দেবা রায়
টানা ২৪ ঘণ্টা ধরে নাটক মঞ্চস্থ হবার যে আয়োজন, তা অতি সম্প্রতি সম্পন্ন হয়ে গেল কলকাতার তপন থিয়েটারে। আয়োজক দল মিউনাস। দীর্ঘদিন ধরে চলছে তাঁদের এই আয়োজন পর্বের প্রক্রিয়া। যার কথা অধিকাংশ নাট্যদলই জানেন না হয়তো। অথবা অনেকেই খোঁজ রাখেন এবং অবশ্যই তাঁদের সাধুবাদ জানান।
আয়োজনের নেপথ্যে মানুষদের ভূমিকা
আয়োজনের নেপথ্যে দলের কর্মীদের কথা সবার আগে বলা খুব জরুরী। দলের প্রতিটি কর্মী অসম্ভব দক্ষতার সাথে অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছেন এবং খুঁটি নাটি সমস্ত বিষয়কে হাসিমুখে রক্ষা করেছেন। আমার বিশ্বাস কোনো নাট্যদলই বলতে পারবেন না যে তাঁরা মিউনাস কর্মীদের থেকে সাহায্য পাননি।
২৫টি দলকে নির্ধারিত সমস্ত সেট, আলো, সময়মতো গ্রিনরুম ছেড়ে দেয়া, জনে জনে অংশগ্রহণকারী দলের সদস্যদের ডেকে ডেকে চায়ের কুপন ইত্যাদি পেয়েছেন কি না তা স্মরণ করিয়ে দেওয়া, এমনকি অংশগ্রহকারী দল যখন অডিটোরিয়ামে নাটক দেখছেন তখন তাঁদেরকে ডেকে নিয়ে গ্রিনরুম দেয়া সবই ঘটিয়েছেন মিউনাস পরিবারের সকল সদস্যই মিলেমিশে।
নাট্যকর্মীদের পাশাপাশি নেপথ্যে কর্মীদের প্রতিও ছিল তাঁদের সমান সমাদর আর খেয়াল। বাইরে থেকে বোঝাই যাবে এই মহাযজ্ঞের কাজ কত শ্রমের মধ্যে দিয়ে ঘটেছে। মনে হবে যেন কত সহজ এক কাজ। পঁচিশটি দলের সেট যা দলগুলির থেকে আগেই নিয়ে নেয়া হয়েছিল, সেগুলিকে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল টেকনিক্যাল ব্যক্তিদেরকে। এবার এই উৎসবের থিম ছিল মহিলা পরিচালক নাট্য দর্শন। অর্থাৎ ২৫ জন মহিলা পরিচালকের নাটক ছিল এই উৎসবে।
এই কাজটিকে সম্পন্ন করার জন্য মাচার মানুষ নাট্যদলের কর্ণধার সুচরিতা বরুয়া চট্টোপাধ্যায়কে পাশে পেয়েছে মিউনাস। তিনি নাত্যদলগুলির বাছাই পর্বের কাজ দারুণ দক্ষতার সাথে সম্পন্ন করেছেন বলেই ঘোষণা করেন মিউনাসের প্রাণপুরুষ উৎসব দাস। এই মানুষটার কথা আমি দ্বিতীয় পর্যায়ে বলব।
এছাড়াও অন্যান্য নাট্যদলের অনেকেই এইকাজে স্বতস্ফুর্ত ভাবে এগিয়ে এসেছেন। এরপর যাদের কথা না বললে সমস্ত বিষয় অধরা থেকে যায়। এক আলোক শিল্পী বাবলু সরকার, আর দুই মঞ্চ কারিগর অজিত রায়। মঞ্চ উপকরণ সঠিক সময়ে একটি নাটক শেষ হবারা সাথে সাথে পরের নাটকের সেট অত্যন্ত দ্রুততার সাথে রেডি করে দেওয়া।
মঞ্চে অভিনেতা অভিনয় করেন, তাদের অভিনয় ভালো হলে দর্শক অভিনেতাকে বাহবা দেন, কিন্তু এনাদের ঘাম এবং কর্মক্ষমতা না থাকলে সব বৃথা হয়ে যেত। অজিত রায় তাঁর টীম নিয়ে অসাধারণ দক্ষতার সাথে কাজ করে গেছেন। আর আলোকশিল্পী বাবলু সরকার ও তাঁর টীম সারারাত ধরে যেভাবে একের পর নাটকে আলো দিয়ে গেছেন যা সেদিন যারা উপস্থিত ছিলেন তাঁরা জানেন।
