নাটিকা – ‘ম্যাকবেথ বলছি’

- Advertisement -

অনুপ চক্রবর্তী

চরিত্রঃ ম্যাকবেথ         

ম্যাকবেথ।। না না আমি ভাববো না। কেন ভাববো? ডাইনিরাতো বলেছিল যতদিন না বারনাম জঙ্গল এই ডানসিনান পাহাড়ে উঠে আসছে ততদিন কেউ আমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। আর এটা কে না জানে জঙ্গল কখনো মানুষের মত টলতে টলতে হেঁটে পাহাড়ে উঠে আসে না। তাহলে আর কি! ম্যাকডাফ সৈন্য নিয়ে বসে থাকো থাকুক এই ডানসিনান পাহাড়ের নীচে। আমি ম্যাকবেথ আমি থাকবো অক্ষত। কেননা ডাইনিদের ভবিষ্যৎবাণীতো মিথ্যে হবার নয়। ওরাই তো বলেছিল আমি হব রাজা এবং আমি তো তাই হয়েছি। ওরাই বলেছিল কোন নারীর জরায়ু থেকে স্বাভাবিকভাবে যোনিপথে যার জন্ম হবে সে আমাকে হত্যা করতে পারবে না। সুতরাং আমাকে কেউ হত্যা করতে পারবে না। আমার যখন মৃত্যু হবে, তা হবে স্বাভাবিকভাবে। কোন হত্যাকারীর অস্ত্রে নয়। তাহলে কিসের ভাবনা? ডাইনিদের ভবিষ্যৎবাণী যখন ব্যর্থ হতে পারে না। হ্যাঁ। ওদের ভবিষ্যৎবাণী অক্ষরে অক্ষরে মিলে গিয়ে আমি প্রথমে হলাম কডরের থেন। তারপর স্কটল্যাণ্ডের রাজা। কিন্তু কিভাবে হলাম আমি রাজা? সেই পথতো বীরত্বের পথ নয়। ম্যাকবেথ বীরের মতো যুদ্ধ করে মৃত্যুবরণ করতে পারে। কিন্তু হীন কাপুরুষ বিশ্বাসঘাতকের মতো নিরস্ত্র অতিথিকে ঘুমের মধ্যে হত্যা করাতো ম্যাকবেথের শোভা পায় না। কিন্তু আমি প্রলুব্ধ আর প্ররোচিত হয়ে তাইতো করেছিলাম। তাইতো এক গভীর অপরাধবোধে দীর্ণ হয়ে যায় আমার হৃদয়।

(চিৎকার করে ওঠে) ওঃ আমি – আমিতো তাই করেছিলাম!

(চিৎকার করে ওঠে) আঃ আমি বীর ম্যাকবেথ কাপুরুষের মতো একজন নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করলাম যে ছিল আমার অতিথি। সেই আমার রাজা ডানকান। তাঁকে তার ঘুমের মধ্যে কাপুরুষের মত হত্যা করলাম। যুদ্ধে জেতার পরেই যিনি পরম স্নেহে আমাকে কডরের থেন করে দিয়েছিলেন। সদা হাস্যময় সেই সরল রাজাকে হত্যা করলাম আমি সিংহাসনের জন্যে।

(চিৎকার করে ওঠে) আঃ আঃ আমার এই হাত অতিথির রক্তে রাঙিয়ে দিলাম। কিন্তু কেন করলাম এই কাপুরুষের মত কাজ? এই হীন ঘৃণ্য কাজ? আমি তো এরকম নীচ,হীন মানুষ ছিলাম না। ওই সর্বনেশে ডাইনি গুলোর প্রলুব্ধ করা ভবিষ্যৎবাণী আমার মধ্যে কী ভয়ানক উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর লোভের বীজ বুনে দিল। আর ওই ভবিষ্যৎ বাণী আমার রানীকে বলতে – লেডিকে বলতে – ওঃ  লেডি ম্যাকবেথ!

