নিজস্ব প্রতিনিধি, নয়াদিল্লি
দু’দিন আগেই ‘একেন বাবু’ খ্যাত অভিনেতা অনির্বাণ চক্রবর্তী ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। নাটকের মাঝে বারবার দর্শকদের ফোন বেজে ওঠা নিয়ে সরব হয়েছিলেন। অভিযোগ করেছিলেন, একাংশ বাঙালি দর্শক নাটককে সম্মানটুকু দিতে জানে না। কিন্তু সেই ঘটনার দু’দিন পরেই ভারত রঙ্গ মহোৎসবে একটি বাঙালি নাট্যদলের সদস্যরা তাঁদের বাংলা নাটক দিয়ে সেই বাঙালি দর্শকদেরই মাত করে দিলেন। তবে এই বাঙালিরা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি নন। এঁরা হলেন দিল্লির প্রবাসী বাঙালি।
রাজধানীর দিল্লির পাশাপাশি ভারতের মোট ১১টি শহরে ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা (এনএসডি) আয়োজিত ভারত রঙ্গ মহোৎসব-২০২৪ শুরু হয়েছে। ১ তারিখ থেকে শুরু হওয়া এই নাট্য উৎসব চলবে আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এই মহোৎসবেই আমন্ত্রণ পেয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার অশোকনগরের নাট্যসংস্থা ‘অভিযাত্রী’। মঙ্গলবার সন্ধ্যার সময় দিল্লির শ্রীরাম সেন্টার ফর আর্ট অ্যান্ড কালচারে ছিল তাদের নাটক ‘রক্তকরবী’র মঞ্চায়ন। আর তাতেই দিল্লির বাঙালিদের অভূতপূর্ব সাড়া পেলেন অভিযাত্রী নাট্যসংস্থার সদস্য-সদস্যারা।
এনিয়ে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে অশোকনগর অভিযাত্রী নাট্যদলের কর্ণধার কৌশিক সরখেল ‘বাংলা নাটক ডট ইন’কে বলেন, ‘ভারত রঙ্গ মহোৎসবের মতো নাট্য উৎসবের মঞ্চ! প্রথম দিকে কেমন যেন একটা মনের মধ্যে সন্দেহ কাজ করছিল। সবকিছু ঠিক ঠাক হবে তো? এমনিতেই আমাদের রক্তকরবীর সেট – একটা বিশাল সেট। সেই সেট আদৌ এই দিল্লিতে ঠিক ঠাক হবে তো? কিন্তু যখন আমরা মঞ্চ দেখলাম, যেভাবে এনএসডি আমাদের সেটা তৈরি করে দিল – তাতে মনে হল এটাই প্রফেশনালিজম। রিয়েলি হ্যাটস টু দেম। এই সেট তৈরি করে দেওয়া একদিনের মধ্যে এবং এরকম নিখুঁতভাবে – রিয়েলি দে আর সাপোর্টিভ।’
তবে কৌশিক সরখেল কিংবা অশোকনগর অভিযাত্রী নাট্যদলের সদস্য-সদস্যাদের আশ্চর্য হওয়ার পালা এখানেই শেষ হয়ে যায়নি। দিল্লির শ্রীরাম সেন্টার ফর আর্ট অ্যান্ড কালচারে ‘রক্তকরবী’ মঞ্চস্থ হওয়ার সময় যে হাততালি তাঁরা পেলেন, যেভাবে নাটক শেষ হওয়ার পরে আধঘণ্টার ডিরেক্টর মিট প্রায় ১ঘণ্টা ছুঁয়ে ফেলল এবং সময়ের অভাবে কার্যত বাধ্য হয়ে দর্শকদের হল্ থেকে বাইরে বের করাতে হল – এসবের সঙ্গে একেন বাবুর বাঙালি দর্শকদের প্রতি যে ক্ষোভ – তার কিন্তু কোন মিল খুঁজে পাওয়া গেল না। অশোকনগর অভিযাত্রীর ‘রক্তকরবী’ পশ্চিমবঙ্গেও প্রশংসা কুড়িয়েছে। কিন্তু দিল্লির বুকে বাঙালি-অবাঙালি মেশানো দর্শকদের মনে যেভাবে সাড়া ফেলল – তা নিয়ে আবেগে আপ্লুত ‘অভিযাত্রী’ নাট্যসংস্থার কর্ণধার কৌশিক সরখেল এবং দলের অন্য সদস্য-সদস্যরা।
তবে দিল্লির বুকে ‘রক্তকরবী’র এমন সাড়া পাওয়ার পিছনে আরও একটি বড় কারণ রয়েছে বলে মনে করেন অভিযাত্রী নাট্যসংস্থার কর্ণধার কৌশিক সরখেল। তাঁর মতে, চেনা গতের বাইরে বেরিয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’র রাজাকে সময়োপযোগী চরিত্র করে তোলা একটা চ্যালেঞ্জ ছিল বটে, কিন্তু দর্শক সেটাকে গ্রহণ করেছে। কৌশিক সরখেলের কথায়, ‘‘আমরা রবীন্দ্রনাথের একটা ডায়লগকেও পাল্টাই নি। কিন্তু অনেক আঙ্গিক, গান আজকের সময়ের মতো করে আমরা দেখিয়েছি। রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবীর রাজা জালের আড়ালে থাকেন। কিন্তু আমরা রাজাকে নাটকে সব সময় বাইরে রেখেছি। তিনি পরিস্কার দৃশ্যমাণ। এবং আমাদের কাছে জালটা হচ্ছে আসলে পুরো একটা আজকের দুনিয়ার ইন্টারনেট জাল। কয়েক’শ বছর পরেও যেভাবে আমরা রক্তকরবীর রূপককে আমরা নিজেদের আঙ্গিকে সাজিয়ে নিতে পারছি, এতেই একটি নাটকের ক্লাসিক্যাল ব্যাপারটা বোঝা যায়। খোদ শম্ভুমিত্র বলে গিয়েছিলেন, ‘এই রক্তকরবী হয়ত আবার কেউ অন্য ভাবে করবে। এটাই আমার চাওয়া’। সেটাই আমরা চেষ্টা করেছি।’’
তবে এনিয়ে একেবারেই যে সমালোচনার মুখে পড়তে হয় নি সেটা কিন্তু নয়। কিন্তু সেসব সমালোচনাকে মাথায় পেতে নিয়েই কৌশিক সরখেল বলেন, ‘‘রক্তকরবী নিয়ে কাজ করব অনেকদিনের ইচ্ছে ছিল। এনিয়ে নির্দেশক-সম্পাদক কৌশিক চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলতেই বুঝি, সেও রক্তকরবী নিয়ে কাজ করতে চায়। এরপর চিত্রনাট্য তৈরি করি। যাঁরা আমাদের রক্তকরবী নিয়ে সমালোচনা করেন, তাঁদের অশ্রদ্ধা করার করার প্রশ্নই ওঠে না। আমরা শুধু রক্তকরবী নিয়ে আমাদের পয়েন্ট অফ ভিউ রাখতে চেয়েছি। এটা অধিকাংশ মানুষেরই ভালো লেগেছে। এবং সবথেকে বড়কথা হচ্ছে আজকের ইয়ং জেনারেশন আমাদের রক্তকরবীকে সাদরে গ্রহণ করেছে।’’