শুভশ্রী দত্ত
গত ৪ঠা নভেম্বর সন্ধ্যেবেলায় আকাদেমী অফ ফাইন আর্টসে মঞ্চস্থ হয়ে গেল গড়িয়া একত্রের প্রযোজনায় রেহানে জব্বরী অর্থাৎ সেই নির্যাতিতা এক নারীর কাহিনী নিয়ে নির্মিত নাটক ‘রেহানে এক নাম’। সমাজের স্বাভাবিক নিয়মে ঘটে চলা আরোও পাঁচটা জায়গার মতোই ১৯ বছর বয়সী ইরানী মেয়ে রেহানের উপর অমানবিক অত্যাচারের কথা বর্ণিত হয়েছে এই নাটকে।
রেহানে জব্বরী পেশায় একজন ইন্টেরিয়র ডিজাইনার৷ অল্পসল্প লেখালেখিও চলত তাঁর৷ সে খুবই সাধারন ঘরের এক মেয়ে, আর তাই সমাজ, রাজনীতি এমনকী আইন পর্যন্ত তার এই গুণ কিম্বা তার সন্মানকে এতটুকুও গুরুত্ব দেয়নি৷ এই সত্য ঘটনা অবলম্বনেই এই নাটক৷ রেহানের জীবনকাহিনীর রাজনৈতিক নিষ্ঠুরতার জ্যান্ত উদাহরণ যার অবলম্বনে, উজ্জ্বল চ্যাটার্জীর লেখা নিয়ে নির্দেশক ভাস্কর সান্যাল নির্মাণ করেন ‘রেহানে এক নাম’৷ রেহানে পেশাগত কাজের জন্য, শহরের উচ্চপদস্থ মানুষ মোর্তজা আবদোলালি সারবন্দির কাছে, গৃহসজ্জার কাজ নিয়ে গিয়েছিল৷ কিন্তু ঘর সাজাবার জন্য ডেকে পাঠানো তো ছিল এক বাজে অজুহাত৷ আসল উদ্দেশ্য ছিল, শরীর ভোগ৷ কিন্তু রেহানে যে অতি সুন্দর ও ব্যক্তিত্বপূর্ণ এক নারী৷ সে ধর্ষিত হওয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করতে বিফল হয়ে একসময় যখন সে বুঝল, যে তা অসম্ভব৷ তখন সে সারবন্দিকে ছুরি দিয়ে আঘাত করতে বাধ্য হল৷ এই ঘটনায় সমাজের উচ্চস্তরের মানুষদের বক্তব্য ছিল, এই উঁচুপদের ব্যক্তিটি যদি ওই মহিলাকে একটু ছোঁয়, তাতে কি এমন ক্ষতি হত! এরজন্য একেবারে খুন? সমাজ ও রাজনীতি এই ঘটনাকে বারবার নোংরা দাগিয়ে দিল৷ তাকে খুনী প্রমান করার জন্য আইনের সাহায্য নেয় এবং তা সফল করতে তারা কোনো ত্রুটি রাখে নি৷
রেহানেকে জেলবন্দী করা হল৷ বন্দী অবস্থায় তাকে দিয়ে জোর করে চিঠি লেখান হল যে সেই-ই খুনটা করছে৷ পরিবারের মানুষদের সন্মান জীবন রক্ষার জন্য মিথ্যে বয়ান লিখতে হল রেহানে জব্বরীকে৷ জেলের মধ্যে, ওর উপর মানসিক-শারীরিক যে নির্যাতন, অত্যাচার চলেছিল। আর সেই সব কথা সে কাব্যিক স্টাইলে চিঠি লিখে, ওর মা শোলেহার কাছে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছিল৷ সেই চিঠি থেকেই, জেলের ভেতরের অমানবিক অত্যাচারের কথা সকলের জানা সম্ভব হয়েছে৷
সমাজের উচ্চপদস্থ মানুষের নামে, বদনাম করছে এক সাধারণ ঘরের মেয়ে৷ সমাজ তো সেটা কোনোভাবেই মেনে নেবে না৷ মানবাধিকার সংগঠন এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে আন্দোলন করেছিল৷ কিন্তু রাজনৈতিক চাপ তা ধূলিসাৎ করে দিল৷ রেহানের নামে অভিযোগ করা হল যে উচ্চপদস্থ মানুষের কাছে এই সাধারণ মেয়েটি সুযোগ সন্ধানের জন্য গিয়েছিল, এবং সারবন্দি তাকে পাত্তা দেয়নি তাই মেয়েটির কার্য্যসিদ্ধি না হওয়াতে সে খুন করে৷ রাজনৈতিক নেতাদের আদেশে আইনের রক্ষক এই অভিযোগকেই প্রতিষ্ঠা করার জন্য শেষ চেষ্টায়, বিচারপতি শাস্তি সরূপ দিলেন ফাঁসি৷ যতক্ষণ না রেহানের জন্য ফাঁসির আদেশ এসেছে, ততক্ষণ পর্য্যন্ত বারবার বিচারপতির পরিবর্তন ঘটেছে৷ সাতটা বছর জেলের মধ্যে অমানবিক অত্যাচারের স্বীকার হয়েও, চোখ থেকে তার এতটুকুও জল গড়ায় নি৷ তাকে যখন ফাঁসিতে ঝোলান হল, তখন তার বয়স ২৬ ৷অতি সাধারন এক পরিবারের মেয়েকে বদনাম করে, অসন্মানিত করে, জেলের মধ্যে পাশবিক অত্যাচার করে, খুনী প্রমান করে ফাঁসিতে ঝোলান হল ৷