(চিৎকার করে ওঠে) ওঃ কী ভয়ংকর নারকীয় তোমার উচ্চাকাঙ্ক্ষা! আমার চেয়েও তা শতগুণ ভয়ংকর! আচ্ছা!  ডাইনিরাতো ভবিষ্যৎ বাণী করলো রাজা হব আমি। কিন্তু লেডি ম্যাকবেথের কেন হল ওরকম বীভৎস উচ্চাকাঙ্ক্ষা? রাণী হওয়ার জন্যে? লেডি ম্যাকবেথ! তুমি আমাকে প্ররোচিত করলে ভয়ানকভাবে – আমাকে প্রবলভাবে উত্তেজিত করলে – ভয়ঙ্করভাবে – আমার দ্বিধা দ্বন্দ্ব কে চুরমার করে দিলে – আমার পৌরুষে আঘাত দিয়ে – নিজের নারীত্বকে পর্যন্ত হেয় করে – এভাবে আমাকে উত্তেজিত করে কেন রাজাকে হত্যা করালে তুমি – এমনই ভয়ঙ্কর তীব্র কামনা তোমার যে বললে প্রয়োজনে লক্ষ্যপূরণে তোমার স্তনের বোঁটা থেকে সন্তানের ঠোঁটকে জোর করে ছাড়িয়ে নিয়ে তার মাথাটা মাটিতে আছড়ে চূর্ণ করে দিতে পারো – কী দারুন পৈশাচিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা তোমার! আর আমি ম্যাকবেথ তোমার প্ররোচনায়   বশীভূত হয়ে – (চিৎকার করে ওঠে) ওঃ ঘুমের মধ্যে হত্যা করলাম আমার প্রিয় রাজা ডানকানকে! কিন্তু কী আশ্চর্য! লেডি ম্যাকবেথ নিজে হত্যা করতে পারল না রাজাকে! ঘুমন্ত রাজার মুখেতে নাকি ও দেখেছিল নিজের পিতার ছায়া! তাই কাঁপতে কাঁপতে ফিরে এসেছিল! মানে ওর মনের গভীর গোপন অন্দরে রয়ে গেছে সেই একরাশ কোমল অনুভূতি – সেই চিরন্তন ভালবাসা, মায়া, মমতা ও করুণা – কী অদ্ভুত মানুষ তুমি লেডি –

(চিৎকার করে ওঠে) কিন্তু লেডি ম্যাকবেথ! তুমি তাহলে কেন এভাবে আমার হৃদয়ের মধ্যে সযত্নে লালিত সুকুমার ফুলগুলো – আমার মায়া, মমতা,করুণা আর ভালোবাসার ফুলগুলো  পা দিয়ে দলে পিষে নষ্ট করে দিলে? কেন রাজাকে নিজে হত্যা করতে ব্যর্থ হয়ে হত্যা করলে আমার সুকুমার হৃদযকে? এ কী গভীর অপরাধ করলে তুমি লেডি ম্যাকবেথ! আর তোমার এই গভীর অপরাধবোধে তুমি এখন অবিরাম তোমার দু হাত ঘষে ঘষে রক্তের দাগ তোলার চেষ্টা করছো – যে রক্তের দাগ তোমার হাতেতে  লাগেনি – লেগেছে তোমার হৃদয়ে – তাই যতই  তুমি ঘষতে থাকো তোমার দুহাত ,লেডি ম্যাকবেথ ,তুমি তো পারবে না তোমার বিশ্বাসহন্তা চেতনার গভীর প্রদেশ থেকে ওই রক্তের দাগ তুলে ফেলতে। তাই আজ ঘুমের মধ্যে হাঁটছ তুমি – তাই কোন ওষুধে তুমি শান্ত হতে পারছ না –  রাজা বানালে তোমার ম্যাকবেথকে –  কিন্তু নিজে কী হলে লেডি ম্যাকবেথ – হলে সম্পূর্ণ উন্মাদ –  আর আমাকেও তাই করে দিলে তুমি,লেডি –  নিরস্ত্র অতিথি রাজাকে হত্যা করে তাই যেন  আমি শুনছিলাম  -কে যেন বলছে – জাগো পুরবাসী জাগো – আর ঘুমিও না – দেখো দেখো কিভাবে তোমাদের নিরস্ত্র  রাজা কে হত্যা করা হল – দেখো কিভাবে হীন কাপুরুষের মতো তাঁকে হত্যা করা হল –  কে সে? সে কি আমার বিবেক? আমার দ্বিতীয় সত্তা?

