অশোক রায়
যাদবপুর ব্যতিক্রম একটি ব্যতিক্রমী নাট্যদল। যারা স্বপ্ন দেখে এক সুন্দর মানবিক সমাজ গঠনের। বিভেদমুক্ত দুর্নীতিমুক্ত রাজনৈতিক দুর্বিত্তায়ন মুক্ত মানবিক সময় আনয়নের। সাম্প্রতিকভাবে তারই প্রতিকল্পে তাদের প্রযোজনা ‘মহাবিদ্যা অধিকন্তু’।
অতীতে এই দলটি আমাদের উপহার দিয়েছে বেশ কয়েকটি মঞ্চ সফল, সমাজ-মনস্ক নাটক। চার অক্ষর এর মতো রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রের অশুভ আঁতাতে সৃষ্ট গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সংকটের ছবি আর তার বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা প্রতিবাদী ও প্রতিরোধী বার্তা। তাছাড়া তাঁদের ঝুলিতে আছে মঞ্চসফল শবর রায়ের ‘কালোব্যাগ’ নাটক। সে যাদবপুর ব্যতিক্রমের নতুন প্রযোজনা সমরেশ মজুমদারের ‘মহাকর্ম’ গল্পের ছায়া অবলম্বনে রচিত নাটক ‘মহাবিদ্যা অধিকন্তু’।
শাস্ত্রানুসারে মহাবিদ্যা হল চৌর্যবিদ্যা। সেই মহাবিদ্যা কিভাবে দুর্নীতিগ্রস্থ রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রশাসনিক হস্তক্ষেপে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তার কালো ছায়া বিস্তার করে চলেছে, তারই এক প্রতিচ্ছবি এই প্রযোজনা। যা আমাদের বোধকে জাগায়, জাগাতে বাধ্য করে। সাথে সাথে এক দুর্নীতিমুক্ত সমাজের স্বপ্নকল্পের ছাপ তৈরি করে যায়।
সম্প্রতি এই নাটকের একটি ক্লোজডোর শো হয়ে গেল যাদবপুরের ‘সংস্কৃতি চক্র’ প্রেক্ষাগৃহে। তারপর তারা একটি আমন্ত্রণমূলক অভিনয়ও করেছেন সুন্দরবনের সরবেড়িয়ায়। প্রথম অভিনয় হিসেবে প্রযোজনাটি বেশ ভালো উপস্থাপনা। আরও অভিনয় ও চর্চার মধ্য দিয়ে এই নাটক দর্শক মনোরঞ্জনের সফল নাটক হিসেবেই বিবেচিত হবে।

এবার আসি নাটকে বিষয়বস্তুতে। সত্যদাস দীর্ঘদিন চৌর্য পেশায় নিযুক্ত রেখেছে নিজেকে। একটি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার। চুরি আর সংসারই তার ধর্ম। তার একমাত্র সন্তান ধর্মদাস আর স্ত্রী কুমুদিনী, এই নিয়ে সংসার। স্ত্রী কুমুদিনী ধর্মকে লেখাপড়া শেখানোর পক্ষে। এবং সেইদিক থেকে ধর্ম ক্রমে বিদ্যার্জন করে একজন কৃতি ছাত্র হয়ে ওঠে। উচ্চ শিক্ষার জন্য নামী মহাবিদ্যালয়ে তার স্থান হয়। নাটকের আর একটি প্রান্ত থেকে এই পরিবারের ওপর প্রশাসনিক ও সামাজিকভাবে একটা নজরদারী চলতে থাকে। কারণ চুরিকে জীবিকা করে সত্য একজন সাধারণ মানুষের মতো জীবন চর্যায় নিযুক্ত, কখনও কোনও ঘটনার জন্যই তাকে পুলিশি ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে হয়নি। শাস্ত্রমতে চৌর্যবিদ্যা অধ্যয়ন করে সেই এই পেশায়। তার শিক্ষাগুরু তস্করাচার্য এসে এই নাটকের মূল কাঠামোকে স্বমূলে নাড়িয়ে করেন। একটি পরিবারের বাপ-মায়ের, তার সন্তানকে নিয়ে আশা ভরসার অন্দরমহলে ঢুকে পড়ে মধু বণিকের মতো এক দোর্দণ্ডপ্রতাপ বেনেয়ারূপী নেতা।
এই নাটক রচনা ও নির্দেশনা দিয়েছেন দেবা রায়। নাটকটির অবশ্যই একটি সম্মিলিত প্রয়াস। কিন্তু বিশেষ ভাবে যাদের অভিনয় গুনে নাটকটি পূর্ণতা পেয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম কুমুদিনী চরিত্রে গ্রেসী চক্রবর্তী। স্বামীর প্রতি দায়িত্ববোধ ও সন্তানের প্রতি বাৎসল্য –এর যুক্তিসঙ্গত প্রকাশের অভিনয় চরিত্রটিকে এক অসামান্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে। সত্যদাসের ভূমিকায় অরুন কুমার অধিকারী পরিমিত অভিনয় নজর কেড়েছে। এছাড়া নেতারূপে মধুদাস, রহমত মোল্লা চরিত্রে যথাক্রমে দীপঙ্কর ব্যানার্জী ও প্রবীর দে তাদের সাবলীল অভিনয় দিয়ে নাটকটিকে পূর্ণতালাভে সহায়তা করেছেন। সন্তান ধর্মদাসের ভূমিকায় অর্কন ব্যানার্জী বেশ ভালো, তবে চরিত্রটি নিয়ে আরও ভাবার অবকাশ আছে। এছাড়া আস্তিক নাইয়া, সঞ্জয় দাস, দেবা রায় সকলেই তাদের নিজ নিজ চরিত্রে যথাযথ থেকেছেন।
দুটি অভিনয় তারা আলোক প্রক্ষেপণ ছাড়াই অন্তরঙ্গ ঢঙ এ করেছেন। আলোক বিন্যাস নিয়ে তারা শীঘ্রই মঞ্চাভিনয় করবেন বলে দলের নির্দেশক জানিয়েছেন। আলোক করবেন সৌমেন হালদার। আর আবহ প্রক্ষেপণে ছিলেন রাহুল দাস। বেশ পরিমিতি বোধ নিয়েই শব্দ ফেলেছেন তিনি। মঞ্চসজ্জা নিয়ে ভাবার অবকাশ আছে।
সব মিলিয়ে এই নাটক ব্যতিক্রমকে আরও পথ তাদের কাজের সুনাম বজায় রেখেই এগিয়ে চলতে সাহায্য করবে।