সম্পূর্ণ ঘটনাটি দর্শকের সামনে তুলে ধরতে, ঊর্দু ভাষার সাবলিল ব্যবহার ও স্পষ্ট উচ্চারণ এবং দৃশ্য অপুর্ব অবতারণায় ফুটে উঠেছে রেহেনের জীবনের করুন কাহিনী৷ নির্দেশক দারুণ ভাবে ব্লকের মাধ্যে টুকরো টুকরো দৃশ্যের মাধ্যমে বেশ দক্ষতার সাথেই বুনেছেন। নাটকের সংলাপ ও অভিনয় গুণে সমৃদ্ধ এই নাটক। রেহানে চরিত্রে প্রমিতা ব্যানার্জী তাঁর দৃপ্ত কন্ঠ ও আঙ্গিক অভিনয়ে রেহানের যন্ত্রণাকে ফুটিয়ে তুলেছেন, যা দর্শক মনে খুব সহজেই জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়েছে। বাবার চরিত্রে দেবজীৎ ব্যানার্জীর কন্ঠ ও অভিনয় চরিত্র নির্মাণে যথাযথ। প্রতিটি চরিত্রই নিজস্বতা বজায় রেখেছেন তাদের নিজ নিজ চরিত্রে৷ রেহানের মা করেছেন রাজশ্রী , কোরাস এই নাটকে একটা আলাদা মাত্রা এনে দিয়েছে৷ পরিচালনায় এবং সারবন্দীর চরিত্রে পরিচালক ভাস্কর সান্যাল এক কথায় অনবদ্য৷ ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে, গল্পের পরিস্থিতির সাথে তাল মিলিয়ে রস্ট্রামের ব্যবহার নাটককে জীবন্ত করেছে৷ সব কিছুর সাথে রেহানে জব্বরীর বেদনাময় জীবন আসলে স্থান কাল ভেদে সমস্ত স্বৈরাচারী, পুরুষ তন্ত্রের এক জীবন্ত দলিল এই নাটক। এছাড়া দু’জন বিচারপতি চরিত্রে আলোক ব্যানার্জী ও প্রেমাংশু দাশগুপ্ত তাঁদের অভিনয় শৈলী উজার করে দিয়েছেন।
বাবলু সরকারের আলো এই নাটক নির্মাণে এক আলাদা মাত্রা যুক্ত করেছে। সুনিপুণ আলোক সঞ্চালন নাটকের গভীরতা তৈরি করেছে।
নিক্ষেপন প্রতিটি কলাকুশলীর উপরে, খুব সুন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে চরিত্রের প্রকাশ আরও প্রাণবন্ত হয়েছে৷ কোরিওগ্রাভির ব্যবহার গল্পের সৌন্দর্য্যের বৃদ্ধি ঘটিয়েছে ৷ প্রতিটি চরিত্র নিজস্বতা বজায় রেখেছেন সকল অভিনেতাই৷ রেহানের মা করেছেন রাজশ্রী , মদ্যপ বাবা প্রত্যেকে আপন চরিত্রে সাবলিল৷ কোরাস এবং তার সাথে প্রতিটি পার্শ্ব চরিত্র অসাধারণ ৷ পরিচালনায় এবং সারবন্দীর চরিত্রে, ভাস্কর সান্যাল উভয় দিকেই সমান পারদর্শিতা বহন করেছেন৷ ভিন্ন পরিস্থিতিতে, গল্পের পরিস্থিতির সাথে রস্টামের ব্যবহার গল্পকে আরও বাস্তব রূপ দান করেছে৷ সব কিছুর সাথে রেহানে জব্বরীর বেদনাময় জীবন ,এই নাটকের মধ্য দিয়ে, জীবন্ত হয়ে, দর্শকের সামনে ধরা দিয়েছে ৷ মঞ্চ পরিকল্পনায় নীলাভ চট্টোপাধ্যায় , আবহ – দিপ্ত কৈরী, মঞ্চ নির্মাণ অজিত রায় সকলে সফল।
অতএব বাংলা নাট্যচর্চায় রেহানে এক নাম ধীরে ধীরে দর্শকের মনে জায়গা করে নিতে পেরেছে, তার প্রমাণ তারা আগামীতে বেশ কয়েকটি অভিনয় করছেন।