দুলাল চক্রবর্ত্তী
বর্ধমানের প্রয়াস সংস্থা একটি সমৃদ্ধ নাটকের দল। দলের নির্দেশক উদয় শঙ্কর মুখোপাধ্যায় একজন পরিশ্রমী নাটকের মানুষ। ওনার পরিচালনা, অভিনয় ও নাটক নির্বাচনের আলাদা গুরুত্ব থাকে। বেশ কয়েক বছর আগেই, বর্ধমানের প্রথম সারির কবি অংশুমান করের লেখা গল্পের নাটক ‘বুড়ো হওয়ার ওষুধ”কে মঞ্চে এনেছে বর্ধমান প্রয়াস। নৈহাটি ঐকতান মঞ্চে ২০২৩ সালে প্রথম দেখেছিলাম। আবার দেখলাম তপন থিয়েটারে ১৫ জুন সন্ধ্যায়, বিভাব নাট্য একাডেমির দ্বিতীয় পর্যায়ের উৎসবে, নির্বাচিত ৯ নাটকের মধ্যে। বিন্দুমাত্র শারীরিক উপসর্গ না থাকলেও যদি তারুণ্যে ভরপুর একজন সদ্য অবসর প্রাপ্ত সুধাময় বাবুকে বার্ধক্য প্রাপ্ত করার এক প্রহসন এই বুড়ো হওয়ার ওষুধ নাটকটি। স্ত্রীর হাতে প্রকারান্তরে নিগৃহীত হবার এক হাস্যকর বাস্তবতা, যা যথার্থ বাস্তব থেকে স্বামীর বিরুদ্ধে স্ত্রীর মানসিক দীনতার পরিচায়ক এক কাল্পনিক ঘটনার অনুমান, এই নাটকের সামগ্রিক চেহারা।
বৃদ্ধ পুরুষ মানুষের জীবন যন্ত্রণা খোঁজার এবং তাকে লাবণ্য হীন দেখার আসু পরম্পরায়, এই নাটক দর্শকদের ভাল লাগা প্রযোজনা। কারণ, অধিকাংশ পরিবারেই সংসার গড়ে তুলে নিজের আবাসেই চরম বিতর্কিত থাকেন, সেই সংসারের কর্তা পুরুষ, যিনি কালঘাম ছুটিয়ে সবার বিকাশকে প্রাণ দান করেন। স্ত্রী যদি ৪৫ বছরের পরে নিজের যৌবনের শব্দ না শুনতে পায়, তখন ঘরের পুরুষকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত দেখলেই খুশি হয়। কারণ অন্য মেয়ের কাছে তার গ্রহণ যোগ্যতা ম্লান, মলিন এবং অক্ষম পুরুষ ব’লে অভিহিত হওয়ার ষোলকলা পূর্ণ হয়। পরিচিত বাস্তব ব’লে, তিনি এভাবেই, হয় অবহেলিত। নয় উপেক্ষিত। কিম্বা নিগৃহীত। মনের গভীরে তারুণ্য বর্তমান উপলব্ধি করেও, বুড়ো হওয়ার অভিশাপ মাথায় নিয়েই প্রতিটি পুরুষের বার্দ্ধক্য কমবেশি জর্জরিত হয়। এই ফেমিনিজম এর লাগাম ছাড়া উচ্ছ্বাসে, এখন আর সেই পুরুষ শাসিত সংসার খুব বেশি নেই। যেখানে পুরুষ নিজস্বতার প্রতিবাদ করতে পারে। কারণ সংসারে সে প্রদীপের নিচের অন্ধকার।

এখন নারী স্বাধীনতাকে সম্মানিত করতে গিয়ে হাতের লাগাম ছিটকে পুরুষ একেবারে চিৎপটাং দশায় দিশাহারা আছে। সংসার যদি সংগঠন হয়, তবে তার পকেট গলে উপসংগঠন হচ্ছে, মায়ে পোয়ের মিল। মাতৃ শক্তির মন্ত্র গুণে, মা এবং ছেলে মেয়ের গুপ্ত মিল। যা অনৈতিক এবং অমানবিক। অমানুষ তৈরি হয় এই কারখানায়। পুরুষের ঐকান্তিক ইচ্ছায়। কিন্তু বাস্তবতা,…ফ্যান্টাসি বা মজায় হা হা হাসিতেই ফেটে পড়া সুপ্ততাপ, ভাঙা বিষদাঁতের মাতা নত নীরব যন্ত্রণা। যেন তেন উপায়ে বুড়োকে বার্ধক্য দানের প্রচেষ্টা-উদ্যোগ।
