দেবা রায়
আজীবন বাম মতাদর্শে বিশ্বাসী ও রাজনৈতিক নাটকের অন্যতম পুরোধা পুরুষ সফদার হাসমি। ১৯৫৪ সালের আজকের দিনে তার জন্ম। ১৯৭৫ সালে দিল্লী বিশ্ব বিদ্যালিয় থেকে ইংরাজীতে এম এ পাশ করেন। ভারতের ছাত্র ফেডারেশনের একজন কর্মী হয়ে তিনি একসময় নাটক নিয়ে পথে নামেন ট্রেড ইউনিয়নের ‘সিটু’র পক্ষ থেকে। তাঁর পরিচালিত নাট্য সংগঠন জননাট্য মঞ্চ বা জনম।
সৃষ্টিসুখের উল্লাসে তাঁর নতুন নতুন নাটক বা মৌলিক উপাদান ও ভাবনা আপামর শ্রমজীবী মানুষের একমাত্র অবলম্বন হয়ে উঠেছিল। মালিক শ্রমিকের রক্ত চুষে খায়, কিন্তু শ্রমিককে পালটা সচেতন করার দায় কে নেবে, এগিয়ে আসেন সফদার। রাষ্ট্রই যে শেষ কথা নয়, জনগনের স্বরকে সেই উচ্চতায় নিয়ে যেতে তারা স্বল্প জীবদ্দশায় যা সুযোগ পেয়েছেন , দিয়ে গেছেন। ক্ষমতা লোভী রাষ্ট্র কতটা নৃসংস হতে পারে, যে এমন নাট্যপ্রাণ মানুষের হন্তক হয়ে ইতিহাসের পাতায় থেকে যায়।
ইতিহাস আমাএর সবকিছু ভুলিয়ে দেয় না। কিন্তু ইতিহাসকে গুলিয়ে দেয়ার চক্রান্ত চলেই। সফদারের বিজ লুকিয়ে আছে ভারতের আনাচে কানাচে, তারা সফদারকে ভালোবাসেন, মনে রাখেন । তা সে যতই তাকে ভুলিয়ে দেবার বা মুছে দেবার চক্রান্ত চলুক না কেন, সফদার থাকবে মেহনতী মানুষের অন্তস্থলে।
আজ কি ভাবা যায় একজন ইংরাজী সাহিত্যের ছাত্র যিনি তার ছাত্রজীবনের সক্রিয় রাজনীতিকে অবলম্বন করে মানুষের সেবায় তার দক্ষতাকে পাথেয় করে পথে এসে দাঁড়াবেন? না আমরা এটা প্রত্যাশা করতে পারি না। আজ রাজনীতি একটি ক্যারিয়ার। অথচ গাড়োয়াল, কাশ্মীর ও দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ইংরাজী সাহিত্য পরাতেন। একটা ক্ষমতা পাবার লক্ষ্য। যা সফদার ভাবতে পারতেন। ভাবেন নি, তিনি নিজের জীবন উতসর্গ করেছেন সেই রাজনীতির নামে যে রাজনীতিকে তিনি মেনে নিয়েছেন। যে রাজনীতি মানুষের কথা বলে। যে রাজনীতি প্রতিবাদের জঠর। যে রাজনীতি সোচ্চার কণ্ঠের কারিগর।
জরুরি অবস্থায় তাঁর ‘কুর্সি কুর্সি কুর্সি’ নাটক বিপুল সাড়া ফেলেছিল। একের পর এক নাটক ‘গাঁও সে শহর তক’, ‘তিন ক্রোর’, ‘আউরত’, ‘খিলতি কলিয়া’ নাট্যাভিনয় মানুষকে উজ্জীবিত করে। এরপর ‘হল্লা বোল’ নাটকটি এবং নাটকের এই নাম আপামর ভারতীয় যুবসমাজের ট্যাগলাইন হয়ে উঠেছে।
শাহিনবাগে এই নাটকটি অভিনয় চলাকালীন তাঁর দল ‘জনম’-এর ওপর আক্রমণ চালায় তৎকালীন কংগ্রেস আশ্রিত একদল গুন্ডা। সেই ভয়াবহ আক্রমণে শেষ জীবনের আলো নিভে যায় সেই ৩৫ বছরের সেই যুবকের। এত অল্প সময়ে তার প্রতিবাদী নাতকের সংখ্যা ২৪টি। এবং অভিনয়ের সংখ্যা প্রায় চার হাজার বার।
