দুলাল চক্রবর্ত্তী, ফরাক্কা
নৈহাটি ঐকতান মঞ্চে অভিনীত হলো বর্ধমান প্রয়াস সংস্থা প্রযোজিত, মানুষের ভীত অস্তিত্ব প্রসঙ্গের নাটক ‘পরাশরের পাসওয়ার্ড’। ৫৫ মিনিট সময়সীমার ছোট নাটক। কাঁচরাপাড়া ফিনিক আয়োজিত নবম বর্ষ মিলন সাংস্কৃতিক উৎসব ২০২৪ এ, সারাদিন ব্যাপি নাটকাভিনয় অনুষ্ঠানে, ১৭ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় দেখলাম। নাটকের রচয়িতা অরিন্দম সেনগুপ্ত। প্রয়োগ ও চালনায় বর্ধমানের অন্যতম বিশিষ্ট নাট্যজন উদয় শঙ্কর মুখোপাধ্যায়। আলোক চিন্তায় গোপাল রাজ। আবহ ভাবনায় সৌমব্রত দত্ত। মঞ্চ প্রকরণে দীপ্তিমান কর, দীনবন্ধু মুখোপাধ্যায় ও রৌম্য।
গত বছর এই আয়োজনেই বর্ধমান প্রয়াসের বুড়ো হওয়ার ওষুধ নাটকটি দেখেছিলাম। মজা হাসিতে, কৌতুহল ঔৎসুক্যে জমাটি নাটক। একটি মনোমুগ্ধকর হাস্য কমেডি। গল্পটা সুন্দর। একজন প্রৌঢ় তার বার্ধক্যে সক্ষম পুরুষ। প্রায় যুবকের মতো শরীর মনের অবস্থা। কিন্তু তাতেই বিপত্তি। সংসারে বার্ধক্যজনিত জীবন দর্শনকে উপেক্ষা করে, ভোগ লালসায় যদি সে তরতাজা থাকে। তাহলে বউয়ের খুবই সমস্যা হয়। তাই তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে তান্ত্রিকদের কাছে পাঠিয়ে বুড়ো হওয়ার উপায় কী, কীভাবে বুড়ো হয়ে ধম্ম কম্মে মতি দিয়ে জড়বৎ হয়ে জরা ব্যাধিকে বন্ধু করে গৃহ বন্দী হয়ে থাকার চেষ্টা করতে হবে, সারা নাটকে তা-ই বাতলানো হয়। এই এনার্জিপ্যাক বৃদ্ধ কাম যুবককে ট্যাকেল করতে স্ত্রীর হিমসিম অবস্থা। এতেই দাম্পত্যকলহ চলে। অতএব কী করে যাদের মনের বয়স যুবকের মতো, তাদের এই বাধ্যতামূলক দাম্পত্য জীবনে স্ত্রীর বশীভূত হয়ে, স্ত্রীর অভিমতগত ভূমিকাকে মন্যতা দিতেই হবে। সংসারে শান্তির জন্যে। সেই আলেখ্যদর্শন যদিও হাস্য রসে মোড়া। কিন্তু বাস্তব পর্যালোচনা ও ব্যাখ্যায় অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ ও মর্মান্তিক লেগেছিল। স্ত্রী শাসিত সংসারে, পুরুষের এই বার্ধক্যজনিত বয়োবৃদ্ধতার অসহায়তায়, কীর্তি কর্ম শেষের দিনান্ত বেলায়, সহানুভূতিহীন বৌয়ের অনুশাসনে, জ্যান্ত জীবনকে কীভাবে নিস্ক্রিয় ও বোঝা বানিয়ে শো পিস বানিয়ে সাজিয়ে রাখে। তার দাওয়াই বলা এই নাটক সব ভাবেই মুগ্ধ করেছিল। দুরন্ত নাটকীয়তা, ক্ষুরধার সংলাপ, চমৎকার অভিনয়। এটিও এই সময়ের গুটিকয়েক মজাদার হাসির নাটকের মধ্যে অন্যতম। কিছু চরিত্র বন্টনের অসামঞ্জস্য নজরে পড়েছিল। কিন্তু সেসব টপকে নাটকের টেক্সট এবং প্রসেসিং চমৎকার ও যুগোপযোগী লেগেছিল। খুব ভাল স্বামীর ভুমিকাটি ছিল। উদয় শঙ্কর মুখোপাধ্যায় চরিত্রটি উপহার দিয়েছিলেন।
