বিভাব নাট্য একাডেমির নাটক “দিনান্ত”

- Advertisement -

দুলাল চক্রবর্ত্তী

বিভাব নাট্য একাডেমির সাম্প্রতিক নির্মাণ দিনান্ত নাটক। ছোট নাটকের দরবারে একটি স্বাভাবিক অভিনয়ের অভিনব সংযোগ নমুনা। যে কারণে এটি দর্শকদের ভাল লাগা নির্মেদ ও নির্মল নাট্যায়ন। এই নাটকটি লিখেছেন গুঞ্জন প্রসাদ গাঙ্গুলী। নির্দেশনা সহ সামগ্রিক পরিকল্পনা তাঁরই। গুঞ্জন প্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায় নিজেও একজন দক্ষ অভিনেতা। এই নাটকে সে-ই মর্মেই ওনার অভিনয় ও নাট্য ভাবনার সম্যক পরিচয় সর্বসমক্ষে উঠে এসেছে। ইতিমধ্যেই বিভাব একাডেমির সারা রাজ্যে চলা বিভিন্ন উৎসবে অংশদানের মাধ্যমে দিনান্ত নাটকের সাফল্য কথা ছড়িয়ে পড়েছে। এমনিতেই ছোট নাটকের দরবারে বিভাব দলের চলায়, সকলকে সাথে নিয়ে নাটুকে চলার বিবিধ তৎপরতাও চোখে পড়েছে। যা বিভিন্ন অঞ্চলের দলে, নাটকের মহলে আলোচিত হ'য়েও চলেছে। 

এক কথায় দিনান্ত নাটকের শ্রেষ্ঠ সম্পদ সাবলীল দলীয় অভিনয়। নাটকের গঠনে দৃশ্য বিভাজনের সুষ্ঠ সমাধান, সুচিন্তিত আলো আবহের তালে ব্যালেন্সড মঞ্চ কল্পনা খুব কাজে লেগেছে। শিব প্রসাদ মুখার্জী, অবসরপ্রাপ্ত বিপত্নীক মানুষের গল্প বলেছে, সূত্রধর কাম কিঙ্কর খাসনবিশ। সবসময়ের কাজের মেয়ে লক্ষ্মীর মধ্যেই তিনি বেঁচে থাকার উদ্দীপনা পেয়েছেন। দুই ছেলে ফোনে কথা বলে। কিন্তু পাশে নেই। তারা চাকরি সংসার নিয়ে প্রবাসী। জীবনের চাপা অবসাদে তিনি নিজের মৃত্যু কত দূরে আছে, তা জানতে চান জ্যোতিষী অমোঘিনি মাতার কাছে। বেঁচে থাকার একটা পিরিয়ড পেয়ে তিনি নিজের মৃত্যু পরবর্তী করনীয় খুঁজতে শুরু করেন। খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনে সব রকমের সাহায্য দেবার স্বেচ্ছাসেবক কিঙ্কর খাসনবিশের সন্ধান পেয়ে, তার উপর শ্রাদ্ধশান্তি ইত্যাদির দায়িত্ব দেন। আর্থিক লেনদেন হয়। চাপান উতরে স্বপ্নে যমদূত আসে। তাকে নির্ধারিত ৭ তারিখের আগেই নিতে এসেছে এমন চিন্তায় ভাব মগ্নতা আসে। কাকতালীয় ভাবে হার্ট ফেল করে শিব প্রসাদের মৃত্যু হয়। তার ফেলে যাওয়া বাড়ি কিঙ্কর লক্ষ্মীর দখলে চলে যায়। এখান থেকেই, এই দুই যুগ্ম হৃদয়, এমন অসংখ্য অসহায় মানুষের যে কোন উপকারে আসার শপথ নিয়ে কার্যকরী কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। অনেক বাঁক, নাটকীয় টানা পোড়েনে গড়ে উঠেছে হৃদয়স্পর্শী এই নাটক। যা সর্বাত্মক ভাবেই দর্শকদের ভাল লেগেছে।