এই বিষয়ের উপরই আধারিত এক ফ্যান্টাসি নাটক এটি। অবসরের পর সুধময় ছেলে তমালের অফিসে গেলে, তার বস সুধাময়কে বাবা না দাদা ভেবে ফেলায়। এবং তা স্ত্রী সুরমার কাছে ছেলে তমাল ফলাও কিরে বলতেই বিপত্তির শুরু হয়। তখনি কেন বাবাকে দাফা মনে হয়েছে, কেন সুধাময় এখনো তরুণ, যদি কোন মেয়ে এসে ঘিরে ফেলে নিরাপত্তা কেড়ে নেয়? ব্যাস, সর্বনাশ, অতএব তাই বাপের মনের তারুণ্য এবং দেহের কোমলতাকে মুছে দিতে পরিবারের স্ত্রী পুত্র উঠে পড়ে লেগে যায়। একজন সক্ষমকে অক্ষম আর্তনাদের পথে ঠেলে দিতে চাইছে নাটকের সুরমা, তমাল। ওদের তাগিদেই গল্প বৃত্ত খুঁজে এনেছে চিকিৎসক সলিউশানন্দ, আর তার চামুণ্ডা চ্যালাদের হম্বিতম্বিকে। কারণ তারাই বুড়ো হবার ওষুধ দেবে। ক্রমে পরিণতি কোথায় যায়, তা দেখিয়েছে বর্ধমান প্রয়াস দলের এই প্রযোজনা।
নাটকের আলোক চিন্তা গোপাল রাজ, আবহ কল্পনায় দীপ্তিমান কর, সাজেস্টিভ মঞ্চ পরিকল্পনায় সৌম্য, রৌম্য, বেদী, এঁরা সবাই সম্মিলিত ভাবে। চরিত্রগুলোকে রূপসজ্জায় সাজিয়েছেন সৌম্যব্রত দত্ত। সব কিছুই ব্যালেন্সে এনেছেন সামগ্রিক পরিকল্পনা ও চমৎকার প্রয়োগে দলের শক্তি উদয়শঙ্কর মুখোপাধ্যায় স্বয়ং। সুন্দর সাবলীল অভিনযয়ে প্রাণবন্ত সুধাময় চরিত্রে উদয়শঙ্কর মুখোপাধ্যায় নিজেই। সুরমা অল্প বয়সের অভিনেত্রী নেহা দাস। স্বাভাবিক সুন্দর অভিনয়ে মুর্ত হলেও বয়েসের ভারিক্কি চাহিদা থেকে যায়। কিন্তু বেমান লাগে বার্ধক্য পীড়িত স্ত্রীর সংযুক্তি কন্টেন্টে, অভিনেত্রী নেহা দাসের তারুণ্য ও লাবণ্যময়ী স্ত্রীর রুপে মঞ্চে আসায়। তবে দারুণ লাগে ছেলে তমাল / সায়ন্তন কুন্ডু, এবং সাগর চরিত্রে দীনবন্ধু মুখার্জী। হাস্যরসের যোগানে সলিউশানন্দ / দেবজিৎ বেদী, চামুণ্ডা / রৌম্যদীপ চক্রবর্তী, চ্যালা দুইজন অরিত্র নন্দী ও সৌম্যব্রত দত্ত। কাল্পনিক চরিত্র মায়াবী কবিতার বেশে শ্রাবন্তী বাশতলা এবং সুর ছন্দ নৃত্যে আসা কবিতারা হয়ে সুতৃষ্ণা সামন্ত এবং সুরঞ্জনা বাঁশতলাকে নান্দনিক পর্যায়েই সীমাবদ্ধ আবেগ উচ্ছ্বাস মন্দ নয়।
নাটকে হাস্যকে কান্নার বিপ্রতীপে ধরা হয়েছে। সুধাময় কবিতা লেখে। কাব্য ময় সংযোগে নারীও বুক ছুঁয়ে চলে আসে। মাউন্টিং কাউন্ট হয়েছে সুরমার প্রতাপ প্রতারণায়। স্ত্রী বস্তুটিকে সংসারে পেয়েও নাটকের প্রেক্ষাগৃহে দেখতে হাসিই পায়। তাই এই নাটকের ভেতরের চাপা কষ্টের আর্তনাদ এই প্রযোজনা দেখাতে চায় নি। কারণ এটি রম্য নাটক। এখানে মানুষের বার্ধক্য কীভাবে যেন উপহাস্য হয়ে যায়। প্রচুর চলতি গানের চটুলতা মজাদার অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। সুরমা তমাল তাদের স্বামী বাবাকে বৃদ্ধ বানাতে গিয়ে ঠক জোচ্চরদের হাতে পড়ে যায়। পারিবারিক চেতনা নাটকে উত্তোরিত কীভাবে হয়েছে, স্বামীর, পরিবারের কর্তার, বাবার অবদানের স্বীকার খুঁজেছিল মন। হয়তো এই বিষয়ে নিজের জীবন উপলব্ধিতে কিছু না বলা কথার চেনা দাগ লুকিয়ে আছে। তাই…..।
