দুলাল চক্রবর্ত্তী
শূন্যের মাঝারে নাটকটি বহরমপুর রবীন্দ্র সদনে রঙ্গাশ্রমের চতুর্দশ বার্ষিক নাট্য সমারোহে অভিনীত হয়েছে। বেলঘরিয়া রূপতাপস সংস্থার সাম্প্রতিক নির্মাণ। হাসন রাজার আউল বাউল শুদ্ধ স্বত্ত্ব তত্ত্বকে গানে মনে প্রাণে ধরতে চাওয়া হয়েছে। বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ সুরকার অভিজিৎ আচার্যের হৃদয়ের ছোঁয়াতে গড়ে উঠেছে নাটকের প্রেমময় শরীর। তাতে ছবি হয়ে মঞ্চ ক্রিয়ার অনুকূল ভূমিকা হয়েছে হীরণ মিত্রের মঞ্চ ভাবনা। সুদীপ সান্ন্যালের চিন্তিত আলো এসে রঙের বিবিধ সুগন্ধে নাটকের তরঙ্গে নদীর মতো অনাবিল আনন্দে বয়ে গেছে। সবগুলি চরিত্র আবিলতা মুক্ত আবিস্কৃত অনুভবে উজ্জ্বল ছিল। তাই ধর্ম ভেদাভেদের বিপক্ষে বিশ্ব প্রেমের বাণীতে একেবারে সময়ের প্রয়োজনীয় কথাই এই নাটক বলেছে। রঙ্গাশ্রমের উৎসবে মঞ্চস্থ অনেকগুলি অত্যন্ত সমৃদ্ধ নাটকের সম্ভারে এটি একটি আত্ম জাগরণের নাটক বলেই আমার ব্যক্তিগত অনুভব।
কেননা, হাসন রাজা নিজে এসে দাঁড়িয়ে নিজস্ব জীবন বোধ দিয়ে এক সৃষ্টির ইতিহাস বলেছেন। চারপাশের ভিন্ন মানুষের সুকোমল আচরণগুলিকেও বিতন্ডার বিরুদ্ধেই জমিদার হ’য়ে মিলনের দিকে নিয়ে গেছে। তাই, নাটকের প্রতিপাদ্য আজকের এই হানাহানির রাজনৈতিক সামাজিক বাতাবরণে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ দিয়েছে। উপস্থাপনার অপরূপ সার্বিক নির্মাণ উপস্থিত দর্শকদের মনে রেখাপাত করে গেছিল এক সুগন্ধি নাটকের আস্বাদে। হাসন রাজার শুদ্ধস্বরের মনুষ্যত্ব উঠে এসে ভেতর থেকে নাড়া দিয়ে আমাদের এই লোভী ক্ষমতা নির্ভর কব্জি জোরকেই যেন মূর্খ বলে উপহাস করে গেল। ব্যঙ্গ করে গেল ধনী হওয়া ইমারত আমানত ভিত্তিক অমানবিকতাকে। হত্যার বিরুদ্ধে, লুটের বিপক্ষে কিছুটা উদাসীন ভালবাসা তাই নাটকের ছত্রে বর্ণে গন্ধে শিউলি বকুল আকুলতা।
মানুষ যে সোনার মতো খাঁটি। মানুষের অন্তর শুদ্ধতা যে অহংকার মুক্ত এক শূন্যতার দিকে উড়ে চলায় নিজের চরম পরিণতি। মানুষের মুক্তি মানুষের ভিতরের আকাশ-বিহঙ্গ অস্তিত্বেই আছে। যা, অকৃত্রিম অনুরণনে এই পৃথিবীর, এই প্রকৃতির, চারিদিকের জড় জীবের মধ্যেই আবর্তিত প্রবহমান মাধুর্যকেই অবলম্বন করে লতিয়ে খতিয়ে আপন মহিমায় আগামীর জন্যে বয়ে চলে নদীর স্নিগ্ধতা বুকে নিয়ে। শূন্যের মাঝারে নাটকের ভাবাশ্রয়ী চলন তাই দেখিয়ে সবার বাসভূমিকে কালিমা মুক্ত করে, বাঁচাকে স্বীকার করে গেল। সবরকমের কালিমা ধুয়ে মুছে মানুষ কীভাবে দেবতার রূপকল্প। নাশ ত্রাসের বিরুদ্ধে মানুষের ধর্মাধর্ম বোধের বিপক্ষে মই করে মহাকাশ-জীবনকেই ভিত্তি করতে চেয়েছে।
