নৈতিক রায়
জন্ম- ১৫ জুলাই, ১৯২৫
নিয়ম করে নাট্যাভিনয় চলতো কলকাতার ‘লরেটো স্কুলে’ (শিয়ালদহ)। সেই নাট্যাভিনয় দেখবার জন্য দর্শকও যেতেন নিয়ম করে। নাটকের ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে, দেশে বিদেশের নানা নাট্য বিদগ্ধজন, সাথে সাধারণ মানুষ। তাঁদের কাজের সাথ্যে সকলকে যুক্ত করে নেওয়ার জন্য, সেখানে একটা রেজিস্টারখাতা ছিল, সেখানে সকলে এসে তাঁদের নাম ও ঠিকানা লিখে দিতেন। আর সেই ঠিকানায় পরবর্তী নির্ধারিত অভিনয়ের সংবাদ একটা পোস্টকার্ডের বিনিময়ে পৌঁছে যেত।
আর এই মহতী কাছে কাণ্ডারি বাংলা নাটক নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষার স্রস্টা বা নায়ক সুধীন্দ্র নাথ সরকার। যিনি আমাদের সকলের কাছে বাদল সরকার (Badal Sirkar) নামে পরিচিত। আজ (১৫, জুলাই, ২০২৫) থেকে একশ বছর আগে (১৫ জুলাই, ১৯২৫), উত্তর কলকাতার বিডন স্ট্রীট-এ তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা মহেন্দ্রলাল সরকার স্কটিশ চার্চ কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপনা করতেন। জন্মের সময় তুমুল বৃষ্টির কারণে তার নাম রাখা হয়েছিল বাদল। যদিও সেটা ডাক নামহিসেবেই বিবেচিত হয়েছিল। আসল নাম সুধীন্দ্রনাথ। সেই ডাকনামেই তিনি দেশেবিদেশে সমাদৃত হয়েছেন।
প্রাথমিক পাঠ শুরু করেছিলেন ক্যালকাটা অ্যাকাডেমিতে। তারপর ভর্তি হন স্কটিশ চার্চ কলেজিয়েট স্কুলে। সেখান থেকেই ম্যাট্রিকুলেশন শেষ করেন। এরপর শিবপুর বি-ই কলেজে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পড়াশুনা করে পাশ করেন ১৯৪৭ সালে।
ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়ালেখা করলেও তাঁর নাটক-সাহিত্যের ওপর আগ্রহ ছিল সেই ছোটবেলা থেকেই। যার প্রভাব পড়ল দীর্ঘ একটা সময় পেরিয়ে। তাঁরই ৬৭ বছর বয়সে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যে ভর্তি হয়ে ১৯৯২ সালে এমএ পাশ করলেন।
ইতিমধ্যে তিনি লিখে ফেলেছেন একাধিক মঞ্চসফল নাটক। প্রসেনিয়াম থিয়েটার থেকে বেরিয়ে পড়েছেন বিকল্প থিয়েটারের সন্ধানে। বাংলা নাট্যচর্চায় জন্ম দিলেন এক নতুন ভাষার। যার নাম দিলেন থার্ড থিয়েটার। এই নিয়ে শুরু হল নানা মহলে নানান গুঞ্জন। আলোচনা- সমালোচনা চারপাশে তথাকথিত বুদ্ধিজীবী মহলে ঝড় তুললো। আর এরই সাথে যুক্ত হয়ে পড়ল তাঁর রাজনৈতিক পরিচয়। নাটকে রাজনীতি বা রাজনৈতিক নাটক নিয়ে ছুতমার্গিতা নাট্য আঙিনায় বরাবরই ছিল, কিন্তু বাদল সরকারের রাজনৈতিক ভাবনা তাঁকে এক নতুন দর্শনের জন্ম দিতে সাহায্য করল। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার লেলিহান শিখা হয়ে একের পর এক নাটক আছড়ে পড়ল গ্রাম বাংলা মাটিতে। সাধারণ মানুষ পেলেন নতুন এক প্রতিবাদের ভাষা। আর বাংলা থিয়েটার পেল যেন মুক্তির স্বাদ।
