Tuesday, November 19, 2024
Tuesday, November 19, 2024
Homeনাটকপথনাটক : মানুষের জন্য, মানুষের মাঝে, মানুষেরই থিয়েটার

পথনাটক : মানুষের জন্য, মানুষের মাঝে, মানুষেরই থিয়েটার

দেবা রায়

পথনাটক। এ এক অন্য থিয়েটার। নিরাভরণ থিয়েটার। পথনাটকে মঞ্চ তৈরি নেই। আলোর মায়া নেই। চরিত্রের পোশাক চিত্রণ বাধ্যতামূলক নয় চরিত্র নির্মাণে। মেকআপ ছাড়াই অভিনেতাকে অভিনয় করতে হয়। আবহসঙ্গীত না হলেও চলে। শুধু প্রয়োজন অভিনয়। এবং অভিনেতার। আর প্রয়োজন রিকুইজিশনের। 

পথনাটক কাকে বলে

প্রসেনিয়াম আর্চের বাইরে পথে-প্রান্তরে অর্থাৎ উন্মুক্ত স্থানে অভিনীত নাটকই হল পথনাটক বা স্ট্রিট থিয়েটার। এধরনের থিয়েটারে শিল্পীরা যেমন খোলামেলা জায়গায়, সাধারণ দর্শকদের সামনে অনাড়ম্বরভাবে অভিনয় করেন তেমনই দর্শকরাও মাটিতে বসে বা দাঁড়িয়ে অভিনয় উপভোগ করেন।

মনে রাখতে হবে, অভিনেতা-অভিনেত্রী ও দর্শকদের মধ্যে এই সরাসরি সংযোগের কারণে পথনাটকের অভিনয় কিন্তু বেশ কঠিন কাজ। এই মানুষের থিয়েটারে অভিনয় করতে হলে শিল্পী কিংবা অভিনেতাদের যথেষ্ট অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার প্রয়োজন হয়।

পথনাটকে অভিনয় করতে হলে  

  1. সাজানো সংলাপের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে কোনও নাট্যমুহুর্ত তৈরি করতে পারলেই যে তিনি অভিনেতা এবং নাটকে অভিনয় করতে পারবেন তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। শেখানো বুলি বলে যাওয়ার মতো তোতাপাখিরা  এখানে কাজ করতে খানিক অসুবিধায় পড়বেন।
  2. কারণ যে বিষয়ের ওপর আপনাকে অভিনয় করতে হবে সে বিষয় সম্পর্কে সম্মক জ্ঞাণ বা ধারণা না থাকলে তিনি কোনও ভাবেই সংলাপ বলতে পারবেন না। অনেক সময় বিনা মহড়াতেই এই নাটক প্রস্তুত করে দর্শকের কাছে উপস্থাপিত করতে হয়। তার জন্য কিছু টেকনিক শিখে রাখতে হয়। বাকিটা অভিজ্ঞতা থেকেই করতে পারা যায়।
  3. যে অভিনেতা যতবার এই নাটকে অভিনয় করবেন, তিনি তত বেশী অভিজ্ঞ হবেন এবং নাটকে তাঁর প্রয়োজন বাড়বে। এছাড়া একজন অভিনেতার অভিনয়ের সকল গুণাবলী থাকা বাঞ্ছনীয়। সাথে সাথে সেই  অভিনেতার সাধারণ জ্ঞান ও নানা বিষয়ের তথ্যাদি সম্পর্কে ধারণা থাকতেই হবে। সেই বিষয়গুলো নিয়ে নিয়মিত চর্চা করা দরকার।
  4. এরপর সেই অভিনেতার রাজনীতি সম্পর্কেও ধারণা বা উৎসাহ থাকা প্রয়োজন। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাঁকে পড়াশোনা করতেই হবে। তাঁকে সহজ মনের মানুষ হতে হবে। কারণ মনের জটিলতা দূর করতে না পারলে নিজেকে বিভিন্ন অভিনয়স্থলে খাপ খাইয়ে নেওয়া খুব সহজ হবে না।
  5. একজন অভিনেতার শ্রেণিচেতনা থাকা দরকার। কারণ অভিনেতা নিজের শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে কোনও ভাবেই তা থেকে বেরিয়ে ওপর শ্রেণির জন্যে গলা ফাটাতে পারবেন না। অভিনেতাকে বিজ্ঞানমনস্ক হতেই হবে। হতে হবে সংস্কারমুক্ত। কুসংস্কারাচ্ছন্ন মন নিয়ে তিনি কখনই সত্যকে উপস্থাপিত করতে পারবেন না। আবার করতে চাইলেও মানুষ তাঁর কথা বিশ্বাস করবেন না।
  6. অর্থাৎ একজন অভিনেতা হিসেবে নাটকে অভিনয় করতে হলে শুধু অভিনয় জানলেই হবে না, তাঁকে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে সচেতন হতে হবে। এবং তবেই তিনি বিশ্বাসযোগ্য অভিনয় করতে পারবেন।  

