সিনেমার চিত্রনাট্যে দেশভাগের যন্ত্রণা

- Advertisement -

সুব্রত রায়

১৯৪৭ সাল ভারতবর্ষ থেকে পাততাড়ি গোটালো ব্রিটিশ উপনিবেশ। ৩টি খন্ডে দুটি রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলো অখন্ড ভারত। ভাগ হল বাংলা। অসংখ্য মানুষ আজন্মের  ভিটেমাটি ছেড়ে চলে গেল নিজের নতুন দেশের খোঁজে। ব ভারত, বাংলাদেশ  ও পাকিস্তান এই তিন  রাষ্ট্রের সম্পর্ক ও পরবর্তী রাজনীতির বড় নিয়ামক হয়ে উঠল দেশভাগ।

আধুনিক ভারতবর্ষের ইতিহাসে দুটি ট্রাজেডি খুবই ভয়ঙ্কর। একটি ঘটেছে ১৮৫৭ সালে আরেকটি উনিশশো সাতচল্লিশ সালে। একটি অন্যটির সঙ্গে যুক্ত। মাঝখানে আছে স্বাধীনতা সংগ্রামের মহাকাব্য। কিন্তু সেই সংগ্রামের পরিণতি মহাকাব্যিক হয়নি,হয়েছে ট্রাজিক ১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ ই আগস্ট যে ঘটনাটি ঘটলো আপাতদৃষ্টিতে তা ছিল প্রায় অসম্ভব এবং পুরোপুরি অকল্পনীয়। কেউ ভাবেনি এমন টা ঘটবে। স্বাধীনতার নামে যে ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস পাওয়া যাবে এবং ভারতবর্ষে যে অস্ট্রেলিয়া কানাডার মত ডমিনিয়ন হয় ব্রিটিশ কমনওয়েলথ এর ভিতরেই রয়ে যাবে,এটা মোটামুটি জানা ছিল। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ এ ব্যাপারে সম্মত ছিল। কিন্তু দেশভাগ ঘটবে বাংলা ও পাঞ্জাবদু টুকরো হয়ে  দুটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের অংশ হবে এটা কল্পনাও করতে পারেনি।

ওই যে  এক জাতির দেশ বলে দাবি করা এর ভেতরে কিন্তু লুকিয়ে ছিল সাতচল্লিশের দেশভাগের বীজ ।কারণ এক জাতির দেশ বলার অর্থ দাঁড়িয়েছিল হিন্দুদের দেশ বলা। আসলে ভারতবর্ষে তো কখনই এক জাতির দেশ ছিলনা ছিল বহু জাতির দেশ। হাঁটছি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি ধর্ম নয় ,ভাষা। সে হিসাবে হাজার ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষে একটি-দুটি নয় ১৭ টি জাতি ছিল। ভারতবর্ষের মানুষের জন্য প্রধান সমস্যাটা ছিল শ্রেণীর। কিন্তু কংগ্রেসে লীগ কেউই শ্রেণী সমস্যার সমাধান চান নি। দুই দলই ছিল বিত্তবানদের সংগঠন,তারা চেয়েছে ইংরেজ শাসকরা তাদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে চলে যাবে এবং তারা গদিতে বসে ঠিক সেভাবেই  দেশ শাসন করবে যেভাবে ইংরেজরা করেছে। শাসন মানে আগের মত দাঁড়াবে শোষণ। শ্রেণী বিভাজনের  সমস্যার সমাধান করতে যে সমাজ বিপ্লবে প্রয়োজন ছিল সেটা কংগ্রেসও লীগ কেউ চাইনি, ইংরেজরাও চাইনি। ধর্মকে কংগ্রেস ও লীগ উভয়ই ব্যবহার করেছে এবং ইংরেজ তাতে হাওয়া দিয়েছে। সাম্প্রদায়িকতা শেষ পর্যন্ত রূপ নিয়েছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার। এবং সিদ্ধান্ত দাঁড়িয়েছে দেশভাগ ছাড়া গত্যন্তর নেই।