তাই শূন্যের মাঝারে নাটক, বর্তমানের বিখ্যাত অনেক নাটকের মধ্যেই একেবারে আলাদা। কিন্তু ঝকঝকে উপস্থাপনায় নগর নাট্যের অন্তর্ভুক্ত লোকনাট্যের অন্য স্বরের স্বাদ। কারণ গানের এতো সমৃদ্ধ অনুপুঙ্খ বিন্যাস, সমন্বয়, ও সম্মিলিত পরিবেশন বাংলা নাটকে কমই হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা সব চরিত্রে অংশ নেওয়া পুরুষ মহিলা শিল্পী কুশীলবেরা কী চমৎকার গায়ক। ৩৮ বছরের নাটকের পথ চলায়, এমনটা কবে কোথায় পেয়েছি, মনে ভেবে খুঁজে বেড়াচ্ছি। তাই মনে হয় এ নাটকের অন্য কোন উপমা হয়তো হবে না। কারণ অখন্ড নির্মম অনুশীলননে এমন সৃষ্টির গর্ভধারণ সম্ভব হয়েছিল নিশ্চিতই। এ নাটক চমকে দেবে বাংলাদেশের নাট্য জগতকে। সুন্দর পূর্ব বঙ্গীয় ভাষার উচ্চারণ, ওপার বাংলার নাট্যচর্চাকেও এমন কাজে ঈর্ষান্বিত করতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, এই নাটকের সমবেতকণ্ঠ-গীতি, সবার অভিনীত চরিত্রেই আধারিত বুদ্ধ-যীশু-হজরত-রামকৃষ্ণ ফিলজফি মূর্তি হয়ে মঞ্চে এসেছে। এঁরাই তো পৃথিবীর কল্যাণ ত্রাতা।
উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায় অনেক ভাল নাটক লিখেছেন, দেখেছি যার কিছু মঞ্চায়ন। কিন্তু এটি তাঁর অন্যন্য রচনা। নাটকীয়তা নেই, কিন্তু আছে মিলিয়ে নেবার হৃদয় তলোয়ারের পরম আকুতি। জানি না, ডাইরেক্টরিয়াল স্ক্রিপ্টে কৌশিক ঘোষের নাট্য বোধের নিরিখে ভিন্ন উপস্থাপনা খনন কতটা হয়েছে। কিন্তু যাই হয়েছে, তা সুরে ছন্দে, তালে লয়ে হৃদয়ের কাছাকাছি যাবার অনুপম উপায় খুঁজে পাওয়া দর্শন অবশ্যই। সংঘাতের উচ্চতর উচ্চারণ ছাড়াই মনান্তরের, মতান্তরের বিচিত্রিতা চলনেই একটি সুকুমার বৃত্তিতে ভর দিয়ে, বৈপরীত্যের মিঠে আলাপেই আপাত চেনা, কিন্তু এই অচেনা জীবন কি করে যে আমার আমি হয়ে উঠতে পারে। মঞ্চের উপর তাই হয়ে উঠতে দেখলাম। শূন্যের মাঝারে নাটকের সবটুকুই এই মর্মে ব্যাক্ত পৃথিবীর জন্যে, যুদ্ধ নয় শান্তি চাই,..ভাই! এটুকুই সার্থকভাবে বলতে পেরেছে।