পঁচিশটি নাটকের অধিকাংশই তাঁদের অজানা, কিন্তু তা সত্বেও তাঁরা নিজের কারিগরি দক্ষতা দিয়ে কাজ করেছেন এবং দলগুলিকে খুশী করেছেন বলেই মনে হয়। এর মধ্যে বেস কিছু দল অবশ্য তাঁদের নিজস্ব আলোক শিল্পীদের দিয়ে কাজ করিয়েছেন, কিন্তু সেক্ষেত্রেও তাদের সাথে সম্পূর্ন সহযোগিতা করেই কাজটিকে তাঁরা সম্পন্ন করেছেন।
এই ভাবনার মাস্টার প্ল্যানারকে নিয়ে কিছু কথা
এই গোটা মহাযজ্ঞের মাস্টার প্ল্যানার হলেন উৎসব দাস। সেই ২০০৭ সাল থেকে যিনি ভয়ানক আর্থিক দায়ভার মাথায় নিয়ে এই কাজ করে আসছেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি অসুস্থ হয়েও সেইদিন সেই মঞ্চে প্রায় ৩৬ ঘণ্টা তপন থিয়েটারকেই ঘরবাড়ি করে নিয়েছিলেন। সেখানেই তাঁর নিয়মিত ওষুধের ব্যবস্থা, আর ক্ষণে ক্ষণে মুহুর্তের ছবি ধরে রাখা, মাঝে মাঝে সঞ্চালনা, পুরো টীমকে নিপুণভাবে পরিচালনা করা ইত্যাদির মধ্যে ডুবে থেকেছেন। সদাহাস্য ও প্রাণময় থেকে তিনি কাজ করে গেছেন।
মাঝে মধ্যে উষ্ণতা পাবার আশায় পাশে গিয়ে দেখেছি কি অসম্ভব স্পিরিট মানুষটার মধ্যে। যা সঞ্চারিত করেছেন তাঁর দলের কর্মীদের, ব্যাক স্টেজ আর্টস্টদের, এবং অবশ্যই অংশগ্রহণকারী কিছু দল ও কর্মীদের। তাঁর এই টানা ২৪ ঘণ্টা থিয়েটার জেগে থাকার মধ্য দিয়ে তিনি যা করতে চেয়েছেন তা হল থিয়েটারের মহামিলন ও দক্ষতা নির্মাণ। নাট্যকর্মীদের কাছে এই বার্তা গেল কি না তা আমার জানা নেই।
তবে তিনি সেটাই চেয়েছিলেন অন্তর থেকে এটাই মনে হয়। আর এই সূত্র ধরেই তার মাঝে মাঝে দীর্ঘ শ্বাস পড়তে দেখেছি। না সেটা হয়তো কোনো আক্ষেপ থেকে নয়, কিন্তু অবশ্যই কষ্ট থেকে। আমি জানি না আমি ঠিক কি না, তবে আমিও কিছু বিষয়ে বেশ কষ্টই পেয়েছি। সামগ্রিক থিয়েটারের নাট্যকর্মীদের অদ্ভুত উন্নাসিকতা আর দম্ভের চরিত্রির দেখে।
শেষে অনুষ্ঠানে দেখা কিছু অপ্রিয় ঘটনা
সাধারণ মানুষ আর নাট্যকর্মীদের আমি একই ব্রাকেটে রাখতে রাজী নই। আমি নাট্যকর্মীদের ‘এক্সাট্রা অর্ডিনারি’ মনে করি। কারণ তাঁরা শুধু দেখেন(see) না, খুঁটিয়ে দেখেন (observe)। তাই তাঁদের থেকে প্রতাশা অনেক বেশী। একজন দর্শকের পক্ষে ২৫ টি নাটক দেখা কতটা বিজ্ঞান সম্মত বা সম্ভব তা আমার জানা নেই। তবে আমি যতক্ষন উপস্থিত থাকবো ততক্ষণ নাটক দেখবো এটাই তো স্বাভাবিক।
কিন্তু না। আমাদের নাট্য চর্চায় একটা বিষয় ভীষণভাবে লক্ষ্য করি যে কোন উৎসবে অংশগ্রহণকারী দল সুযোগ থাকলে অন্যান্য দলের নাটক দেখেন না। এর যথার্থ কারণ কি আমি জানি না তবে যেটা বুঝতে পারি, বা বুঝতে চেষ্টা করি, তা হলে— আমরা নিজের নাটকে বেশী ভালো মনে করি, অন্যেরা যা করেন তা ঠিক তাঁদের মতো ভালো নয়। এটা হয়তো তাঁরা জোর গলায় বলেন না কিন্তু আকারে ইঙ্গিতে সেরকমই বোঝানোর চেষ্টা করেন। শহর ও শহরতলী বা জেলার বিভিন্ন অংশ থেকে নাট্যদলগুলি এসেছেন, তার অনেকেই দীর্ঘ সময় অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকেছেন।