পথনাটক কিভাবে করব

  1. প্রথমত যে সকল দর্শকের কাছে গিয়ে অভিনেতাদের কাজ করতে হয়, তাঁদের অভিনেতারা না চেনেন না জানেন। দর্শকের কাছেও তাঁরা অপরিচিত। তাই দেখামাত্র অভিনেতাদের দিকে একটা বাড়তি নজর থেকে যায়। তারপর বাজনা-গান ইত্যাদি তাঁদের স্তব্ধ করিয়ে দেয়। অভিনেতাদের পোশাক-আশাক সাধারণ মানের হতে হবে। দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য লাল, নীল, সবুজ প্রভৃতি রঙের কাপড় ফেট্টি করে মাথায় বা কোমরে বেঁধে নিতে হবে।
  2. অভিনেতারা যখন অভিনয় করবেন তাঁরা আগত সকল দর্শকের সাথে বন্ধুত্বপুর্ণ আচরণ করবেন। তাঁদের সম্পর্কে জানবেন। তাঁরা কেমন আছেন, কি করছেন প্রভৃতি জানতে চাইবেন। কমিউনিটি থেকে জল দিতে চাইলে সেটা খেয়ে নিতে হবে। টুল, মোড়া, বেঞ্চ, গ্লাস, থালা, বাটি এই জাতীয় রিকুইজিশন কমিউনিটি থেকে চেয়ে নেবেন। সেগুলো পাওয়ার পর তাঁদের ধন্যবাদ জ্ঞাপণ করবেন। অভিনয়স্থল নির্বাচনে স্থানীয় মানুষের সাহায্য নিতে ভুলবেন না।
  3. যদি কমিউনিটি থেকে অভিনয়স্থল নির্বাচনে বাধা আসে, সে ক্ষেত্রে তাঁদের সাথে কথা বলে তার কারণ জানতে চাইবেন। বুঝিয়ে যদি তাঁদের মানানো যায় সেখানে কাজ করবেন। অন্যথায় অভিনয়স্থল পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেবেন। কোনও ভাবেই আপনার বা আপনাদের চাওয়া-পাওয়াকে ওঁদের ওপর চাপিয়ে দেবেন না। যদি দেন, তাহলে অভিনয় চলাকালীন আপনি দর্শকের কাছ থেকে সহযোগিতা না-ও পেতে পারেন।
  4. অর্থাৎ যেখানে আপনি কাজ করতে গেছেন সেখানকার মানুষের সাথে সতভাব বজায় রেখে কাজ করবেন। অভিনেতাদের মধ্যে কোনও জাতি-দ্বেষ থাকা চলবে না। আপনি হিন্দু না মুসলমান না খৃষ্টান না কি জৈন, সেটা প্রকাশ করা ঠিক হবে না।
  5. ধরুন আপনি মুসলমান কমিউনিটিতে কাজ করতে গেলেন। আর যে সময়টা আপনি ঢোল পিটিয়ে নাটক শুরু করতে তৈরি হচ্ছেন সেই সময়টা তাঁদের নামাজের সময়। আপনাকে বলা হল ‘না ঢোল বাজাবেন না”। আপনাকে সেখানে সেটা বন্ধ করে দিতে হবে। এবং সেই ঢোলের সাহায্য ছাড়াই আপনাকে কাজ করে যেতে হবে।
  6. এবার ধরুন কোনও হিন্দু কমিউনিটিতে গিয়ে দেখলেন সেখানে কীর্তন হচ্ছে। সেখানে অনেক লোকের সমাগম। উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে আপনারা ঢোল পিটিয়ে সমস্ত দর্শকদের ডাকতে শুরু করলেন। কীর্তনের দল স্বাভাবিক ভাবেই রেগে যাবে। এবং আপনাদের বাঁধা দেবে। 
  7. অর্থাৎ আপনি বা আপনারা এমন কোনও কাজ করবেন না যাতে করে কমিউনিটির মানুষ আপনাদের বিশ্বাস করতে দ্বিধা করেন। দর্শকের সাহায্য ছাড়া আপনারা কিছুতেই আপনাদের কথাগুলো নাটকের মাধ্যমে তুলে ধরতে পারবেন না। তাই প্রাথমিক ভাবে সুন্দর সম্পর্ক স্থাপনই একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত। তা না হলে যে সকল তথ্য দেওয়ার জন্য সেখানে যাওয়া হয়েছে, সেই সকল তথ্য তাঁদের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছে দেওয়া যাবে না।

