দুলাল চক্রবর্ত্তী , ফরাক্কা
মালদার, গাজোলে ১৯৭৭ সালে জন্ম নেওয়া “বিষাণ একটি নাট্য দল” এর নাটক রাজরক্ত, এই সময়ের ধর্মীয় মৌলবাদ প্রসঙ্গের চেতনায় কিছু কিম্বদন্তী সংবাদ দিল। রূপায়ণের অভিনবত্বে এটি বিষাণের একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ উপস্থাপনা হয়েছে।
গাজোলের নাট্য রেওয়াজে অতীত ছাড়িয়ে নতুন আলোর কিরণ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাজর্ষী উপন্যাস এবং বিসর্জন নাটকের ভেতরের গল্প ও অন্তর কথা নিয়েই নির্দেশক দেবাশীষ দত্ত চমৎকার একটি ডাইরেক্টরিয়াল নাট্য পান্ডুলিপি তৈরি করেছেন। এই নাটকের সবটাই, যেমন আলো, পোশাক, মঞ্চ এবং চারিত্রিক বিক্ষেপে অভিনয়গুলির অন্তর্ভুক্ত ছবি যেমনটি কল্পনা করেছিলেন, মঞ্চের উপর তা-ই এঁকেছেন। যাবতীয় কৃতিত্বে দেবাশীষ দত্ত এই উপস্থাপনার অন্তর্ভুক্ত ও অন্তর্গূঢ় সংবাদের সাথে নিজের নাট্য বিচারকে মিলিয়েছেন।
গাজোলের চলমান নাট্যধারায় একটা বিপ্লবাত্মক কাজ করেছেন। যথেষ্ট মুন্সীয়ানার সাথে দলের শিল্পীদের সাথে তাল মিলিয়ে সকলের আস্থা-সম্পর্কে এই নির্মাণটি প্রসংশিত করেছেন। ওনার সাথে বিষাণের প্রাণ পুরুষ তাপস বন্দোপাধ্যায়ের সামগ্রিক পরিকল্পনা, ও গঠনের শৃঙ্খলায় এবং নির্দেশকের নির্দেশে নিরিখে, সমগ্র কাজের সার্থক তত্বাবধান করেছেন। তাই প্রযোজনার মান চাক্ষুষ করে, দলের বিনয়ী শিল্পী কুশীলবদের যোগদানকে সম্মান জানাতে হবেই। শেখার আগ্রহের কেন্দ্রে সবাই সানন্দে সৃজনাত্মক কাজে মেতেছিলেন। রাজরক্ত নাটকের ডিটেইলস বিন্যাসের প্রতিটি পরতে তা-ই ধরা পড়েছে।
প্রায় নিখুঁত আলোক প্রক্ষেপণে কমল বসাক ও উত্তম কুন্ডু’র হৃদয় প্ররোচিত আবেগ ছিল। একই কথা নাট্য মুহূর্ত গড়ার আবহ প্রসঙ্গে পবন পালের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সমীর সরকার চরিত্রের পোশাকগুলির রঙ বর্ণ প্রকার খুঁজতে নিজের নাট্যবোধকে বিবৃত করেছেন। নাটকের মর্মকথার মর্মান্তিক পশ্চাৎ পরিপ্রেক্ষিতটি এঁকেছেন গৌরী হালদার। রূপ বিন্যাসের কাজে শ্যামলী বন্দোপাধ্যায় ও পবন পালের মুন্সীয়ানার ছাপও মিলেছে। সব মিলিয়ে টেক্সট যে উদ্দেশ্য বিধেয়র মূল সংযোগ কোন ভাবেই লক্ষ্যচ্যুত হয়নি। অবান্তর বা আরোপিত বলে অনুভুত হয়নি কোনকিছুই।