প্রশ্ন ওঠে এর দায়দায়িত্ব কার কতটা? দৃশ্যমান দায়িত্ব কংগ্রেসও লীগের। কংগ্রেসের অধিক কারণ তাদের এক জাতি তত্ত্বের কারণেই দ্বিজাতি তত্ত্বের উদ্ভব হয়েছে। কংগ্রেস অবশ্য বলবে যে স্বতন্ত্র বাসভূমির দাবি লীগই করেছিল। আসলে লীগের দাবিটা ক্রিয়া নয় প্রতিক্রিয়া। তবে কাজের আসল কাজী কংগ্রেস নয় লীগও নয় ইংরেজ শাসক। পাকিস্তান তো হওয়ারই কথা নয়। কারণ পাকিস্তান জাতি বলে কোন জিনিসেরই অস্তিত্ব ছিল না। ছিল বাঙালি, পাঞ্জাবি ,সিন্ধি বেলুচ ও পাঠান। এমনকি ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে যে বাংলাদেশের অভ্যুদয় সেখানেও ধর্মনিরপেক্ষতাকে আপস করতে হয়েছে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের সঙ্গে। কারণটা পুরনো। শ্রেণী চেতনাকে বিকশিত হতে না দেওয়ার বাসনা। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের ফলে দেশভাগ সম্ভব হয়েছে।

বাংলায় তো গৃহস্থের রান্নাঘর চলে গেছে হিন্দুস্থানে, শোবার ঘর পড়েছে পাকিস্তানে।বাংলা নদীর দেশ। প্রায় সব নদীর ওপর থেকে নিচে নেমেছে। নদীকে তো কাটা যায় না, তবু কাটা হয়েছে এবং তাতেই বোঝা গেছে কেমন অবাস্তব ঘটনাটা। অবিশ্বাস্য দেশভাগের লাভ যে হয়নি তা নয়,হয়েছে ।তবে সেটা সুবিধাভোগীদের ,শ্রমজীবীদের ভাগ্যে বঞ্চনায় সত্য হয়ে রয়েছে। এপারে যেমন ওপারে ও তেমন। এই ইতিহাসটাই উদ্বাস্তু সমস্যার জন্য দায়ী। যার ফলে পৃথক পৃথক রাষ্ট্র তৈরি হয়েছে। আর রাষ্ট্র মা নেই  কাঁটাতারে ঘিরে রয়েছে যে সীমান্ত। রাষ্ট্র মানে ম্যাপে বাধা দিগন্ত। রাষ্ট্র মানে একলা মানুষ বেচারা মানুষ পরবাসী নিজের ঘরেতে।

ঋত্বিক ঘটক বলেছিলেন আমরা আসলে উদ্বাস্তু মানসিকতার শিকার। সুবর্ণরেখা ছবিতে সূত্র হিসেবে উদ্বাস্তু সমস্যা কাজ করেছে। কে উদ্বাস্তু নয়? প্রেস কর্মচারীর সংলাপ। আমরা সকলেই যে জীবনের মূল হারিয়ে বাস্তুহারা হয়ে গিয়েছি একথাটাই ঋত্বিক সুবর্ণরেখাছবিতে  বলতে চেয়ে ছিলেন। আর এ কথাটা বলার জন্য তিনি কোন স্লোগানকে আশ্রয় করেননি, মানুষ এদেশে তার মূল হারিয়ে ফেলেছে। এটা একটা বড় রকমের সংকট নিশ্চয়ই। এই সংকট থেকে আমাদের সর্বনাশ। উদ্বাস্তু সমস্যা টা নিশ্চয়ই একটা রাজনৈতিক বিষয়। এই সমস্যা ঘুরে ফিরে এসেছে ঋত্বিক ঘটক এর  ছবিতে। অনেকে বলেন তাঁর ছবিতে দেশভাগ ও উদ্বাস্তু সমস্যাটা খুব বড় বিষয়। আমি বলব হ্যাঁ নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু এগুলো এসব নয়। আবার এগুলোকে বাদ দেওয়া যায় না। কারণ ঋত্বিক ঘটক সেই শিল্পী যিনি নিজের বিরুদ্ধে হলেও সিনেমাতে সব সময় সত্যি কথা বলে গেছেন। পাশ্চাত্যে আন্দ্রেই তারকোভস্কি র  সঙ্গে এখানে যেন কোথায় নিবিড় যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়।