  তবে, এই নাটকের গল্পে কিছুটা নাটক করে তোলার সাজানো পরম্পরা যেমন আছে। তেমনি আছে কিছু অব্যক্ত মনস্তাত্ত্বিক অভিযোজন জটিলতা। যদিও গল্পকার কিঙ্কর খাসনবিশ, কাজের মেয়ে লক্ষ্মী ও একা হয়ে যাওয়া বিপত্নীক রিটায়ার্ড শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ত্রিকোণ সম্পর্কের নির্মলতা এই নাটকের বিশিষ্ট পবিত্রতা। এই তিন চরিত্রে যথাক্রমে মৈমাক সাহা ভৌমিক, অভিনেত্রী প্রলিপ্তা মুখার্জী, এবং নির্দেশক নাট্যকার গুঞ্জন প্রসাদ বন্দোপাধ্যায়ের সহজ সরল চারিত্রিক রূপদান, এই নাটকের কাহিনীগত আংশিক জটিলতাকে সচল হতে বাধ্য করেছে। চমৎকার মঞ্চ, অনবদ্য আবহ এবং মানানসই আলোর তাল মাত্রায়, ভাঙ্গা বনেদেও পারিবারিক বন্ধন কীভাবে গড়ে নিতে পারা যায়। নাটকের গল্প তা-ই শিখিয়েছে। এই মর্মে বাস্তব থেকে একটু সরে, নাটকের বাস্তবতা আমাদের শুদ্ধস্বরের তাপ মাত্রাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। এমন লক্ষ্মী, এমন কিঙ্কর কী বাস্তব শিবপ্রসাদদের জীবনে মেলে? না-কি মিলতে পারে? তবুও একটা স্বপ্ন অবশ্যই দেখাতে পারে। তাই নাটক দেখিয়েছে। এই তিন চরিত্র সুরে তালে রঙে ভাবে স্বভাবে যে নির্মলতায় হাজির হয়েছে। তা সুঠাম চালনার নৈপুণ্যকেই প্রতিপন্ন করেছে। 

একদিন লক্ষ্মীর মা, এই বাড়িতেই ঝিগিরি করতো। প্রৈঢ় শিব প্রসাদের আর্থিক সাহায্যে লক্ষ্মীর বিয়ে হয়েছিল। তার বর ভিন্ন নারী আসক্ত ছিল বলে নিজের ঘর ভেঙ্গে গেছিল। তাই সে দাদার সংসারে বোঝা হয়ে ফিরে এসেছিল। টিকতে পারেনি বলেই শেষ এবং চূড়ান্ত আশ্রয় হয়েছিল এই বাড়ি। শিব প্রসাদই তার বাবা বা অভিভাবক। বাড়ির এ টু জেড সব কাজ তার। শিব প্রসাদের সাথে মেয়ের মতো খুনসুটি হাসি ঠাট্টা, মান অভিমান রাগ দুঃখের নিজস্ব দাবিতে ভরপুর হওয়া, দুজনের রক্ত-বিরুদ্ধ এক পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা, পারস্পরিক শরিক সম্পর্ক। পাতানো মেয়েই যেন। সিনিয়র সিটিজেন শিবপ্রসাদ খুব একা একজন। দুই ছেলে দিল্লী ও ব্যাঙ্গালোরে চাকরি সূত্রে সপরিবারে থাকে। তা-ই আপনজন বর্জিত এই হতভাগা বাবা মানসিক দিক দিয়ে দুঃখিত থাকে। কিন্তু সে একাই একাধিক তৎপর। সে বৃদ্ধ, কিন্তু সক্ষম, ঋজু মেরুদন্ডী, ও জীবনমুখী মানুষ। চঞ্চল এবং প্রাঞ্জল হৃদয়ের পুরুষ। এ-ই রকমের মানুষ, যে গান শোনে, অতীত স্মৃতি ঘেটে মরে না। হুতাশ বা হতাশাকে পাশে বসিয়ে গপ্পো গাছাও করে না। তবে এমন প্রাণবন্ত মানুষ কীভাবে, কেন, কি কারণে মরতে চায় ব’লেই মৃত্যু দিন খুঁজে চলেছে। এটার মেন্টাল স্টেট আ্যডজাস্টমেন্ট নাটকে পরিস্কার হলে ভাল হয়। বার্ধক্য প্রদর্শন যোগ্য উপাদান নয়। শরীর নিজেই বসে অচলায়তন আকার ধারণ করলেই, এক অসহায়তা থেকে মৃত্যু চিন্তা প্রবীণদের তাড়া করে চলে। বন্ধু বান্ধব স্বজনের নানা বিয়োগ ব্যথিত করে তোলে। শিব প্রসাদ চরিত্রের কথায় এসবের আলাপন এলে ভাল হয়। কারণ জীবন্তিকা শক্তির পাশে বিমর্ষতার কার্যকারণ মেলে না এ নাটকে। আদ্যোপান্ত এই অবসাদহীন কর্মঠ চরিত্রে বিষাদ যথেষ্ট কম। তাই সাইকোলজিক্যাল পারম্পর্য অনুসারে মৃত্যু কালচার করার প্রবণতা ইঙ্গিত চরিত্রে আসা উচিত কি-না, ভাবা দরকার।