এবারে দেখলাম পরাশরের পাসওয়ার্ড নাটক। একেবারেই আলাদা। একটা ম্যাজিক রিয়েলিটির টেক্সট। সবার জীবন এখন ভীত সন্ত্রস্ত। চারিদিকে যা চলছে কে যে কীভাবে কাকে পেটে চালান করবে, সেই আতঙ্ক বুকে বয়েই সবার নিত্যদিনের যাপন চলছে। আশের মানুষকে অচেনা লাগে। কারো অভিসন্ধি কেউ জানে না। তাই চার দেওয়ালের দরজা বন্ধ থাকলেও চিন্তা চেতনায় ভয় উদ্রেককারী চরিত্রগুলি ঘুমে জাগরণে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। এমনই এক অলীক চরিত্র, মুকুন্দ শ্যাম। মধুজা তরুণীর রিয়েলিটির মধ্যে চলে আসে। মুকুন্দ শ্যাম চক্রান্ত করেছে। এই পরিবারকে ভয়ের চাবুক মেরে এক অস্বাভাবিক জীবনে নিয়ে যাবে। তাই সে মধুজাদের বসার ঘরে দিব্যি ঘুরেবেড়িয়ে লম্ফঝম্প করে। কিন্তু মধুজা ছাড়া কেউ-ই তাকে দেখতে পায় না। সবার পাশে সে ঘুরছে। মৃত্যু আতঙ্ক ছড়িয়ে দিচ্ছে। যে সাহসী সে ভয়ডর পায় না বলেই দেখতেও পায় না। কিন্তু মধুজা সংসারের টেনশন এমন এক জায়গায় নিয়ে গেলো, সেখানে টিভি সারাতে এসে পরাশর এমন মানসিক শক্তি বৃদ্ধির এমন পাসওয়ার্ড বলে যায়। এতক্ষণ ল্যান্ডফোনে মুকুন্দ শ্যামের কন্ঠস্বর ভেসে এসে, একের পর এক দুঃসংবাদ দিয়ে মধুজাকে কাতর করে তুলেছিল। পরাশর দিল খোলা গানও গায়। উপযাচক হয়ে উপদেশও দেয়। ধ্বংসের কিনারা থেকে পরিবারকে বাঁচায়।
নাটকে পরাশরের ভূমিকায় দুরন্ত অভিনয় করেছেন উদয়শংকর মুখোপাধ্যায়। এমন অভিনয়ের পাশে সকলেরই যোগ্য ও যুত বদ্ধ নাট্যায়নের উপযুক্ত পার্ট অ্যান্ড পার্টসোল হওয়া কঠিন কাজ। কারণ ওনার শৈলীগত অভিনয় উঁচু দরের শিক্ষায় রপ্ত করা। নাট্যে সবার তা অধিগত করা কঠিন। তথাপি এই নাটকের ম্যাজিকের জন্যে সেই স্তব্ধীকৃত অনুভূতি দরকার। এই পর্যায়ে তুলনায় কিছুটা হাল্কা লাগে মুকুন্দ শ্যাম চরিত্রে শরৎ বটব্যাল, বাবা কনকেন্দুর ভূমিকায় অরিত্র নন্দীকে। কিন্তু সারা শরীর দিয়ে খেটে তৈরি করা দুরন্ত চরিত্রায়ন মধুজা। এই নাটকের কেন্দ্রে ভয় আতঙ্কে টেনশনে নীলাঞ্জনা দাস তাঁর পরিণত অভিনয়ে নাটকের সাসপেন্সকে তীক্ষ্ণ করেছেন। সেই তালে মেতে থেকেছেন তার দাদা হিমাদ্রী / দীপ্তিমান কর এবং মাসতুতো দাদা / দীনবন্ধু মুখোপাধ্যায়।
