দেবা রায়
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির নাট্যশালা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়। কাগজে বিজ্ঞাপন হল বহুবিবাহ সম্বন্ধে যে একটা নাটক লিখে দিতে পারবে তাকে দুশো টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। রাম নারায়ন তর্করত্ন লিখলেন সেই নাটক, নাম দিলেন ‘নবনাটক’। অতঃপর তাকে সেই টাকা তো নগদে দেয়া হয়েছিল, সাথে একটা দামী শালও দেয়া হয়েছিল। ‘নবনাটক‘-এর প্রথম অভিনয়- ১৮৬৭ সালে।
বেলী সাহেব জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরকে জেনানা ভেবে ভুল করেছিলেন…
নট সেজেছিলেন নীলকমল মুখোপাধ্যায় আর নটী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। তখনকার থিয়েটার নট নটী ছাড়া চলতো না। নটীকে আসল মুক্তোর মালা হীরের গয়না পরানো হয়েছিল।
অবন ঠাকুরের লেখা থেকে পাই-
“একদিন নটী থিয়েটারের বসে হারমোনিয়াম বাজাচ্ছেন এমন সময় বেলী সাহেব ঢুকছেন গ্রিনরুমে কাকে যেন অভিনন্দন করতে। ঢুকেই তিনি পিছু হটে এলেন , বললেন- জেনানা আছে ভিতরে। শেষে যখন জানলেন জ্যোতিকাকা মশায় নটী সেজে বসে বাজাচ্ছেন তখন হাসির ধুম পড়ে গেল। বলেন, কী আশ্চর্য একটুও জানবার জো নেই, ঠিক যেন জেনান বলে ভুল হয়!”
থিয়েটারে মন্দ স্ত্রীলোকদের আমদানী সম্পর্কে…
১৮৫৫-৫৭ এর আগে থিয়েটারে স্ত্রীলোকেদের আমদানি হয়েছিল, কিন্তু তা বেশিদিন টেকেনি। তার দাঁড়ি যুক্তরাই ফিমেল পাঠে ব্যস্ত ছিল। বাবু নবীন চন্দ্র বসু বুকের পাটা দেখিয়ে ১৮৩৫ সালে তাঁর নাট্যশালায় ‘বিদ্যাসুন্দর’ এর অভিনয়ের জন্য চারজন মন্দ স্ত্রীলোককে মঞ্চে টেনে তুলেছিলেন। তাঁরা ছিলেন রাধারাণী, জয়দুর্গা, রাজকুমারী আর বৌহরো ম্যাথরাণী। এঁদের সকলকেই পতিতালয় থেকেই আনা হয়েছিল। বাবুরূপী জ্ঞানীগুণীজন ম্যাথরাণীর প্রশংসা করেন নি। বাকিদের নাম নিয়ে প্রশংসা করেছিলেন। সুলভ সমাচার পত্রিকায় লেখা হয়েছিল-
‘সিমলার কতকগুলি ভদ্রসন্তান বেঙ্গল থিয়েটার নাম দিয়া আর একটি থিয়েটার খুলিতেছে। … যে যে স্থানে পুরুষদের মেয়ে সাজাইয়া অভিনয় করতে হয়, সেই স্থানে আসল একেবারে সত্যিকারের মেয়েমানুষ আনিয়া নাটক করিলে অনেক টাকা হইবে- এই লোভে পড়িয়া তাহাঁরা কতকগুলি নটীর অনুসন্ধানে আছেন। … মেয়ে নটী আনিতে গেলে মন্দ স্ত্রীলোক আনিতেই হইবে, সুতরাং তাহা হইলে শ্রাদ্ধ অনেকদূর গড়াইবে। কিন্তু দেশের পক্ষে তা নিতান্তই অনিষ্টের হেতু হইবে।‘
অশ্লীলতার দায়ে ‘বারবধু’ অথচ মঞ্চেই শ্লীলতাহানি…