নাটকের শ্রেষ্ঠ এবং চমৎকার উপস্থিতি লক্ষ্মী। হাবে ভাবে স্বভাবে, বাস্তব থেকে তুলে আনা এক প্রাণ প্রতিমা লক্ষ্মী সে। দর্শকের সুকোমল বৃত্তি ছুঁয়েই প্রলিপ্তা মুখার্জী দুর্দান্ত কিছু অন্তর আবেগের সকরুণ ধারা পাত সামনে এনেছেন। কিঙ্করও একইরকম বাস্তব সাবলীলতায় অনবদ্য। তাই চারিত্রিক গঠনের বাচিক মিষ্টতায় ও নিপুন শারীরিক অনুভবে মৈনাক সাহা ভৌমিক বিশিষ্টতা পান। শিব প্রসাদ চরিত্রে গুঞ্জন প্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায় নিজে, একজন চর্চিত নাট্যজন। অবশ্যই খুব ভাল একজন নির্দেশক। তিনি এতো সুন্দর ভাবে শিব প্রসাদের মৃত্যু'র মুহুর্তটিকে অকস্মাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ার ধাপ বিন্যাসে উজ্জ্বলতা দিয়েছেন। যা অত্যন্ত পরিমার্জিত অভিনয়ের নমুনা। তিন জনই অসম্ভব সংযত ও মাপে বাঁধা চরিত্র। তাই এই নাটকের অভিনয় বাংলা ছোট নাটকের দরবারে ভিন্ন প্রসঙ্গের একটি গর্বিত সংযোজন বটেই। পাশাপাশি অমোঘিনি মাতা চরিত্রে সীমা দে ও যমদূতের ভূমিকায় দেবাশীষ দে ছোট্ট উপস্থিতিতে যথাযথ বলেই মনে হয়েছে। সারা নাটকের সুর তাল লয়ের মাত্রা বোধ অত্যন্ত নিপুণ। অতএব চালনা ও নাটকের পান্ডুলিপি বৈশিষ্ট্য উল্লেখযোগ্য। নির্মল মৃধা কৃত মঞ্চ,দেবাশীষ চক্রবর্তীর আলো এবং প্রয়াত নগেন দত্তের আবহ দিনান্ত নাটকের প্রয়োজন টুকু মিটিয়েছে। বাড়তি গিমিকের বিড়ম্বনার কারণ ব'লে চিহ্নিত একেবারেই নয়। তাই বলতে হবেই এই দিনান্ত নাটকের জয় অনিবার্য।
- Advertisement -
সাম্প্রতিক পোস্ট
এধরনের আরও পোস্ট
- Advertisement -