কিন্তু নাটক দেখেছেন কেউ কেউ। একটা উৎসব যেখানে একসাথে অনেকের কাজ দেখার সুযোগ সেটা আমি হারাবো, এটা আমি ভাবতেই পারি না। নাট্যাভিনয় চলাকালীন ভেতর আর বাইরের চেহারা প্রায় সমান সমান ছিল। অথচ বাইরেটা শূণ্য থাকার কথা ছিল। এটি নাট্যের একরকম গেট টুগেদার নিশ্চয়ই কিন্তু সেটা নাটক দেখার মধ্য দিয়ে করলে ভালো হয় বলেই মনে হয়। আমার কাছে অনেকেই তাঁদের নাটক কেমন হয়েছে জানতে চেয়েছেন, আমি তাঁদের লক্ষ্য করেছি, তাঁরা অন্য নাটক দেখেননি, বরং সেই সময় বাইরে দাঁড়িয়ে ‘পি আর’ করেছেন।
এখন প্রশ্ন আমি নিজে নাটকগুলি দেখে কি খুব আনন্দ পাচ্ছিলাম? না সব নাটক দেখে আনন্দ পাচ্ছিলাম না, কিন্তু নাট্যকর্মের ঢং ঢাং আচ করছিলাম। অনেকসময় কান্না পেয়েছে, মঞ্চের ব্যকরণ সম্পর্কে শিক্ষা না নিয়ে কাজ করা বা উদ্দেশ্যহীন স্ক্রিপ্টের দাপাদাপি, উচ্চস্বরের অভিনয়ের প্রতি ঝোঁক, দগদগে বাজারি সেন্টিমেন্টের সাজানো ঘটনা ইত্যাদি সবই সয়েছি আর আমাদের অবস্থান সম্পর্কে অবগত হয়েছি। কিন্তু তাতেও আমার ততটা খারাপ লাগেনি যতটা খারাপ লেগেছে, নাট্যকর্মীদের, ভেতরে এসে নাটক না দেখে বাইরে ঘোরাফেরা করতে দেখে। এরই মাঝে সবটাই যে খারাপ তা কিন্তু নয়, এমনও দেখেছি দর্শকাসন আকড়ে থেকেছেন, মাঝে মাঝে বাইরে বেরিয়েও আবার নাটক দেখতে ভেতরের প্রবেশ করেছেন।
এই দেখাটার সাথে অনেকেই একমত হবেন না জানি, তবে এই অভ্যাস আমাদের নাট্যচর্চায় ভীষণ ক্ষত তৈরী করছে, এটা নিশ্চিত জেনে রাখুন। নাটক করাটা যেমন জরুরি, তেমনি সুযোগ পেলে নাটকটা চোখছাড়া করাটা অনুচিত। সকল অভিনেতারাই দর্শককে ভগবান ভাবেন, সেটা তাঁরা প্রকাশও করেন।
কিন্তু তাঁরাই অন্যের নাটক দেখেন না। আমার দলের নাটক আছে আমরা নাটক করে চলে যাবো, হ্যা মানছি বহুদূর থেকে তাঁরা আসবেন, তাদের বাড়ি ফিরে যাবার তাড়া থাকতে পারে, আমার এখানেই প্রশ্ন আমরা আমাদের এই উৎসবে অংশদানের ডিজাইনটা এরকম কেন করেছি? যেখানে অপর দলগুলির নাটক দেখবো না? আসলে প্ল্যানেই থাকে না। অভ্যাসেই গলদ মনে হয়। কিন্তু আমি যতদূর জানি এই উৎসবের উৎসব দা সকলের উদ্দেশ্যে এরকম কোনও নিদান দেননি যে যারা নাটক করবেন তাদের সকলকে দর্শকাসনে বসে থাকতে হবে নচেৎ এই উৎসবে সামিল হওয়া যাবে না। একেবারে খোলামেলা পরিসর এই নাট্য আয়োজন ভালোলাগার আর একটি দিক। প্রায় সকলেই নিজের ভেবে কাজ করছেন, বা কাজ কাঁধে নিয়ে নিচ্ছেন দেখেছি। কিন্তু নাটক দেখছেন খুব কম জনেই।