আমাদের জীবনের চলমানতায়, দূরদর্শনের নীল পথ ধরে অন্ধকারের মুকুন্দ শ্যামেরা বার বার আসে। আমাদের বিনোদ বিনোদনের এসেন্স গায়ে মেখে এরা আমাদের সাথেই খা দায় ঘুমায়। এই অলীক কিন্তু অনিবার্য উপস্থিতিতে এরা সমাজ, সংসার মানুষ ও মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকা সুপ্ত অনুভূতি গুলোকে মেরে ফেলতে চায়। এরা ঘুলঘুলির চোরা পথে এসে নিরুৎসাহিত জীবন যাপনের মধ্যেই আবিষ্ট মনকে হতাশা অবসাদের নাগপাশে শ্বাস রোধ করে নিঃশেষ করতে চেষ্টা চালায়। এ ভাবেই মধুজার জীবনের সব রঙ ধুয়ে মুছে আঁধারের খেলা চলে। কিন্ত সে কী এই খেলার স্রষ্টা? সে কী চায় এই খেলা খেলতে? এ তো এক কালিমাখা ধ্বংসের খেলা। আত্মক্ষয়ের জন্যেই উদ্বিগ্ন দুশ্চিন্তা থেকে রেহাৎ চাই। জানি তো সবাই কালোর উল্টোপথে হাজার রঙবাক্স হাতে জীবন দায়ী ওষুধ হয়ে পরাশররাও তো অপেক্ষা করে আছে। অজানা এক সাহসের পথ ধরে অন্ধকার সরিয়ে আলোর পাসওয়ার্ড তুলে তো তারাই দিতে পারে মধুজার হাতে। সেই জন্যই তার নামই তো পরাশর। সমাজ, সংসার, জীবনের রঙে জাগে রামধনুর মতো। শঙ্কিত বাস্তবকে সরিয়ে দিয়ে তাই তো সাতরঙা রামধনু আগামীর পথে চোখ রাখে পরাশর ও মধুজা। পরাশর গেয়ে ওঠে… ” আমি কান পেতে রই…….
এই দুটি নাটক দেখে বুঝেছি, বর্ধমান প্রয়াস দল, মানুষের ভেতরের অন্তর্লীন সংবাদকে কর্ষণ করে একটি আন্তরিক সংবাদ দিতেই নাটক নির্বাচন এবং তার অনুপম মঞ্চ প্রকাশকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। যেখানে অভিনয়ের নিপুণতা এবং ব্যাতিক্রমী টেক্সটের স্বতন্ত্র কিছু অভিঘাত প্রাধান্য পেয়ে থাকে। উদয় শঙ্কর মুখোপাধ্যায়ের চরিত্রায়ন দেখে অনুমান করেছি, তিনি একজন অত্যন্ত ফ্লেক্সিবল মঞ্চ শিল্পী। তাঁর নাটকীয় গান গাওয়ার মুন্সীয়ানা এবং সংলাপ লেনদেনে সুক্ষ্মদর্শী ভার্সেটিলিটির অনায়াস স্বচ্ছ সারল্য প্রযোজনাকে বক্তব্য পথে নিয়ে যায়। আগে পরিচয় ছিল না। ওনার নাট্যচর্চা-চালনার ভঙ্গি, চরিত্রদের বিহেভ প্যাটার্ন আবিস্কার, সবাইকে দিয়ে স্বাভাবিক অভিনয় করিয়ে নেওয়ার পদ্ধতিগত শিক্ষন প্রনালী যে গুরুত্বপূর্ণ, তা কাজের চেহারায় ধরা থাকে। আমি তাতে আকৃষ্ট হয়েই গ্রীনরুমে গিয়ে আলাপ জমিয়েছিলাম। তবে এই নাটকের আলোর রিয়েলিটি আ্যবসার্ডিটি নিয়ে কিছু কী ভাবনা দরকারি কি-না, ভাবা যেতে পারে। এই টেক্সট “থানা থেকে আসছি” না “ক্যাপ্টেন হুররা” তা নিয়েই আঙ্গিক স্কিমিং নিয়ে খুঁজে দেখতে হবে। থিম আর বাস্তব মিশে থাকা এই ঘোলা জলের অতলের আছে আরও গম্ভীর ভাষা। জানি না আমিও। ভাবছি।