পথনাটকের বৈশিষ্ট্য বা উদ্দেশ্য

পথনাটকের সময়সীমা হয় মঞ্চনাটকের চেয়ে কম, সাধারণত আধ ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা। স্বল্পদৈর্ঘ্য এই নাটকের মুখ্য উদ্দেশ্য বিনোদন নয়। জনসাধারণের মধ্যে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি, অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদ করা এবং কুসংস্কারবিরোধী আন্দোলন এর প্রধান লক্ষ্য।

হাটে-বাজারে, পথে-ঘাটে কোনরূপ মঞ্চব্যবস্থা ছাড়াই সমাজে বিরাজমান যেকোনো সমস্যা অভিনয়ের মাধ্যমে তুলে ধরা হয় এবং ক্ষেত্রবিশেষে তার সমাধানও নির্দেশ করা হয়।

পথনাটক কিসের জন্যে বা কোন স্বার্থে

  • মানুষের অধিকার রক্ষার উদ্দেশ্যেই এই কাজ হয়ে থাকে। অর্থাৎ মানুষ সরকারের কোনও পরিষেবা ঠিকভাবে পাচ্ছেন কিনা, বা সেই সকল পরিষেবা পেতে গেলে মানুষকে কি কি করতে হবে, কোথায় কোথায় গেলে সেই পরিষেবা পাবে, বা সেই সকল পরিষেবা না পেলে তাঁদের কি কি ক্ষতি হতে পারে- এরকম নানান বিষয়ে নানাভাবে তাঁদের সচেতন করে তোলাই এই প্রচারের আসল উদ্দেশ্য।
  • মনে রাখতে হবে কোনও রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থে এই প্রচার করলে তা পক্ষপাতের স্বার্থ নির্দেশ করবে। সমস্ত মানুষের স্বার্থ একসাথে লঙ্ঘিত হচ্ছে। এমন বিষয়ের ওপর কাজ করলে সকল মানুষের কাছে গ্রহনযোগ্যতা বাড়বে। যেমন ধরুন রেশনে দু’টাকার চাল সঠিকভাবে বণ্টন হচ্ছে কিনা, বা চালের ভেতরে পোকা আছে কিনা। এটাও হতে পারে – রেশনের ব্যবস্থা সকল কার্ড হোল্ডারদের হাতে পৌঁছচ্ছে কি না। বা ধরুন পালস পোলিও সকল বাচ্চাদের ঠিকভাবে দেওয়া হচ্ছে কি না, পোলিও না খেলে কি ক্ষতি হতে পারে, যারা পোলিও খাওয়াতে যান না- তারা কেন যান না? সে বিষয়ে তাদের ভেতরের ভুল ধারণা দূর করে তাকে পোলিও নেওয়ার জন্য সম্মতি আদায় করতে হবে।
  • শিশু ও নারী পাচার বিষয়ে কমিউনিটিকে সচেতন করা। এই অপরাধের সাজা কি হতে পারে সে বিষয়ে তাদের ধারণা দেওয়া। কিভাবে একজন শিশু বা নারী এক হাত থেকে আর এক হাতে বিক্রি হয়ে যায়। শিক্ষা অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক এই নিয়মের বার্তা সকলের কাছে পৌঁছে দেওয়াও এই নাটকের মাধ্যমে করতে হয়।
  • শিশুকে স্কুলে পাঠাতে হবে। কোনও স্কুলই একজন ছাত্রকে ভর্তি না নিয়ে ফেরত পাঠাতে পারে না। সরকারি স্কুলে কোনও রকম মাইনে নেওয়া বেআইনি। ছাত্রদের গায়ে হাত তোলা, বেত্রাঘাত করা, ছাত্রদের দিয়ে গা-হাত-পা টেপানো বা তাকে দিয়ে চা ইত্যাদি আনানো – এ সবই অপরাধের সামিল।
