Tuesday, November 19, 2024
Tuesday, November 19, 2024
Homeনাটকলেটো গানের তথ্যানুসন্ধান ও নজরুল

লেটো গানের তথ্যানুসন্ধান ও নজরুল

দেবা রায়

লেটো গান হল বাংলা যাত্রাগানের একপ্রকার আঞ্চলিক লোক সংগীত। পশ্চিমবাংলার বর্ধমানে এই লোক সংগীত পালা আকারে গান, নাচ আর অভিনয়ের মাধ্যমে উপস্থাপিত হয়। লেটো গানের শুরুতেই থাকে বন্দনা। এই পালায় কিশোর বালকরা মেয়েদের পোশাক পরে নটী সাজে। সামাজিক রঙ্গরসের বিষয়কে কেন্দ্র করে গরে ওঠে পালা। থাকে গ্রামীণ জন-জীবনের নানা কথা। এছাড়া পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক কাহিনী নিয়েও এই পালা রচিত ও অভিনীত হয়।

লেটোগানে অনেক সময় দুই গোষ্ঠীর মধ্যে প্রতিযোগিতার আকারে দেখা যায়। দলের প্রধানকে বলা হয় ‘গোদা কবি’। এই গানের আসর সাধারণত বসে শীতকালে ফসল ওঠার পরে কৃষকদের অবসর সময়ে। মানুষকে মনোরঞ্জনই এই পালার মূল উদ্দেশ্য। এই গানের সমাদর বেশি মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে দেখা যায়। বাংলার খুবই জনপ্রিয় এই লেটো গান।

লেটো গান কিভাবে এলো?

চর্যাগীতির পরে বাংলা সাহিত্যে ও সঙ্গীতে একটি বড় ধরনের ধাক্কা বখতিয়ার খিলজির বাংলা অভিযানের মাধ্যমে। ১২০৪-০৫ খ্রীষ্টাব্দে গৌড় দখলের মধ্য দিয়ে শুরু হয় বাংলার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা। ইলিয়াস শাহ বাংলা স্বাধীন সুলতান হিসাবে রাজ্যপাট শুরু করেন ১৩৪২ খ্রিস্টাব্দ থেকে। এইসময় এসে অস্থিরতা কিছুটা কমে। তাঁর শাসনকালে তার রাজত্বের অঞ্চলসীমানা বাড়িয়ে অধিকার করেন। তাঁরই সময় বাঙালি কবি চন্ডীদাস জীবিত (ডঃ মহম্মদ শহিদুল্লাহর মতে)। বাংলা সাহিত্য চর্চা আবার শুরু হয়।

১৩৫০ থেকে ১৪৫০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে আমরা বিদ্যাপতির পদাবলী, বড়ু চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বিকশিত হয়ে গেছে। এর সাথে আদি ঝুমুর, বাউল তো ছিলো বলেই ধরে নেওয়া হয়। এরপরেই মঙ্গকাব্যের জনমানষকে আচ্ছন্ন করে রাখে। এরপর কৃত্তিবাস ওঝা (১৩৯৯-১৪৩৩) বাংলা সাহিত্যের নবতর ধারার সূচনা করেন বাংলায় রামায়ন রচনার মধ্য দিয়ে। ১৪৫০ থেকে ১৭০০ সালের মধ্যে রাঢ় বাংলাইয় ঝুমুর, পূর্ববঙ্গের ভাটিয়ালি, উত্তরবঙ্গের ভাওইয়া গানের সুত্রপাত হয়েছিল। গুরুর মাধ্যমে বাউল গান, মুসলমান সম্প্রদায়ের জারি গান এসময়েরই ফসল।

এরপর বর্গীর আক্রমণ এবং দ্বিতীয় আঘাত সিরাজদৌল্লার পতন, সব মিলিয়ে বাংলার সাহিত্য ও সংগীত জগতে বিপর্যয়। ১৭০০ থেকে ১৮০০ সালের মধ্যে বাংলা গানে যুক্ত হয়েছিল ‘কবিগান’। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে আখড়াই, হাফ আখরাই আর কবিগানের মিশ্রণে জন্ম নেয় আধুনিক পাঁচালি। সামগ্রিক এই সব গানের প্রভাব পড়েছিল রাঢ় অঞ্চলেও। 

সেকালের রাঢ় অঞ্চলের শ্রমজীবী প্রান্তিক গোষ্ঠীর কাছে এইসব গান ও লোকনৃত্য চিত্তবিনোদনের অন্যতম মাধ্যম ছিল। আর রাঢ় বাংলার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর একটা বর অংশই ইসলাম ধর্মের। অচিরেই ইসলামী গানের জন্ম হল। এবং মনসামঙ্গলের আদলে তৈরি হল সত্যপীরের গান।

