দুলাল চক্রবর্ত্তী
গত ১৮ জুলাই সন্ধ্যায়, তৃপ্তি মিত্র নাট্যগৃহে পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমির তত্ত্বাবধানে এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য সংস্কৃতি বিভাগের ব্যবস্থাপনায় এ বছরের প্রথম স্মারক বক্তৃতা অনুষ্ঠিত হলো। এদিন ছিল শম্ভু মিত্র স্মারক বক্তৃতার পালা। আলোচ্য বিষয় ছিল ” গ্রুপ থিয়েটার সত্য না মিথ “। মুখ্য আলোচক ছিলেন, স্যাস পত্রিকা সম্পাদক সত্য ভাদুড়ি। সভা মুখ্য ছিলেন প্রবীণ নাট্য নির্দেশক, অভিনেতা পঙ্কজ মুন্সী। সভাগৃহে উপস্থিত ছিলেন অসিত বসু, ভদ্রা বসু, গৌতম মুখোপাধ্যায়, উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়, শেখর সমাদ্দার সহ আরো নাট্য পিপাসু নাট্য উদ্ভাবক ও কর্মীবৃন্দ। এদিন আলোচনার শুরুতেই নাট্য আকাদেমি সচিব, দেব কুমার হাজরা আগামীতে অনুষ্টিতব্য জুলাই আগষ্ট সেপ্টেম্বর জুড়ে চলা ৮ টি স্মারক বক্তৃতা মালার বিষদ অবগতি দিতে এবারের আহবায়ক সম্রাট মুখোপাধ্যায়কে সামনে নিয়ে আসেন। তিনি এবারের ৮ কৃতি নাট্য অভিজ্ঞান স্বরূপ স্মারক বক্তৃতায়, শম্ভু মিত্র, বাদল সরকার, অজিতেশ বন্দোপাধ্যায়, উৎপল দত্ত, বিনোদিনী, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, গিরিশচন্দ্র ঘোষ ও শাঁওলি মিত্র, প্রমুখ দের এবারে কোন উল্লেখ-কারণে তালিকা বদ্ধ করা হয়েছে। তার প্রাসঙ্গিকতা বিষয়ে বলেন। সম্রাট বাবু জানান, অতীতের নাটক দেখার জন্যে নির্ধারিত বৃহস্পতি ও শনিবারগুলিই, এবারে পরপর ক্রমান্বয়ে এই আলোচনা সভা এবং পরিচালকের মুখোমুখি সাক্ষাৎকার ভিত্তিক আলাপচারিতার দিন হিসাবে ধার্য্য করা হয়েছে। মূল আলোচনায় সত্য ভাদুড়ি বিবৃত করেছিলেন, ১৯২৮-৩২ সালের মধ্যে, আমেরিকায় কোন রাজনৈতিক চাহিদায়, কোন স্বপ্নের কামনায়, গ্রুপ থিয়েটার কনসেপ্ট জন্মেছিল। সেখান থেকে উদ্ভুত হয়ে, সাফল্যের দিকে এগিয়েও, কীভাবে আমেরিকায় পুঁজিবাদী রাজনৈতিক চাপে গ্রুপ থিয়েটার চর্চায় প্রতিবন্ধকতা আনা হয়েছিল। সাম্রাজ্যবাদী তৎকালীন ফ্যাসিস্ট সরকারের ধ্বজা উচিয়ে চলায় ১৯৪০ সালে গ্রুপ থিয়েটার নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল। প্রায় একই সময়ে ভারতে দেশের স্বাধীনতা প্রাক্কালে সাম্যবাদী চিন্তার সম্প্রসারণে, দুর্ভিক্ষ অনাহারে মরা মানুষের কথা বলতে চেয়ে, নবান্ন নাটকের উঠে আসার পরিপ্রেক্ষিতে, কীভাবে গণনাট্য ভাবনার জন্ম হয়েছিল। যা পেশাদারী থিয়েটারকে চমকে দিয়ে দর্শকদের চাহিদায় হঠাৎই জন্মেছিল। কিন্তু অল্প সময়ে নবান্ন নাটকের সার্বিক ২৫টি প্রদর্শনের মধ্যেই সেই ইতিহাসের যাবতীয় স্বপ্ন বাস্তবতা এবং বামপন্থার অদূরদর্শী রাজনৈতিক চিন্তা বিচার কীভাবে শিল্পীদেরই বিবেচনায় কোণঠাসা হয়ে ঝিমিয়ে পড়েছিল। তিনি আলোচনায় তা ব্যাখ্যা সহ তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু তিনি গ্রুপ থিয়েটারের স্পর্শকাতর বিষয়ে সজাগ ছিলেন। ব্যক্তিগত কোন মন্তব্য করেন নি। বাংলা নবনাট্য ইতিহাস বিভিন্ন গ্রন্থে যেভাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে, তা-ই নিজের সুলিখিত প্রতিবেদনে তিনি পাঠ করেছিলেন, একেবারেই নিরপেক্ষ দ্রষ্টা হিসাবে। যাতে বুঝে নেওয়া গেছিল, মানুষের পক্ষে, মানুষের হয়ে নাটকে সমষ্টির কথা বলায়, সামাজিক রাজনৈতিক সব প্রেক্ষিতেই, প্রত্যক্ষ রাজনীতির ছত্রছায়া বিচ্ছিন্ন হ’য়ে নিজের শিল্প চেতনায় গ্রুপ থিয়েটার আদি থেকেই ব্যক্তি কুশলতাসম্পন্ন নাটকের প্রচলনকেই উৎসাহিত করে গেছিল। তাই, কেন নাটকের আবাদে চাষি শ্রমিকের আন্তরিক যোগদান সম্ভব করা গেল না। কেন থিয়েটার গ্রাম মুখি হলো না? তাও সময়ের অতিহাসে লিপিবদ্ধ অনুমান। পেশাদারি ভাবনার ভাঙ্গা বনেদে শিল্পী-শিল্প কোন্দলে তৎকালীন কোন ঐতিহাসিক সত্যে গণনাট্য বা পিপলস থিয়েটার ভাবনার প্রতিষ্ঠাতা জনক, চার কিম্বদন্তী পুরুষ, শম্ভু মিত্র, বিজন ভট্টাচার্য, উৎপল দত্ত, অজিতেশ বন্দোপাধ্যায়ের কেউ-ই উল্লেখযোগ্য পথ দেখাতে পারেন নি। নগর নাট্য থেকে বেড়িয়ে বাংলার আদিগন্ত জুড়ে গ্রুপ থিয়েটার শব্দের ধারক বাহক করে দেবার আদর্শ অবস্থানে কেউ-ই নিজের কাজের ধারা নিয়ে পৌঁছতে পারেন নি। এক ঘন্টা সময়ের এই আলোচনা তাই বিষন্নতা ভরা ছিল। আমরা কে কী, নাটকের সঙ্গে কোথায় চলেছি…. প্রশ্ন ছিল সেখানেই। কে কোথায় দাঁড়িয়ে আছি বুঝে নেওয়ার এই আসন্ন সময়ে আমরা বিলাসের বিছানা শুয়ে বিলাপ বকে চলেছি না-কি? সেই ভাবনার প্রাচীরেও ফাটল দেখতে পারলো এই স্মারক বক্তৃতা। আমাদের নাটকের হতে পারা না পারার বিগত ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে এই বক্তৃতা তুলে ধরেছিল। সব শুনে মনে হয়েছিল, গ্রুপ থিয়েটার অস্তিত্ব অসংখের শ্রমে সত্য অবশ্যই। কি হয়েছে আর কি হয়নি তাই কেবল নয়। নাটকের শুরুতেও মানুষ। শেষেও মানুষ। সেদিনের নাট্য স্বপ্নে যতটুকু শক্তি ছিল, বা অধরা চাওয়া কালের চাপে ফুরিয়ে গেছিল। শম্ভু মিত্রের চাওয়া পুষ্ট বহুরূপীর ভাল নাটক ভালভাবে করতে চাওয়ায় যে আকাঙ্খা ছিল। সেখানেই ছিল নাটকের চলায় ইচ্ছা শক্তির যাদু। গ্রুপ থিয়েটার এভানেই মিথ বৎ আবেগ উৎসাহ দিয়েছিল আরো আরো প্রাণের শিল্পীত চাহিদায়। প্রতিবাদী থিয়েটারের জন্যে উৎপল মানস, নিশ্চিতই সফল। কেন না বঞ্চনা আর প্রতারণা রুখতে গণ চেতনায় মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, উৎপল চিন্তার ধারণা টুকুই আজও সম্বল। তেমনই অনুবাদ নাটকের ক্রম চর্চায় অজিতেশ-নান্দীকার সু নাট্যের পথ প্রদর্শক অবশ্যই। মানুষই পারে আমাদের আদর্শ নাটকের ব্যাকরণ তৈরী করতে। তাই বাংলার চতুর্দিকে চালু নাট্যায়নের যতটুকু ভাল আছে, তার কেন্দ্রে, সেদিনের ওই সহজিয়া চিন্তার প্রতিফলনেই ফলিত নাট্যকর্ম বিবিধ অবস্থানে সময়ের দ্বান্দ্বিক চলনে নিয়ে তো যাচ্ছে বাংলা নাটককে আপন কাঁধে বয়ে? শ্রদ্ধেয় সত্য ভাদুড়ি তাঁর দৃঢ় কন্ঠস্বরের নির্মোহ উচ্চারণে, দ্যোতনা বিহীন বাচিক আলাপনে সত্য টুকুই বলেছেন। কোথাও কোন ভাবে প্রায় মনিষী সমানদের অপব্যাখ্যা তিনি করেন নি। অন্ধ অন্ধকারে চাপা পড়ে থাকা, রাজনৈতিক ব্যবহারে এই অর্ধ শিক্ষিত সমাজে গ্রাম্য কৃষকদের, বা শ্রমিক সম্প্রদায়ের পেটের টান কীভাবে যে লোভে লালসায় অ-সাংস্কৃতিক জীবনাদর্শে প্রক্ষিপ্ত হয়ে চলেছে। তার মুক্তি পথ গ্রুপ থিয়েটারই দেখাবে। বিতর্ক নয়, শুধু চিন্তা সূত্র উসকে দেওয়ায় নাট্য আকাদেমি আয়োজিত এই স্মারক বক্তৃতা এক অভিজ্ঞান হলেই নাংলা নাটকের আগামী ভাবনার সম্প্রসারণ এগিয়ে যেতে পারে। ২৫ জুলাই থেকে ৮ আগষ্ট পর্যন্ত পরপর তিনটি বৃহস্পতিবারে বাদল সরকার, অজিতেশ বন্দোপাধ্যায় ও উৎপল দত্ত স্মারক বক্তৃতায়, যথাক্রমে “থিয়েটারে দৃশ্যশিল্প ভাঙ্গছে”, “অভিনেতার ভয় ও আশঙ্কা” এবং “পরিচালকের সংগঠন” শীর্ষক আলোচনায় ক্রমিক বক্তা থাকবেন শোভন তরফদার, সুরজিৎ বন্দোপাধ্যায় ও মেঘনাদ ভট্টাচার্য।