই মনে করা হচ্ছে আমি যা করছি সেটাই শেষ কথা। এটাই তো চাইছিল মার্কেট ইকোনমি। অতীত ঐতিহ্য থেকে মানুষকে বিচ্যুত করে দাও। অতীতের সমস্ত রকম সাংস্কৃতির পিলার গুলোকে ভেঙে দাও। মানুষকে করে দিতে হবে ভুড়ি সর্বস্ব। অহংবাদি। চূড়ান্ত স্বার্থপর।

ধনতন্ত্রের আওতায় যৌথ পরিবার গুলো ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে। ঠিক একইভাবে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন বহুদিন আগে থেকে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। ব্যক্তি স্বতন্ত্রতাবাদের অর্থনীতির পরিমন্ডলে যৌথ উদ্যোগ, যৌথ সংগঠনের প্রাসঙ্গিকতা বহু ক্ষেত্রে আগের মত আর উজ্জ্বল ভূমিকা পালন করতে পারছে না। নাটকের প্রতিযোগিতা মঞ্চের সুস্থ-সংস্কৃতিক পরিবেশও দূষিত হয়ে পড়েছে। পারস্পরিক অবিশ্বাস, অমর্যাদা, অসহিষ্ণুতার বাতাবরণ ক্রমবর্ধমান।

এসবের প্রভাব পড়েছে এখনকার মঞ্চস্থ নাটকগুলোর মধ্যে। উৎকট প্রচারের যুগ চলছে। দলগুলো ফেসবুকে নিজেদের প্রচারে উদগ্র হয়ে পড়েছে। নিজেরাই নিজেদের সার্টিফিকেট দিচ্ছে। দর্শক সমালোচকদের তোয়াক্কা করবার আগ্রহ কমে যাচ্ছে। নাটকগুলোর মধ্যে জীবনের উত্তাপ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ভুল রাজনীতি, অপ্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো সামাজিক বিচ্ছিন্নতার শিকারে পরিণত হচ্ছে। সমাজের জ্বলন্ত বিষয়গুলো এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। শ্রেণীবিভাজন, শ্রেণী দ্বন্দ্ব, অর্থনৈতিক অসাম্য, চলতি ব্যবস্থা থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা প্রায় অধিকাংশ নাটকে দেখা যাচ্ছে না। আমাদের মতন কেউ কেউ এইসব প্রশ্ন তুলে ধরলে তাদের এড়িয়ে যাওয়া, এমনকি অপমান করবার অসৌজন্য প্রকাশ দেখা যাচ্ছে।

অন্যদিকে সততার সঙ্গে সৎ সমালোচকরাও নিরব হয়ে থাকছেন। সামাজিক অন্যায়গুলো বৈধতা পাচ্ছে। নাটকগুলো হয়ে পড়ছে ভঙ্গি সর্বস্ব। ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয় এইখান থেকে মুক্তির উপায় আমাদের খুঁজে দেখতে হবে। আমাদের ভেবে দেখতে হবে প্রতিযোগিতা মঞ্চের ঐতিহাসিক ভূমিকা অস্বীকার করে সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশ কি সম্ভব?

আমি যেন ভুলে না যাই প্রতিযোগিতার মঞ্চেই শ্রেষ্ঠ মঞ্চ যেখানে নতুন প্রতিভার উন্মেষ ঘটে। দর্শক সমালোচকদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নাট্যকর্মীরা নিজেদের কাজগুলো পরীক্ষা করে নেবার সুযোগ পায়। একই সঙ্গে অহং বোধের প্রশ্রয় থাকে না। স্বৈরাচারী মনোভাবের পতন ঘটতে পারে। সংস্কৃতির বিভিন্ন ধরনের প্রতিযোগিতা হাজার বছর ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। শ্রেষ্ঠ শিল্পীরা এইখান থেকেই উঠে এসে বিশ্ব জয় করেছেন।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -

Most Popular