একালের বাংলাদেশ উঠে এসেছে কোমল গান্ধার ছবিতে। দেশটাকে দু’ভাগ করা হলো। সেই যন্ত্রণায় এই দেশ ক্ষতবিক্ষত। এক অনিশ্চিত স্বাধীনতা এদেশের মানুষ দ্বন্দ্ব বিক্ষুব্ধ। রাষ্ট্রীয় ঐক্যের আদেশ বিনা বিবেচনায় চাপিয়ে দেওয়ার ফলে অবদমিত চিত্ত ,আর সেই অবদমনের  ফলস্বরূপ পশ্চিমী সভ্যতার রসে পরিপুষ্ট জাতীয় নেতাদের চিন্তা রাষ্ট্রের দেউলিয়াপনা একইরকম দেশজ ও  আন্তর্জাতিক কারণ এর ফলশ্রুতিতে দেশের চরম দুর্গতি। কোমল গান্ধার এর লক্ষ্য সেই অধোগমনের,সেই মূল্যহীনতা ও আশ্রয় হীনতার  চিত্রায়ন। বস্তুত কোমলগান্ধার এমন একটি ছবি আঁকে কেবল অনুভব করা যায়। পেট্রাপোল সীমান্তে একদল নাটক পাগল ছেলে মেয়ে যায় নাটক করতে। ভৃগু অনুসূয়ার কথোপকথনের মাঝে দীর্ঘ বলে ওই যে দূরে আলো দেখতে পাচ্ছ ওখানে আমার গ্রাম। কিন্তু আজ ওটা বিদেশ। ওখানে যেতে গেলে কাঁটাতারের বেড়া টপকাতে হয় ,পাসপোর্ট লাগে। যে রেল লাইনটা গেছিল যোগ চিহ্ন টা যেন আজ বিয়োগ চিহ্ন। এরপর রেললাইনের ট্রাকের ওপর দিয়ে ক্যামেরাটা আসে এবং বাপারে ধাক্কা খায় আর স্ক্রিনটা ব্ল্যাক হয়ে যায়,অন্ধকার হয়ে যায়,অন্ধকার হয়ে যায়। মমতাজের সার্থক ব্যবহার করেন ঋত্বিক। সত্যজিৎ রায় একবার বলেছিলেন ঋত্বিক এর  ছবির উপর বিদেশী কোন ছবি প্রভাব নেই,যদি থেকে থাকে তাহলো রাশিয়ান ফিল্ম এর প্রভাব। আবেগ ,বিশৃঙ্খলা ইত্যাদি অনেক ত্রুটি সত্ত্বেও আমরা একথা বুঝতে পারি যেএ  ছবি ঋত্বিক ঘটকের ছবি। নির্মাণের অনেক দুর্বলতা সত্ত্বেও তা হয়ে ওঠে সৃষ্টি তা কেবল আমাদের মনে করিয়ে দিতে চাই ,ঘরে ভাঙ্গা ঘর কত বলিষ্ঠবাহু ওঠাবে।

ঋত্বিক ঘটক চলচ্চিত্র জগতে পা রাখেন নিমাই ঘোষের ছিন্নমূল সিনেমার মধ্য দিয়ে, যা দেশভাগের কথাই বলেছিল প্রতিটি পর্বে। তিনি একই সাথে অভিনয় ও সহকারি পরিচালক এর কাজ করেন। এর দু’বছর পর তার একক পরিচালনায় মুক্তি পায় নাগরিক। দুটি চলচ্চিত্রে ভারতীয় চলচ্চিত্রের গতানুগতিক ধারা কে জোর ধাক্কা দিতে সমর্থ হয়েছিল। এরপর খানিক বিরতি। চলচ্চিত্রের শিক্ষকতা করে কাটছিল দিন। কয়েক বছর পরে আবার লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশন।টালিগঞ্জ স্টুডিও পাড়া তখন রোমান্টিক ছবির মোড় থেকে বেরিয়ে পরিণত হওয়ার পথে। এমনই সময় কলকাতা ট্রিলজির জন্ম নিল ঘটকের হাতে। সৃষ্টি হল মেঘে ঢাকা তারা, কোমল গান্ধার, এবং সুবর্ণরেখা।

সিনেমা আমার চোখে অভিমান, দুঃখ মানুষের কাছে তুলে ধরার মিডিয়াম। এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন ঋত্বিক ঘটক। ভিটেমাটি হারানোর বেদনা অভাব না পাওয়ার যন্ত্রনা জীবনের মানে বদলে যায় রাতারাতি, এ কেমন জীবন যেখানে স্বপ্নের জগত বাস্তবের কাঁটাতারে আটকে পড়ে। এ কেমন জীবন যেখানে মানুষ যা চাই তা পাই, না যা পাই তা চাই না।অবহেলা নির্যাতনের এমনই ছবি সিনেমার পর্দায় এঁকে দিয়েছেন তিনি, যা আজও দর্শকমনে চাবুকের মতো দাগা  দেয়।