চমৎকার উপস্থিতিতে হাসন রাজার ভূমিকায় শ্যামাশিস পাহাড়ির এক টানা নাট্য ক্রিয়ার সঞ্চালন ভোলা যাবে না হয়তো। নিরহংকারী এই শিল্পীর হৃদয়ের হাসি খুব কাজে লেগেছে। যে কেউ অভিনয়ে এই তাল মেন্টেন করতে পারবেন কিনা সন্দেহ। বিন্দুমাত্র নাটুকে নয়, কথায় গানে একটি ভূমিকা টেনে নিয়ে যাওয়া বহু কিম্বদন্তী চরিত্র-ভুমিকার তিনি অন্যন্য চ্যালেঞ্জ। উমা চরিত্রের অভিজ্ঞ মঞ্চ বিক্ষেপে মোনালিসা চট্টোপাধ্যায় একেবারেই সেরকম। তিনি যেন এক আবির্ভাব। অন্তর কল্পনা, তিনি এক বিশেষ মনন। তাই কিছু বলতে গেলেই ভাবতে হচ্ছে। তবুও তিনি নাটকের প্রচলিত গন্ডির মধ্যেই আছেন কী? বাইরে আসার পথ কী একেবারেই নেই। সব বলেও তিনি অনবদ্য অপরিহার্য এক জীবনীশক্তির নমুনা। অপূর্ব বীরভূমের উত্তম চট্টোপাধ্যায়ের হাসন জান ভূমিকা। কি ভাল গানের গলা। কথ্যভাষা ও দেহের বিন্যাস সুন্দর। তবে আরো স্থীর স্থিতিজাড্যে এই জান হাসন শক্তিশালী হবে কিনা, তাও ভাবছি। অনেক প্রসেসিং করেই এমন নির্মাণ সম্ভব। তবুও থাক বলা কথাগুলি ভেবে ফিরে দেখার জন্যে। এই দুই হৃদ পদ্মের বিকাশ সুন্দর হলেও সঞ্চরণ সীমিত করা যায় কিনা, নাটকীয়তার বিপক্ষে না এনে তা ভাবা যায় কিনা, খুঁজে দেখতে অনুরোধ করছি। গৌতম চক্রবর্তী (মাঝি), বিদিশা সেন (সোনালিয়া), শিপ্রা মুখার্জী (পিয়ারী), গোপা আচার্য (দিলারাম), রিয়া দে (লবজান), মৌমিতা দাস (বড় বিবি আজিজা), অদিতি রায়চৌধুরী (মা), বন্ধু মোবারক ও সতীর ভূমিকায় অয়ন মন্ডল, সাথে সোহাগ এবং এমদাদা (মামা) চরিত্রে স্বর্ণেন্দু সেন, সবাই মিলেই এক অখন্ড শূন্যের মাঝারে যাবার অপুর্ব মিশ্রিত রূপারোপ অবশ্যই।
তবে তনুশ্রী সাহার পাখি হয়ে স্থির থাকা বদ্ধ হৃদয়াবেগ আরেক বিশেষ পাওয়া। সুন্দর সুরেলা গলার এই পাখি বুকের ভেতরের কুলুঙ্গিতে তুলে রাখা মাধুকরী শক্তি। সমবেত তানের কাজে আছেন সাগর বণিক, সুমন সিংহ রায় ও শুভজিৎ। নাটকে তাই নাচে গানে কোরিওগ্রাফের অনিবার্য প্রেক্ষিতে কেউ-ই কম নন। বাপ্পাদিত্য প্রামাণিকের রূপসজ্জা এবং পঙ্কজ দিংহ রায়ের নৃত্য পরিকল্পনা নাটকের শরীরে অবান্তর আগে নি। পোশাক পরিচ্ছদ আবহ আলো গান সব নিয়ে বহুল চর্চিত, জসীমউদ্দিন কাব্য কবিতার নাটক, মৈমনসিংহ-গীতিকা’র বা পূর্ব বঙ্গীয় পাঁচালি কথকতা লোকনাট্য থেকে লালন গীতি, পীরের গান, বিয়ের গান, ইত্যাদির বিগত বাংলা নাটকে গ্রামের পটকথা ইতিহাসের নবতম উদ্ভাবন শূন্যের মাঝারে নাটক।