কিন্তু শুধুতো রাজাকে নয় – নিজেকে সন্দেহমুক্ত রাখতে আমি হত্যা করলাম নিরপরাধ প্রহরীদের – আর তারপর ব্যাংকোকে – তারপর ম্যাকডাফের স্ত্রী,পুত্রদের –  হত্যার পর হত্যা –  তার পরেও হত্যা –  শুধু হত্যার মিছিল – এভাবে হত্যালীলার সিঁড়ি বেয়ে উঠে রাজা হতে চেয়েছিল কি  ম্যাকবেথ ? তাহলে কেন এভাবে আমাকে ক্লেদাক্ত করে দিলে – অপরাধের পথে ঠেলে দিয়ে – ঐ – ঐ – ঐতো আবার দেখছি ছিন্ন শির ব্যাংকোর – ব্যাংকো! ব্যাংকো! তোমার ছিন্ন শির দিয়ে যে রক্ত ঝরে চলেছে তা গ্লানির অন্ধকারে ডুবিয়ে দিচ্ছে আমাকে –  যাও – যাও – যাও তুমি –  আমাকে আর অপরাধবোধে দীর্ণ কোরো না –  এই ভয়ানক নির্জন, নিস্তব্ধতায় –  এই স্তব্ধ দ্বিপ্রহরে – তোমার রক্ত ঝরা ছিন্ন শির আমাকে উন্মাদ করে দিচ্ছে – যাও যাও তুমি –  হ্যাঁ আমি তোমাকে হত্যা করিয়েছি গুপ্তঘাতক দিয়ে –  তোমার বন্ধু হয়েও – কেননা তা না হলে আমার সিংহাসন তো নিষ্কণ্টক হবে না, ব্যাংকো –  এটাই তো রাজনীতি – ক্ষমতার রাজনীতি –  এই ক্ষমতার রাজনীতির একমাত্র লক্ষ্য হোলতো ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করা –  তা সে যে কোন পথেই হোক না কেন – যতই আবিল আর পঙ্কিল হোক সেই পথ –  সেই আরোহণের পথে যেকোন বাধাকে নির্মম ভাবে চূর্ণ করার জন্যে প্রয়োজনে বন্ধুকে হত্যা করতে দ্বিধা না করাই রাজনীতির লজ্জাহীন ধর্ম  – যেমন রণে আর প্রেমে কোন কাজেই অন্যায় নয়  – তেমনি ক্ষমতার রাজনীতির লড়াইয়ে কোন কিছুই অপরাধ নয়  – শুধু লক্ষ্য হলো চূড়ান্ত ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছে যাওয়া –  এটাই তো স্বাভাবিক, ব্যাংকো –  যেখানে মূল্য নেই কোন মায়া মমতা প্রেম বা ভালোবাসার – কৃতজ্ঞতা যেখানে অর্থহীন শব্দ – বিশ্বাসহনন যেখানে স্বাভাবিক ক্রিয়া – সেই ক্ষমতার রাজনীতির পথ যতই পঙ্কিল ও পূতিগন্ধময় হোক –  যতই বিশ্বাসঘাতকতার  নিকষ কালো রক্তে রাঙা হোক – 

কিন্তু ম্যাকবেথ যে বীর হৃদয় – সেতো সত্যিই হীনচরিত্র নয় – তাই গভীর অপরাধবোধ তাকে কুরে কুরে খায় – তার বিবেকের অলিন্দে ঘন্টা বাজায় – 

কী?  কী বলল প্রহরী? লেডি ম্যাকবেথ আত্মঘাতী হয়েছে! লেডি ম্যাকবেথ আর নেই? তাহলে কি নাটক সমাপ্তির দিকে এগোচ্ছে? লেডি ম্যাকবেথ মৃত? তাহলে তার সমস্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষার এভাবেই অবসান হল!  হায় লেডি ম্যাকবেথ! কেন জীবনের মনোরম উদ্যানকে উচ্চাকাঙ্খার বিষলতায় ভরিয়ে দিয়ে এভাবে বিদায় নিলে এই সুন্দর পৃথিবী থেকে! জীবন তো শুধু উচ্চাকাঙ্ক্ষা নয়, লেডি ম্যাকবেথ! জীবনতো অনেক মহৎ, অনেক বিশাল, অনেক সুন্দর! কেন জীবনের মৌল ভাবনাগুলো তুচ্ছ করে ভ্রান্ত পথে গিয়ে অকালে অপসৃত হলে জীবনের রঙ্গমঞ্চ থেকে! ভালোবাসতাম তোমাকে রাণি – এখনো তো ভালোবাসি তোমাকে – কেন এভাবে আমার হৃদয় কে শূন্য করে চলে গেলে, লেডি ম্যাকবেথ!

