দুলাল চক্রবর্ত্তী
কলকাতা সরস্বতী নাট্যশালা নির্মাণ করেছে “সবটাই অভিনয় নয়”নাটকটি। ২৭ জুলাই মধুসূদন মঞ্চে অভিনীত হলো। এযাবৎ ৩১টি মঞ্চায়ন হয়ে গেলো।
খুবই সাদামাটা একটা গল্প। এক দাদা বোনের আর্থিক অনটনের জীবন যুদ্ধ আছে। তার সাথে প্রায় বেকার পার্থের নাটকের চর্চা চালিয়ে কিছু উপার্জন করে যাবার ইচ্ছে পুরণের দোটানায়, যে অবাস্তব পাগলামি আছে, তার হদিস দিয়ে এক সন্ধ্যার কিছু সময়ের বিভ্রাট-অবগতি দিয়েছে, এই নাটক। যার ভিত্তির যন্ত্রণা, নিশ্চিতই সবটাই অভিনয় নয়। আবার সবটাই নাটকও নয়।
একটা হতচকিত হতচ্ছাড়া জীবন পিপাসা মানুষের মধ্যে অবান্তর ঘুণপোকা হয়ে থেকে কুঁড়ে খায় অস্তিত্বের সবটুকু। প্রাপ্তির নিদেন স্বাচ্ছন্দ বাতাস দুই নারী পুরুষের দুই প্রশান্তি বিস্তারের ব্যবচ্ছেদ দুটি জীবনকে আস্বস্ত করতে পারছে না। তাই বিবাদ মান অভিমান সম্মান, পাতিলের ঠোকাঠুকি বিভ্রাট যখন প্রাত্যহিক জীবনে, দিনের পাওনা পাওয়া বিষন্নতায় চায়ের পেয়ালায় গরমাগরম বাস্তব। তখন স্ক্রিপ্ট মুখস্ত করাই বিড়ম্বনার বিষাক্ত গরল গিলে নেওয়া। আগুন জ্বলে নি। নাটক সে পথে নেই। তরল চেনায় মরনকে স্বীকার যেমন এখন কষ্টের। তেমনই ফালতু হয়ে, এই নাটকে পার্থ, মোনা এবং বল্টু সময়ের আর্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক লুটপাটের শিকার হয়েই ব্যর্থ। সবটাই ওরা এড়িয়ে গিয়ে গাছের ডালে বাঁদরের বাঁদরামি, কাই কিচির, উকুন বেছে খাওয়া, কিল চড় থাপ্পড়, লাফ ঝাফ। এসবেই ওরা মত্ত। তবুও অভিনয় করে না। নাটকও নয় একেবারেই। কারণ অদৃশ্য সেই শক্তিশালী নাচিয়ে মাদারী নিজেই মেঘনাদ এখানে।

রাজনীতি নেই অভিনয়ে, গল্পে নাটকের প্রেক্ষাপটে। কিন্তু আছে অস্থিরতা। আছে পথ খোঁজা। তাই আসেনি ফুটপাত থেকে বাড়ির ঠিকানা খুঁজে পাওয়ার বিন্দুমাত্র অবকাশ। সকলেই দারুণ সাবলীল অভিনয়ে মুগ্ধ করে দেন। বিভিন্ন ভুমিকায় পার্থ: জয়েশ ল, তার বোন মোনা: সুব্রতা সাহা এবং কুকড খাবার ডেলিভারি বয় বল্টু: সৌরজিৎ বসু। এই নাটকের রচনা ও নির্দেশনা জয়েশ ল স্বয়ং। নির্দেশনায় আবহের ভূমিকা খুব ভাল। নির্দেশনার ছটফটে মেজাজের কিছু চালু কাজ নজর কেড়ে নেয়। তবে পোষাকে এবং সেটের মলিনতা নিয়ে ভিন্ন মত আছে। একবগগা গল্পের একটা টার্নিং বা রিটার্ন মোচড় খুব দরকার। প্রথাগত নাটকে পোষাক খুলে বিভৎস সময়ের দলিল হবার কিছু উপাদান নাটকের চারপাশে ঘুরঘুর করছে। বল্টুই এ নাটকের এক্সট্রা পার্ট হয়ে তীক্ষ্ণ তীব্র হয়ে পার্থ মোনার ঘাড় বেঁকিয়ে দিতে পারে? তার দ্বিতীয় প্রবেশ খাবারের সাথেই কিল চড় থাপ্পড় আনতে পারতো কিনা, ভাবা যেতে পারে।
ভাবার প্র্যাক্টিস থেকেই প্রত্যাশা আসে। কিছু সত্য হয়ে আসার জন্যেই সবটাই অভিনয় নয়, প্যাকেটের ভিতর থেকে বেরিয়ে এলে, একটা বিস্ফোরণ হতো। তবে নাটকের চমৎকার আলো: বাবলু সরকারের দক্ষতা, সেই রকমই আবহে: সন্দীপ মুখার্জী।
নাটকের গল্প এরকম, পার্থ, একজন নাট্যকর্মী, নানান দলে অভিনয় করে তার জীবন, জীবিকা চলে। তার সংসার বলতে সে আর তার ছোট বোন মোনা। পার্থ-র সহপাঠীরা আজ বড় বড় কোম্পানিতে কর্মরত, কেউ ডাক্তার, কেউ বা ইঞ্জিনিয়ার। তাদের আছে গাড়ি, বাড়ি, মোটা অংকের ব্যাংক ব্যালেন্স, একাধিক ফ্ল্যাট, কি না নেই তাদের। আর পার্থ-মোনাদের একটা ভাঙাচোরা বাড়ী, যাও কিনা ব্যাংক-এর কাছে মর্টগেজ রাখা আছে। আশঙ্কা টাকা শোধ না করার ফলে যে কোন দিন ব্যাঙ্ক বাড়ি হস্তগত করবে। করতেই পারে। মোনা কিছু উপার্জন করে, লোকের বাড়ী আয়ার কাজ করে। এভাবেই দু’জনের চেষ্টায় সংসার চালাচ্ছে দুই হতবাক চালক। পার্থ শিক্ষিত ছেলে। বি কম পাস। চাইলে একটা ভালো পেশা বেছে নিতে পারতো। কিন্তু নাটকের পোকা মাথায় কিলবিল করে। তাই এই পথ, থিয়েটার করে সংসার চলে না। বুঝতে পারছে সব। অদৃশ্য অদৃষ্ট। থিয়েটারের প্রতি অদম্য ভালোবাসা, চলমান গড্ডালিকা প্রবাহের যা হোক লেগে থাকা আর ভুলভাল সৃষ্টির নেশা তাকে পাগল করে তোলে, যেমন এই বিশ্বায়নের বাংলা থিয়েটার বাজারে, হাজার হাজার পার্থ নাটকের ভাত খেতে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। জীবিকা অর্জনের চাহিদায়। সরস্বতী নাট্যশালা সেটাকেই বলেছে সবটাই অভিনয় নয়। গুটি গুটি পায়ে জয়েস ল, আমার দেখা ৭/৮ বছরে বেশ চলে এলো চাঁদের পাহাড়ের পাদদেশের উপত্যকায়। কিছু করে দেখাবার ক্ষমতায় জেদি টগবগে জয়েস এগিয়ে যাক।