রূপদানে বিভিন্ন চরিত্রে, গোবিন্দমানিক্য- সুবীর ঠাকুর, গুণবতী- শ্যামলী বন্দোপাধ্যায়, রঘুপতি- গদাধর রায়, জয়সিংহ- প্রণব রুদ্র কুন্ডু, অপর্না- টুম্পা ঠাকুর, নক্ষত্র রায়- ছোটন দাস, নয়ন রায়- রবি কুমার দে, হাসি- মৌমি সরকার, তাতা- অদ্রিজ ভট্টাচার্য, দাসী- চন্দনা সরকার, সৈনিক দুজন যথাক্রমে তাপস দাস ও উত্তম কুন্ডু এবং এক ঝাঁক গ্রাম বাসী চরিত্রে উৎপল সাহা, অচিন্ত ভট্টাচার্য, কিঙ্কর কুন্ডু, মৌমি সরকার, রিয়া সরকার ছিলেন।
এই রাজরক্ত নাটকে শ্রেষ্ঠ দুই অলীক অশুভ আত্মার কল্পনাকে অদ্ভুত আত্ম নিবেদনে বাঙ্ময় করেছেন প্রলয় সরকার ও রিয়া সরকার। যার মধ্যে এক হিসহিসে বিষাক্ত সাপের ভূমিকায় অন্তর মনের সমর্থন যুক্ত যুক্তিতে প্রলয় সরকার এ নাটকের মর্মাথে শ্রেষ্ঠ উপস্থিতি হতে পেরেছে। একটি গোলক আলো হাতে নিয়ে প্রলয় নিজের শরীর বিভঙ্গে,মৌলবাদী চরিত্রের পৃথিবীকে খেলনা দিয়ে ভুলিয়ে রাখা বা শাসন করার নমুনায়, হিংসা প্রকটিত করার এক দুরন্ত প্রয়োগকে সার্থক করেছেন।
বাকি সবাইও সফল, নির্দেশকের নির্দেশেই করণীয় করেছেন এই তত্ত্বে। তবে হৃদয়ের সংযোগ কম থেকেছে বেশ কিছু নাট্য মুহুর্তের টানাপোড়েনে সংঘটিত সংঘর্ষে। জয়সিংহ, রঘুপতি, গোবিন্দমানিক্য, প্রমুখের মুখের সাথে তাল মিলিয়ে, মন দেহ, একই কথা শারীরিক ভাষার প্রচ্ছন্ন প্রকাশে আনতে পারে নি। স্বভাবের চিত্ত বৈকল্যে নক্ষত্র রায়ের চারিত্রিক নাটকীয় দ্যোতনা ফুটে ওঠেনি। খুব ভাল লেগেছে টুম্পা ঠাকুরের অপর্না চরিত্রের হাহাকার আর্তনাদের তীব্রতা। তাই নাট্যের আভ্যন্তরীণ চারিত্রিক বিক্ষেপে কিছু চরিত্রের প্রভাবকে উদ্ভাসিত করার দরকার আছে।
তবে গ্রামবাসীদের সাবলীল অভিনয় গ্রুপ এ্যাকশনে তৃপ্তিদায়ক ছিল। চমৎকার কম্পোজিশন, ব্লকিং ও কোরিওগ্রাফি এবং পর্ব ব্যবচ্ছেদে সংলাপ সংকোচন ও রবীন্দ্রনাথকে অনুসরণ করে অলীকত্ব প্রযুক্ত করে, তা অশুভকে বন্টন করতে পারায় নাটক গাঢ় হয়েছে। নিরলস অনুশীলন আর পর্যায়ক্রমিক মঞ্চায়নে এই রাজরক্ত ক্ষুরধার হতেই পারে। কারণ এই অস্থির ধর্মীয় ভাবাবেগে ভেসে চলা রাজনৈতিক অবস্থার মোড় ঘুরিয়ে দিতে, এটি নিঃসন্দেহেই অন্যন্য এক মঞ্চ মায়ার মায়াবী উপস্থাপনা। কাজেই রবীন্দ্র ভাবনাকে মঞ্চে সার্থকভাবে চয়ন করার সামগ্রিক সাধুবাদ বিষাণের পক্ষেই চলে গেল।