ঘেরা মঞ্চের বাইরে বেরিয়ে সরাসরি মানুষের সামনে গিয়ে একই প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে অভিনয় করে যাওয়া। তাহলে কি নাট্যকলার এরকম উপস্থাপনা আমাদের ভারতীয় সংস্কৃতিতে নতুন? না মোটেই না। সেই লোকনাট্য যেমন, আলকাপ, গাজন, গম্ভীরা, নাচনী, খেউর ইত্যাদি ফর্ম তো আমাদের দেশজ বা লোক-সংস্কৃতি। এই জাতীয় ফর্মকেই বলা হচ্ছে ফার্স্ট থিয়েটার। আর সেকেন্ড থিয়েটার বলতে, বিদেশী থিয়েটারের অনুকরণে নির্মিত মঞ্চ বা অডিটোরিয়ামে নাট্য প্রযোজনা অভিনয় হলে যা প্রসেনিয়াম নামে পরিচিত, তা। আর এরপরের এই দুই-এর সমন্বয়ে সাথে রাজনৈতিক ভাবনার সংমিশ্রণে তিনি গড়ে তুললেন থার্ড থিয়েটার। যা আজকের নাট্যচর্চায় যেন অন্যতম অবলম্বন হয়ে উঠেছে। আজকের নাট্যচর্চার কর্মীরা, তাঁর দর্শনেই যেন হাঁটছেন, বা খুঁজছেন নতুন কিছু।
কর্মসূত্রে বিদেশে থাকার ফলে, সেখানকার নাট্য চর্চায় পরিক্ষা-নিরীক্ষার কাজ ততদিনে শুরু হয়ে গিয়েছে, যাদের দ্বারা তিনিও প্রভাবিত হয়েছিলেন, যেমন আর্তো, ব্রেসট, বোয়াল প্রমুখ।
পাঁচের দশকের গোড়ার দিকে তাঁর নাট্যজীবনের সূচনা। যদিও প্রথম জীবনে সৌখিন থিয়েটারে তিনি অভিনয় ও নির্মান করেছেন। শতাব্দী নাম দিয়ে একটি নাট্যদল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আর তার লেখা সলিউশন এক্স নাটকটি সেই ব্যানারে তাঁরা অভিনয় করেছিলেন। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে সর্বভারতীয় স্তরে তাঁকে সুখ্যাতি এনে দেয় তাঁর ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ নাটকটি। শতাব্দী দল থেকে তিনি নিয়মিত কলকাতার কার্জন পার্কে আকাশের নিচে নাটক করা শুরু করলেন। মঞ্চের বাইরে সাধারণ মানুষের মাঝে নাটক নিয়ে পৌঁছে যাওয়ার কাজ শুরু হয়ে গেল। এরপর সবটাই ইতিহাস। খুব স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ মানুষের সাথে থিয়েটারের যে দূরত্ব, সেটা ঘুচতে শুরু করলো। নাট্যকর্মীদের কাছে এই নতুন নাট্যভাষা সম্মান ও আদরের সাথে গৃহীত হল। থিয়েটার নিয়ে গ্রাম পরিক্রমার সাথে সাথে দর্শকদের সাথে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপিত হল। সাথি হিসেবে দুটি দলকে শতাব্দী পাশে পেল। এক কাঁচরাপাড়া পথসেনা ও দুই বেহালা আয়না। যারা আজও তাঁরই দর্শনে সেই কাজ এগিয়ে নিয়ে চলেছেন।
প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার ঝোড়ো হাওয়ায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন সত্তর দশকের অত্যরম আইকন। বিনোদন সর্বস্বতাকে উপেক্ষা করে, উঠে এল প্রতিবাদের নয়া হাতিয়ার। ভারতীয় থিয়েটারে এই নতুন নাট্য দর্শনের অভিভাবকত্ব পেলেন বাদল সরকার। তিনিই বাংলার গণ-সংস্কৃতি আন্দোলনের পুরোধা পুরুষ।