নাটকের সিরিয়াস স্তরের ভেতরে কোন কান্না আছে, এই প্রযোজনা দেখে দর্শক নিজের মতো অর্থ খুঁজে নিক, প্রযোজনা সংস্থা তাই ভেবেছে। এই নাটক কিছুটা বিড়ম্বিত করে মজাটুকু খুঁজে নিতে যেমন, তেমনই অন্তর্ভুক্ত থাকা বাস্তবতায় হাসা ছাড়া বার্দ্ধক্যের চাওয়া বলতে তো কিছু নেই। তাই স্ত্রীদের, পুরুষদের কাছে পাওয়া ক্ষমতায় সন্তান এবং কর্ত্তী হওয়ার অবকাশ আজ পুরুষদের গলায় পা দিয়ে, তার সত্ত্বাকে অধিগ্রহণ করে, যে লিমিটেড জীবন দান করছে। তা মর্মান্তিক বটেই। নাটকের উপলব্ধিগত অপলাপ বিলাপে উত্তাল এক জিজ্ঞাসা উঠে এলে সময়ের অতি ফেমিনিইজমের তীক্ষ্ণ তীব্র আগ্রাসনের বিরুদ্ধ প্রতিবাদ চূড়ান্তে এলে, কিছুটা সামাজিক দায়ে নাটকের অবদান মহত্ত পেতে পারে। এসব ব্যক্তিগত চাওয়া বা অভিমত। তবে সুরমার চরিত্র আরো বয়স্কতার ভারে ধারে ক্ষুরধার হওয়া দরকার। রিয়েলিটি স্তরে সুরমার ব্যক্তিত্ব যেন সুধাময়কে আ্যরেস্টেড করে অবদমিত করতে পারে। এখানে বানানো লম্ফঝম্প হচ্ছে। যা কেন্দ্রীয় স্তরে আছে বলেই মেনে নিতে কষ্ট হয়। হয়তো হাস্যরসে চলে ঠিকই। কিন্তু বর্ধমান প্রয়াস দলের নাটকে, চলায় বলায় রায়বাঘিনী প্রতাপ এলে অনেক স্থীর প্রতাপে সুধাময় যেন প্যান্টে পেচ্ছাপ করে ফেলে, এটাই অজান্তের কামনা হয়ে যায়। এটার স্বাদ দ্বান্দ্বিকতায় এই বুড়ো হওয়ার ওষুধ এর তিক্ততা এবং চূড়ান্তে ফিউজ প্রতাপে সুধাময়কে আসল শক্তি পারে।
ওষুধ অনেক রকমের হয়। কারণ রোগ ও হয় অনেক প্রকারের। সেক্ষেত্রে রোগ নির্ণয় এবং ওষুধ প্রয়োগ দুটোই খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু যদি রোগ না হয়! কোনো উপসর্গ না থাকা সত্ত্বেও যদি আপনার প্রিয়জন আপনাকে ডাক্তরের কাছে নিয়ে গিয়ে আপনার চিকিৎসা করিয়ে নিয়ে আসে! আজগুবি শোনাচ্ছে তো! দূর, এসব আবার হয় নাকি? হয় হয়। মানুষের মনে বিচিত্র জটিলতার যে জাল বিছানো রয়েছে তার নাগাল পাওয়া খুবই দুরহ ব্যাপার।
বর্ধমান প্রয়াস’ নাট্যগোষ্ঠির উপস্থাপনা “বুড়ো হওয়ার ওষুধ” নাটকে এ সেরকমই এক মানসিক জটিলতা তৈরী করলেন নাট্যকার অংশুমান কর। আর তাকে চলমান প্রবাহে গতি দিলেন পরিচালক উদয়শংকর মুখোপাধ্যায়।
গল্পের থেকে তুলে ছেকে পাই সুধাময়, একজন রিটায়ার্ড পার্সোন, কবিতা লিখতে ভালোবাসে, বয়স ষাটের এর বেশি, তবু তার মন এবং শরীরে তারুণ্য, চুলে এখনো পাক ধরেনি, শরীরে বয়সের ছাপ পড়েনি। উল্টো দিকে গল্পের প্রদত্ত সূত্রে সুরমা তুলনায় যথারীতি বয়সের ভারে ভারিক্কি, আংশিকভাবে মনে শরীরে বার্ধক্য এসে থাবা বসিয়েছে। তাই সমতাসূচক কামনায় সুধাময়ের ভালোলাগা, আনন্দ, আহ্লাদ, বয়সের মাপকাঠিতেই, চুলে পাক ধরা, টাক পড়াই কাঙ্ক্ষিত। এই বয়সে হাতে পায়ে গেটে বাত নিয়ে কাবু না হয়ে সে যদি দৌড়ে হারিয়ে দেয় ছেলের বয়সি স্পোর্টস ম্যানকে! চিন্তারই কথা। আধ্যাত্মিকতা হীন এই পুরুষ কেন নপুংসক হচ্ছে না? যার মনে পরকালের চিন্তা না এসে কবিতা আসে, প্রেমাবেগ আসে, স্বপ্নে কবিতারা পরি হয়ে নেমে আসে! এ কি সুস্থতার লক্ষণ?
অংশুমান করের নাটক “বুড়ো হওয়ার ওষুধ” এ অনেক ব্যাঙ্গ চিত্র লুকিয়ে ছিল, যার অনেক ছবিই নির্দেশক উদয়শংকর মুখোপাধ্যায় প্রাণ সঞ্চার করে নাটকের মঞ্চায়ন করেছেন। নিজের সামর্থ্য এবং সাবলীলতা তিনি সুধাময় চরিত্রে দাপটের সঙ্গে মঞ্চ ব্যবহারে প্রমাণিত করলেন।