হাসমীকে হত্যার কোন বিচার হয় নি, নাগরিক সমাজের কাছে তাঁর নাটক রয়ে গেছে, কিন্তু তাঁর আদর্শের দিকটি কি সমাজ গ্রহণ করেছে? যে রাজনৈতিক বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে তাঁর উত্থান ও কর্ম জীবন সেই রাজিনীতি তাঁকে কি দিয়েছে? আজ যখন দেখি সেই রক্ত রঞ্জিত হাত কাস্তে হাতুরির আড়ালে শোভা পাছে, তখন মানুষের মনে সেই বিভ্রান্তির বীজ থেকেই যায়।
সফদার কোনো দোষ করেন নি, সফদার নিজের জীবন উতসর্গ করেছেন। নিজেকে শ্রমিক শ্রেণীর মুক্তির সংগ্রামে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন, আর তার পার্টি বা রাজনৈতিক বিশ্বাস তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এটা বলা অত্যুক্তি হবে না।
আমরা যারা রাজনীতি ভালোবাসি, যারা মনে করি একমাত্র রাজনৈতিক থিয়েটারই সাধারণ মানুষের মুক্তির পথ দেখায় , তারাই সফদারকে মনে রাখুক। সফদারের আদর্শের পথকে বেছে নিক। জন্মদিন বা মৃত্যুদি পালনের মধ্য দিয়ে তাকে স্মরণ করা আসলে সেই চিরাচরিত বুর্জোয়া সংস্কৃতিরই একটি লক্ষণ। আর সুবিধাবাদীরা সব সময়ই এই পথ অবলম্বন করেন, কারণ আদর্শের পথ অবলম্বন করা কঠিন। সেখানে ত্যাগ থাকে তিতিক্ষা থাকে, ক্ষমতার প্রতি লোভাতুর জিভ থাকে না।
তাই আমাদের কমরেড (প্রকৃত) সফদার মানুষের হৃদয়ে আছে। ফুল মালা চন্দনে নেই। আছে তাঁর লেখা নাটকের সংলাপে।
আর সেই সংলাপ , দিকে দিকে ধর্ষণ, গ্রাম পোড়ানো, বেকারত্ব, তোলাবাজি, ঘুষ, চুরি, হত্যা – যার সবই একচ্ছত্র শাসকের সাংস্কৃতিক মাফিদেরই কাজ। তাদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠতে না পারলে সফদার সফদার করে লাভ নেই।
নাট্যনির্দেশক ও শিক্ষক পিটার ব্রুক তার ‘দ্য এম্পটি স্পেস’-এ বলে গেছেন-
“আমি যে-কোনো মুক্তাঞ্চলকে মুক্তমঞ্চ বলতে পারি। একজন সেখান দিয়ে পার করে গেলে অন্যজন কিন্তু তাকে দেখে, সেখান থেকেই কিন্তু থিয়েটারের প্রাথমিক সম্পর্ক তৈরি হয়ে ওঠে।”
আর এই বয়ানের নিরিখেই সফদার জনগনের চেতনাকে উজ্জীবিত করার মন্ত্র স্থাপন করেছেন। মঞ্চ নাটকের চার দেওয়ালের ঘেরাটোপ থেকে তিনি মুক্ত অঞ্চলে আকাশের নীচে তার বক্তব্য নিয়ে নেমে এসেছেন। মাটির এই টান না থাকলে সমাজ গঠিত হয় না। তাই সফদারের প্রতি ভালোবাসা যতনা দরকার তার চাইতে বেশী দরকার তার আদর্শের বার্তাকে কঠোর ধ্বনিতে ব্যক্ত করা, পথকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
সংলাপ/হল্লাবোল/ সুত্রধার/
“আপনার মাথায় কি একটুকুও ঘিলু নেই? সামান্য এই কথাটা মাথায় ঢুকছে না যে শ্রমিকের জীবন নিয়ে নাটক করবে, তা সে ঝান্ডা নিক আর নাই নিক, শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা তো গিয়ে দাঁড়ায়, বাঁচতে গেলে লড়তে হবে’’।