এ কী! এ কী! বারনাম জঙ্গল সত্যি ডানসিনান পাহাড়ে উঠে আসছে! হ্যাঁ। আসছে। অসম্ভব অলৌকিক অবাস্তব ব্যাপার! আমি কি ভুল দেখছি! আমি কি স্বপ্ন দেখছি! আমি কি দিবা স্বপ্ন দেখছি! কিন্তু না। আমি তো স্পষ্টই দেখছি! ঐতো বারনাম জঙ্গল ডানসিনান পাহাড়ের ওপর উঠে আসছে! কীভাবে? কীভাবে? ও বুঝেছি। ম্যাকডাফের সৈন্যরা গাছের ডাল কেটে হাতে নিয়ে নিজেদের আড়াল করে পাহাড়ে উঠে আসছে। ওঃ একী প্রতারণা করল আমাকে ডাইনিরা! তাহলে কি আমার শেষের ঘন্টা বাজছে? তাহলে কি আমার মৃত্যু আসন্ন? মৃত্যু আসন্ন কি ম্যাকবেথের? একটা একটা করে মানুষের আগামী দিনগুলো ফুরিয়ে যেতে থাকে – এক পা এক পা করে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সে এগিয়ে চলে কবরের দিকে – তার শেষের দিনের দিকে – তার নির্দিষ্ট আয়ুর কোন হ্রাসবৃদ্ধি হয় না – এটাই চিরন্তন সত্য –    খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সে চলে অনিবার্য মৃত্যুর দিকে – সমস্ত বিগত দিন বিমূঢ় মানুষকে দেখায় আলোকিত ধূলিময় মৃত্যুর পথ – তাহলে কী মূল্য এই প্রবঞ্চক জীবনের?  বরং নিভে যাক জীবনের তুচ্ছ ক্ষণিক প্রদীপ – জীবন যেন এক চলমান ছায়ামাত্র – জীবন যেন এক দরিদ্র অভিনেতা – রঙ্গমঞ্চে আস্ফালনের শেষে যবনিকাপাতের পর যাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না – জীবন যেন এক নির্বোধের বলে যাওয়া মুখর গল্প – শেষ বিচারে যা অর্থহীন –

ঐ যে!  উন্মুক্ত তরোয়াল হাতে উঠে আসছে ম্যাকডাফ আমাকে হত্যা করতে

(চিৎকার করে) ম্যাকডাফ! ম্যাকডাফ! আমাকে তুমি হত্যা করতে পারবে না – কেননা কোন নারীর জরায়ু থেকে যোনিপথ দিয়ে স্বাভাবিক ভাবে জন্ম নেওয়া কোন মানুষ আমাকে হত্যা করতে পারবে না – এটাই আমার ভবিতব্য – তাহলে কিভাবে তুমি আমাকে হত্যা করবে?  ব্যর্থ হবে তুমি। কী বলছ? তোমার জন্ম স্বাভাবিকভাবে হয়নি? তোমাকে তোমার মায়ের উদর ব্যবচ্ছেদ করে বার করে আনা হয়েছে? ওঃ আবার আমি ডাইনিদের প্রতারণার শিকার হলাম! তাহলে কি এবার সত্যিই মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হতে হবে আমাকে?  ঠিক আছে। আমি প্রস্তুত। কিন্তু আত্মসমর্পণ করবো না আমি। মৃত্যুর আগের মুহূর্ত পর্যন্ত – আমার শির ছিন্ন করার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত  – আমি লড়াই করে যাব – কারণ আমি ম্যাকবেথ-  আমি ভুল করতে পারি- অপরাধ করতে পারি প্রলুব্ধ হয়ে, বিভ্রান্ত হয়ে,  প্ররোচিত হয়ে- ভুল পথে সাময়িক ভাবে হাঁটতে পারি – কিন্তু আমি ম্যাকবেথ বলছি-  আমি সত্যই হীনচরিত্র, কাপুরুষ নয় – আমি তুচ্ছ করি মৃত্যুকে – তুচ্ছ করি মৃত্যুভয়কে – ম্যাকবেথ যেমন জীবন নিতে পারে, তেমনি সে জীবন দিতেও পারে – চলে এসো ম্যাকডাফ- আমি প্রস্তুত- শেষ যুদ্ধের জন্যে আমি প্রস্তুত – আমি প্রস্তুত – আমি প্রস্তুত– আমি প্রস্তুত –

(সমাপ্ত)

- Advertisement -
সাম্প্রতিক পোস্ট
এধরনের আরও পোস্ট
- Advertisement -