রুপোলি পর্দায় রঙিন বিনোদন নয় ঘটক তুলে ধরেছিলেন বাংলার এক অন্য ছবি,যা দারিদ্র্যের অন্ধকারে ঢুকে থাকে সকলের অলক্ষ্যে। শক্তিপদ রাজগুরুর মূল কাহিনী চেনামুখ অবলম্বনেচলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লেখার মৃণাল সেন। তৎকালীন দেশভাগের কবলে পড়া আশ্রয়হীন মানুষের এক জীবন্ত উদাহরণ নিতা ও তার পরিবার। দুঃখের দৃশ্যে তার সানাই  কিংবা সে তার নয় শেষ অংশে চাবুক কেই হাতিয়ার করেছিলেন ঘটক হৃদয়ের যন্ত্রণা ফুটিয়ে তুলতে।

ছবির বিষয় হলো  ভারত বিভাজনের পর শরণার্থী সমস্যা। এই ছবির কেন্দ্রে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের নিবেদিতপ্রাণ ওয়াপোসিন মানসিকতা। ঋত্বিক ঘটক তার নিজস্ব ভঙ্গিতে দেশভাগ, আদর্শবাদ, দুর্নীতি, শিল্প জীবনের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা। শিল্পের পরিধিতে শ্রেণীসংগ্রামের বিষয়টিও তুলে ধরেন। বাংলা, বাঙালি ,বাংলা ভাবধারা ছিল ঘটকের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।সত্যজিৎ রায় তাকে উল্লেখ করে রেখেছিলেন ঋত্বিক মনেপ্রাণে বাঙালি পরিচালক ছিলেন, বাঙালি শিল্পী ছিলেন ।আমার থেকে অনেক বেশি বাঙালি আমার কাছে সেটাই তার সবচেয়ে বড় পরিচয় এবং সেটাই তার সবচেয়ে মূল্যবান লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য।

লিটিল টেরোরিস্ট শর্টফিল্মটি অশ্বিন  কুমার নির্মাণ করেন। ২০০৪ সালে। এটি একটি অস্কার নমিনেটেড শর্ট ফিল্ম। পাকিস্তানের একটি বাচ্চা ছেলে ক্রিকেট বল কুড়াতে ভারতে এসে ঢুকে পড়ে। জায়গাটা সম্ভবত রাজস্থানের বর্ডার। পুলিশ তাকে আতঙ্কবাদী  বলে মনে করে। আর  রাজস্থানের যে গ্রামে সে আশ্রয় নেয় একটি পরিবারে সেখানে পুলিশ তার জন্য খানাতল্লাশি করে। কিন্তু ওই পরিবারটি তাকে পুত্র-স্নেহে রক্ষা করে এক অদ্ভুত উপায়। সঙ্গে সঙ্গে তার মাথা ন্যাড়া করে দেয় যাতে। তাকে পুলিশ চিনতে না পারে। পুলিশ আসে এবং তাকে চিনতে পারে না। জিজ্ঞেস করে তোর নাম কি? সে কিছু বলে না। মাস্টারজি বলেন ওর নাম জহরলাল। পুলিশ জিজ্ঞেস করে ও কি কথা বলতে পারে না? ভদ্রমহিলা অর্থাৎ মাস্টারজির স্ত্রী বলেন ও তো ছোট থেকেই বোবা। পুলিশ আর সন্দেহ করে না। পরে মাস্টারজি ও তার স্ত্রী ওই ছেলেটিকে পাকিস্থানে  তার বাবা-মায়ের আশ্রয় ফিরিয়ে দেয়।

ছবিতে মাস্টারজি তার স্ত্রী ও এই  বাচ্চা ছেলেটির মধ্যে যে আবেগঘন দৃশ্য নির্মিত হয়, পরিচালক অতি সহজেই তা দর্শকের মধ্যে ইঞ্জেক্ট করে দিতে পেরেছেন। বিশুদ্ধ সিনেমার এটা একটা বিশেষ গুণ। আর একটা বিষয় মনে হয় এই ছবিটি দেখে রাস্ট্রব্যবস্থা  ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে সন্দেহ অবিশ্বাস এর বাতাবরণ তৈরি করেছে তা কোনোভাবেই দুই দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে কোন প্রভাবই  ফেলেনি। বরং তাদের মধ্যেই সে সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্ক তা যেন মানবতার জয়গান। রাস্ট্র নিজের কায়েমী স্বার্থের জন্যই এই বিভেদকে জিইয়ে রাখতে চায়  ।ছবিটি ফর্মও কনটেন্ট মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। তার সঙ্গে মিউজিক খুব ভালোভাবেই ছবিকে সাপোর্ট করেছে।