কেতকী দত্ত বাংলা রঙ্গমঞ্চে একটি বহু আলোচিত নাম। সে বিতর্কের দায় তাঁর নিজের নয়। তিনি জীবন বৃত্তের অশুভ শক্তির শিকার। নাটক তাঁর জীবনের অনেক বড় অংশ দখল করে রেখেছে। স্বামী আর পুত্রের সন্দেহ, তার সাথে অসীম চক্রবর্তীর সম্পর্ক। আর অসীম চক্রবর্তী এমন একটি নাম যার ইতরপনার শিকার কেতকী দত্ত নিজে। তখন বাংলা পেশাদার রঙ্গমঞ্চে সব তারকাদের ভিড়। কে নেই, ভানু বন্দ্যপাধ্যায়, অনুপকুমার, লিলি চক্রবর্তী, বাসবী নন্দী, সাবিত্রি চট্টোপাধ্যায় প্রমুখরা।
অসীমবাবু কেতকী দত্তকে নিয়ে নতুন ছক কষলেন। ‘বারবধু’র মঞ্চায়ন। একদিকে বাড়িতে অশান্তি, অধিকাংশ সময় প্রতাপ মঞ্চে নাটক নিয়ে সময় কাটিয়ে রাতে বাড়ি ফিরেও শান্তি পান নি কেতকী দেবী। বারবধুতে তিনি লতার চরিত্রে অভিনয় শুরু করলেন। প্রথম দিকে এই নাটকে লোক আসে নি। অনেক চক্রান্ত করে অসীম বাবু বিজ্ঞাপণে লিখলেন, ‘ভালোবাসার ব্লো হট… ব্লো হটেষ্ট নাটক’ শুধু লিখেই বসে রইলেন না, বিজ্ঞাপণের সাথে নাটকের একটি অন্তরঙ্গ দৃশ্য জুড়ে দিলেন। কেতকীকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে তাঁর ব্লাইউজ ছিড়ে নিচ্ছেন অসীম।
এরপর প্রতাপ মঞ্চে ভীড় আটকানো মুশকিল হয়ে পড়েছিল। কাউন্টারে জনতার ঢল নেমেছিল। ক্রমে কেতকীর নাম যশ অর্থ সবই বাড়তে লাগলো। শুরু হল অসীমের সাথে তাঁর ইগো কনফ্লিক্ট। এখানে শুরু হল কেতকীতে যন্ত্রনা দেওয়ার পালা। তাদের ভালোবাসা পাল্টে গেল হিংসায়। অসীমবাবু মঞ্চে সেই ব্লাউজ ছেড়ার দৃশ্যে ইতরামি আরম্ভ করলেন। প্রথমে ব্লাইজ ছেঁড়ার দৃশ্যটিতে ব্লাউজ ছেঁড়ার সাথে সাথেই আলো নিভে যেত, কিন্তু প্রতিহিংসা পরায়ণ অসীমবাবু, আলো না নেভানোর নির্দেশ দেন, আলো থাকা অবস্থায় অসীমবাবু, দর্শকের সামনে এই অশ্লীল কর্মটি চালিয়ে যেতে থাকেন, তার পাশবিক অত্যাচারে ক্ষতবিক্ষত হতে থাকেন বাংলা এই প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী কেতকী দত্ত। তিনিই সেই থিয়েটারের একমাত্র মুখ হয়ে উঠলেন। ৭২ থেকে ৭৫ এভাবেই চলেছিল মঞ্চের ওপর নির্যাতন। তিনি কতোটা পাশবিক হয়ে উঠেছিলেন সেটা তার দাম্ভিক সংলাপে প্রকাশ পায়-
‘চব্বিশটা ব্লাউজের অর্ডার দাও, রোজ ছিঁড়বো!’
নাটকের ইতিহাসে এরকম জঘন্ন গল্পকাহিনী নাট্যকর্মকে সে সময়ের জন্য কলঙ্কিত করলেও সেই কলঙ্কের দায় যে সম্পূর্ণভাবে অসীম চক্রবর্তীর, সেই ইতরপনা সকল দর্শকই ততদিনে জেনে গেছেন। আর কেতকী দত্ত আমাদের হৃদয়ে থেকে গেছেন তাঁর কৃচ্ছসাধন ও থিয়েটারের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে। আজীবন নাট্যসমাজ তাঁকে সম্মানের আর আদরের সাথে গ্রহণ করেছে।