পাঁচালির অনুকরণে হল সত্যপীরের পাঁচালী, হোসেনের পাঁচালী। কৃষ্ণযাত্রা হল ইমামযাত্রা। সনাতন ধর্মীদের পটুয়া গানের চিত্রাংশে থাকতো পৌরাণিক কাহিনী, কিন্তু মুসলমান পটুয়ারা তাদের গান ব্যাবহার করে, সত্যপীর ও গাজীপীরের চিত্রকর্ম রাখতো।   

ঠিক এই সন্ধিক্ষণেই উদ্ভব হয়েছিল লেটো গান, উদ্ভাবক মুর্শিদাবাদ জেলার একঘরিয়া গ্রামের মুন্সি আহমদ হোসেন। যদিও তাঁর গানের নমুনা কিছু পাওয়া যায়নি। ঐতিহাসিকদের মতে, এটা সম্ভাব্য নাম। তাই লেটো গানের শুরুটাকে নির্ধারণ করতে হলে আমাদের বাংলা অষ্টাদশ শতকের পুর্বের বাংলা গানের ধারা অনুসরণ ছাড়া সম্ভব নয়।

লেটো গানের গবেষণায় জানা যায়, বেশ কিছু গোদাকবির কথা। যেমন আকাই মিঞা, অখু শেখ, আব্দুল খাঁ, আমীর খাঁ, আরশেদ আলি, একালী বকশ, কাজী আবু তাহের, গোলাম রহমান, ধরু হাজরা, নবাব মণ্ডল, ফকির শেখ, রুস্তম শেখ, শুকু শেখ প্রমুখ।  

বজলে করিম ছিলেন এই অঞ্চলের অপরাজেয় জনপ্রিয় এক গোদাকবি। তাঁর রচিত পালায় পাওয়া যায় সমকালীন সামাজিক প্রেক্ষাপট, পাওয়া যায় আর্থসামাজিক দ্বন্দ্ব। কাব্য রচনায় অসাধারণ দক্ষতা, রসবোধ বিরুদ্ধপক্ষকে ঘায়েল করার তীক্ষ্ণ পদরচনা, বিদ্রুপ ইত্যাদি।

এর আর এক নাম ছিল চাপান উতোর সঙ। তিনি জানতেন ইসলামের শরিয়তি, সুফি, বাউল, হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী, বৈষ্ণব ও শাক্ত দর্শন। 

লেটো দলের গঠন

যেহেতু পালাধর্মী, সেইজন্য এখানে একাধিক কণ্ঠশিল্পী ও বাদ্যকার দরকার। প্রধান কবিয়ালের অধীনে দল সাজানো হত। তিনিই গোদাকবি। দলে অংশগ্রহণকারীদের নানা নামে ডাকা হয় যেমন-

ডাকসুরা- পালা সূচনায় ডাক দেওয়া বা উপস্থাপক

গোদাকবি- দলের পরিচালক অ প্রধান কবি।  

বাই, ছোকরা বা রাঢ়- দলে দেখতে সুন্দর কিশোর যে মেয়েদের পোশাক পড়ে নারী ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়। এরা পালার মহিলা চরিত্রে অভিনয়, গান, নাচ করে থাকে।

পাঠক- রাজা, মন্ত্রী, সেনাপতি অর্থাৎ শক্তিশালী পুরুষ চরিত্রের নাম পাঠক।

সংগাল- যারা নাচ, গান আর অভিনয়ে মাধ্যমে দর্শককে হাসায় তারাই সংগাল। এরা সঙ সেজে এই পালায় থাকে বলেই এই নামে ডাকা হয়।

কবি নজরুল ইসলাম ও লেটো

কাজী বজলে করীমের হাত ধরে কবি কাজী নজরুল ইসলাম যখন লেটোগানের জগতে আসেন। তখন তাঁর বয়স বারো-তেরো বছর। তাঁর শৈশবের সেই মুহুর্তে তাঁর গুরু ব্জলে করীম ছিলেন সেই অঞ্চলের স্বনামধন্য অপরাজেয় গোদাকবি। তাঁর রচনা আমাদের লোকসাহিত্যের উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে গেছে।

তাঁর সেই পালায় উঠে এসেছে সেই সময়ের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক নানা তথ্য। আরেক গোদাকবি শেখ চকোর এবং কবিয়াল বাসুদেবের লেটো ও কবিগানের আসরে নিয়মিত অংশ নিতেন। গান গাইতেন। ঢোলক বাজাতেন। এই সময়েই তাঁর সাহিত্য জীবন শুরু। এখানেই দার সঙ্গীত রচনার দক্ষতা নির্মাণের আঁতুড়ঘর। এই ক্ষেত্র থেকেই তাঁর অভিনয় শেখা আর নাট্য বা পালা রচনার শুরু।    

লেটোদলের জন্য কাজীর লেখা পালাগুলি কি?

পালার গানগুলি হল- চাষার সঙ, শকুনীবধ, রাজা যুধিষ্টিরের সঙ, দাতা কর্ণ, আকবর বাদশাহ, কবি কালিদাস, বিদ্যাভুতুম, রাজপুত্রের গান ইত্যাদি।  

RELATED ARTICLES
- Advertisment -

Most Popular