  • বিদ্যালয়ে ছাত্ররা পড়তে আসতে যেন ভয় না পায়। এই সকল বিষয়ে অঞ্চলের মানুষকে সচেতন করা এই নাটকের লক্ষ্য। শিশুর সাথে যৌনাচার, কন্যাভ্রুণ হত্যা, গৃহহিংসা সংক্রান্ত নানা বিষয়ে আইনি পরিষেবা কি? এধরনের অপরাধের শাস্তিই বা কি? জরিমানা কত? এসব জানানো হয়ে থাকে এই নাটকের মাধ্যমে।
  • পরিবেশ দূষণ নিয়ে সচেতনতার লক্ষ্যেও এই কাজ করা হয়ে থাকে। যেমন গাছ বাঁচানো, নদীর জল নোংরা না করা, বা অঞ্চলের পুকুর পরিষ্কার রাখা, পানীয় জলের কলে স্নান না করা, পুকুরে কারখানার ব্যবহৃত জল নিকেশ না করা, নিজেকে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হাতের নখ কাটা, হাত ধুয়ে খাবার খাওয়া, শৌচাগার ব্যবহারের পর হাত সাবান দিয়ে ধোওয়া।
  • এছাড়া জ্বালানী বা তেল সংরক্ষণ করার লক্ষ্যেও মানুষকে সচেতন করতে এগিয়ে আসেন তেল কোম্পানি বা বেসরকারি সংস্থা। গ্রামে গ্রামে সবজি বাগানের মাধ্যমে ও জৈব সার ব্যবহারের মাধ্যমে পুষ্টি বাগান করলে যে মানুষের সাশ্রয় ও স্বাস্থ্য দুই-ই রক্ষা পায়, সে ব্যপারে তাদের ধারণা দিতে হয়। মানুষের কাছে স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছনোর লক্ষ্যে মানুষকে সরকারি হাসপাতালে যাবার আহ্বান জানানো হয়ে থাকে এই নাটকের সাহায্যে।
  • এমনকি নেশার জন্যে কিভাবে যুবসমাজ ধ্বংস হচ্ছে, সে ছবিও নাটকের মাধ্যমে তুলে ধরতে হয়। এছাড়া এইডস মতো যৌন রোগের সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা কিংবা সমাজের ভুল ধারণা দূর করার কাজও এই ধরনের নাটক বা থিয়েটারের মাধ্যমে হতে পারে।
  • মনে রাখতে হবে এই সকল তথ্য প্রচারের সময় নাটকটিকে এমনভাবে বোনা যাবে না যাতে সাধারণ মানুষের মধ্যে অকারণ ভীতির সঞ্চার হয়। ভয় কাটিয়ে মানুষ যেন বুঝতে পারে কিসে তাদের ভাল হবে, কিসে সেই সমস্যা থেকে মুক্তি পাবে। সচেতন করতে গিয়ে মানুষ যেন কোনও ভাবেই সন্ত্রস্ত না হয়।
  • আবার উল্টোদিক থেকে নাট্যকর্মীদের ওপরও আঘাত আসতে পারে। কারণ যে সকল বেআইনি কার্যকলাপ নিয়ে নাটকের মাধ্যমে প্রচার কাজ করা হচ্ছে, সেই নাটকের কাহিনীতে যখন সত্য উদ্ঘাটিত হয় তখন সেই নাট্যস্থলে অপরাধীর উপস্থিতি অপ্রত্যাশিত নয়। তাই আঘাত আসাটা অসম্ভব নয়।

(চলবে)

RELATED ARTICLES
- Advertisment -

Most Popular