এই উৎসবের ভাবনাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে মিউনাসের সাথে আরও নাট্যদলের সহযোগ কাম্য। কারণ নাট্যকার নির্দেশক বিভাস চক্রবর্তীর মতো সেইদিন উৎসব মঞ্চে নাট্য গবেষক কমল সাহাও একই কথা বলেছেন, এই আয়োজন বিশ্বে আর কোথাও হয় কি না তাঁর জানা নেই।
অর্থাৎ এই উৎসবকে রক্ষা করার দায় আমাদের সমস্ত নাট্যকর্মীদেরই, শুধুমাত্র একটু সুযোগ পাওয়াই যথেষ্ট নয়, এবং সুযোগ পেয়ে কৃতজ্ঞ থাকাই মহত্ব নয়, রাত্রি জাগরণের মাধ্যমে জড়িয়ে থাকার মধ্য দিয়ে নিজেকে জড়িয়ে নিলে আমার মনে হয় উৎসবদা অনেক বেশী খুশী হবেন। আমি আবারও বলছি আমি পুরো চব্বিশ ঘন্টা থাকিনি, থাকতে পারিনি।
কিন্তু যতক্ষণ ছিলাম, আমার কাজের বাইরে প্রেক্ষাগৃহের ভেতরেই থেকেছি। এরকম অনেকেই করেছেন, আবার অনেকেই করেননি, বা করেন না সেই চিরায়ত অভ্যাস, নাক উঁচু ভাব, ‘এরা কারা’? ‘কেমন নাটক করে রে?’ ‘ইস কি জঘন্য নাটক!’ ‘উফ ওই নাটকটা ফেটে গেছে।‘ এইসব কথা চালাচালির মধ্যে এক ধরণের আত্মকেন্দ্রিকতা থাকে। থাকে দম্ভ। এই কথাগুলি আমরা কমবেশী সকলেই জানি, কিন্তু চেপে থাকি, কেন থাকি তা হয়তো নিজেও জানি না, এটাই অভ্যাস হয়ে গেছে।
যে সুযোগ উৎসব বাবু ও তাঁর দল আমাদের কাছে করে দিয়েছেন, সেখানে আমাদের কর্তব্য কি শুধুমাত্র অভিনয় করতে এসে উদ্ধার করে দেয়া, আর শুকনো মুখে কৃতজ্ঞতার ডালি তাঁদের দিয়ে যাওয়া নাকি, যোগদানকারী দলগুলির নাটকগুলির সাথে পরিচিত হওয়া। আমি পরিচিত হয়েছি। আমি বুঝতে পেরেছি বা বুঝে নিয়েছি আমি ঠিক কোথায় আছি। এই উৎসবে এমন নাটক হয়েছে যা এক্সপেরিমেন্টের অসাধারণ ফসল, আবার এমন নাটকও দেখেছি যা শুধু হতাশাই আনে না, যে এই ধরণের প্রয়োগ কৌশল এখনও বাঁচিয়ে রাখা হয় এটা ভেবে। দুটো থেকেই আমি শিখি। তাই দেখাটাকে একমাত্র কর্তব্য মনে করি।
এই প্রতিবেদনের মধ্য দিয়ে আমি আগামীদিনের যোগদানকারী দলগুলির কাছে আবেদন রাখতে চাই, আপনারা যারা এই মঞ্চে আগামীদিনে সুযোগ পাবেন তাঁরা অবশ্যই আপনাদের শিডিউলে নাটক করার সাথে সাথে নাটক দেখাটাকেও রাখবেন। নচেৎ কোনও উৎসবেই যাবেন না।
তবে এখানে কিছু ক্ষেত্রে ছাড় রাখতেই হবে, ধরা যাক একটি দলের সেই দিনই আর একটি অভিনয় পড়ে গেছে, তাহলে তার ক্ষেত্রে বিষয়টি অবশ্যই আলাদা হবে। কিন্তু যারা মুক্ত তাঁরা নাটক হয়ে গেলে দর্শকাসনে থাকুন। নাটকের ঠিক বেঠিক নিয়ে তর্কের ঝড় তুলুন।
আর একটি কথা না বললেই নয়, এই উৎসবে বেশ কিছুদল আছেন, যারা এই বর্ষে যোগাদান করেননি, তাঁরা কিন্তু এসেছেন, থেকেছেন ও নাটক দেখেছেন। মিউনাসের পাশে থেকে নিঃশব্দে। টানা ২৪ ঘন্টা নাট্য জাগরণের ভাবনা নাট্য মহলে ঈর্ষনীয় একটি কাজ হয়ে উঠেছে।