বাদল সরকারের (Badal Sirkar) নাটকে কোনও প্লট ছিল না। কোনও চরিত্রের চরিত্রায়ন ছিল না। অভিনেতা অভিনেত্রীদের স্বাধীনতা ছিল নিজ নিজ চরিত্র নির্বাচনের। তাঁর নাটকে দর্শকরাও অংশগ্রহণে সুযোগ পেতো। অনেকটাই ফোরাম বা ইন্টারেক্টিকভ আঙ্গিকে, দর্শকদের পক্ষ থেকে। শারীরিক ভাষা এই নাটকের বিশেষ প্রতিপাদ্য বিষয়। এই নাটক থেকেই স্পেস বা পরিসর ব্যবহারের গাণিতিক ভাবনার শুরু। বাদল সরকার নিজেও তাঁর চরিত্রের কলাকুশলীদের স্পেস ছেড়ে দেবার স্বাধীনতা দিতেন। ফলে, সকল কর্মীর উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় পাওয়া যেত সেসব নাটকে। নাট্য নির্মানের সাথে, কর্মীদেরকে দক্ষ করে তোলাই এই ভাবনার কারণ। অর্থাৎ অভিনেতা অভিনেত্রী আর পরিচালকের ‘মেয়ার পাপেট’ হয়ে থাকলো না। তাঁরাও তাঁদের চিন্তার উৎকর্ষতাকে যথাযথ প্রয়োগের সুযোগ পেলো।
একবার মণিপুরে একটা ওয়ার্কশপে তিনি গিয়েছিলেন, এবং মনিপুরী ভাষায় একটা নাটক নির্মান করেছিলেন। পরিসরে সেই অঞ্চলে প্রাপ্ত জিনিসপত্র দিয়েই তিনি মঞ্চের এরেনা সাজালেন। দর্শকদের বসতে দিলেন চটের ওপরে। সেখানে একজন অভিনেতাকে একাধিক চরিত্রে অভিনয় করানো হয়েছিল। অর্থাৎ যখন যে চরিত্রে সে অভিনয় করবে, তখন সেই চরিত্র হয়ে উঠতে হবে। থিয়েটারের নিজস্ব ভাষাকে নিজের মত করে বারবার ভেঙেছেন আবার মজবুত বুনিয়াদে ফিরিয়ে দিয়েছেন।
শহরাঞ্চলকে ভিত্তি করে তাঁর লেখা ‘ভোমা’ নাটক, যা নিম্ন মধ্যবিত্তের জীবন সংগ্রামের প্রতিরূপ। আবার ‘মিছিল’-এ উঠে আসে ক্ষুব্ধ মানুষের জোরালো প্রতিবাদ, আর তাকেই প্রতিহত করতে রাষ্ট্রের নির্লজ্জ ভূমিকা। তখন বাদল সরকারের ‘বাকী ইতিহাস’ বা ‘পাগলা ঘোড়া’ একধরনের লিটারারিনেসকে আমন্ত্রণ জানায় যা শরীরী বিভঙ্গ ও সংলাপ প্রক্ষেপণের বিমূর্ততাকে একাধারে প্রকট করে, আর ভাবনার ডালপালা বিস্তারে সাহায্য করে। উত্তর আইপিটিএ যুগে এই ভাবনার কৃতিত্ব তাঁরই।
অজস্র সম্মানে ভূষিত হয়েছেন এই নাট্য মহানায়ক। ‘সঙ্গীত নাটক আকাদেমি ফেলোশিপ’ লাভ করেন ১৯৬৮ সালে। এবং পারফর্মিং আর্টের সর্বোচ্চ সরকারী সম্মান এই ফেলোশিপ- এর ‘রত্ন সদস্য’ পেয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে জহরলাল নেহেরু ফেলোশিপ পান। ১৯৭২ এ পান ‘পদ্মশ্রী’ সম্মান। ২০১০ সাথজে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সাম্মানিক ডি.লিট পান।
তাঁরই বয়ানে তাঁকে খুঁজি আসুন, ‘আমি ছোটবেলা থেকেই প্রাইভেসি পেয়েছি। ওই ঘরটায় থাকতাম। একা। ক্লাস সেভেন এইট থেকে। সেভেন এইটে একটা প্রতিজ্ঞা আসলো, বিলাসিতা ত্যাগ করবো। পাশ বালিস ত্যাগ করেছি। আর বিয়ে বাড়িতে পান খেতাম, সেই পান খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি।…’
মাটির কাছাকাছি থাকা এই মহান শিল্পীর প্রতি আমাদের ‘বাংলা নাটক ডট ইন’ এর বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদিত হয়।