বর্ডার কে উসপার ছবিটিতে রাজস্থানের তিনটি জেলা বিকানির জয়সলমীর গঙ্গানগর এর সাথে পাকিস্তানের সিন্ধু ও পাঞ্জাব এর বর্ডার কাহিনীটির  সিনেমাটিক স্পেস হয়ে উঠেছে। কাহিনীর মধ্যে এই বার্তাটি খুবই স্পষ্ট যে রুখা সুখা রাজস্থানের প্রাকৃতিক অঞ্চল কিন্তু তাদের রুক্ষ করেনি,বরং সেখানে মানবিক গুণ অধিক পরিমাণে আছে। একদল ভেড়ার নিয়ে রাজস্থানের গ্রামের একটি বাচ্চা ছেলে ভেড়া চরাতে  যায় পাকিস্তানের সীমান্তে ।সীমান্ত মানে কাঁটাতার। সেখানে ছেলেটির একটি ভেড়া কাঁটাতার টপকে পাকিস্তানে চলে যায়। ধরারা কাঁটাতার জানে না,জানে না,ভারত ও পাকিস্তান। তারা জানে যেখানে খাবার আছে সেখানে যেতে হবে। একটু পরে বাচ্চা ছেলেটি দেখে তার ভেড়াটি সীমান্তের ওপারে চলে গেছে। সে নিজেও নানাভাবে সীমান্তের ওপারে যাওয়ার চেষ্টা করে ,কিন্তু ব্যর্থ হয়। সেই সময় একজন পাকিস্তানি তার ভেড়াটি  নিয়ে চলে যায়। বাচ্চাটি চিৎকার করে বলে ভাইসাব এটি আমার ভেড়া। ঠিক এই সময় স্থানীয় পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছয় ।পুলিশ ছেলেটিকে বলে এটা বর্ডার এর একদিকে ভারত অন্যদিকে পাকিস্তান। ভুলে যাবে এসব ।তখন বাচ্চাটি যখন পুলিশের সাথে তর্ক করে আর তার ভেড়া টি  ফিরিয়ে আনার জন্য পুলিশকে উদ্যোগ নিতে বলে। তখন পুলিশটি বলে আমরা মুনিয়া চাইলে ওরা পাকিস্তান চাইবে,আমরা সন্ধ্যে চাইবো তো ওরা সূর্য চাইবে। আমরা রাত চাইবো তোরা দিন চাইবে। এরপর বাচ্চাটি বিফল মনোরথ হয়ে বাড়ি ফিরে আসে।

কিন্তু সে ভুলতে পারে না তার আদরের ভেরাটি ওপারে রয়ে গেছে। রাতের বেলায় সে দাদুর সাথে বাইরে শুয়ে পড়ে। আর একটি প্লাস দিয়ে শেষ সীমান্তে যায়। দু’পারে একই আকাশ। বাচ্চাটি পাকিস্তানের প্রবেশ করে। তার আদরের ভেড়াটিকে প্রায় ফিরিয়ে আনতে প্রস্তুত হয়। যে বাচ্চা ছেলেটি ওখানে আছে এই ভেড়া টির জন্য ওপারের বাচ্চা ছেলেটির শরীর অনেক ভালো হয়েছে। এ কথা সে তার মায়ের কাছ থেকে শুনতে পায়। দুদিন আগে যখন তাদের ভেড়া টি মারা যায় তখন বাচ্চাটির জ্বর হয়। এটি আসার ফলে সে অনেক সুস্থ। ক্যামেরা টিল্ট আপ করে আকাশ দেখায়। বর্ডারের ওপারে বাচ্চা ছেলেটি নির্নিমেষ দৃষ্টিতে পাকিস্তানের পরিবারের সুখ ও শান্তি দেখে অপার  প্রশান্তি লাভ করে। তখন পাকিস্তানিটি একটি  সাদা কাপড় বাচ্চাটিকে দেয়। এ যেন পাকিস্তানের তরফ থেকে শান্তির বার্তা। ছেলেটিও খেলতে খেলতে কাপড় নিয়ে ফিরে আসে। এই ছবি ও প্রমাণ করলো রাস্ত্র নিজের প্রয়োজনে সীমান্ত সন্ত্রাস জারি রাখে। দু’দেশের মানুষরাই চায় শান্তিতে বাস করতে ।এটাই এই ছবির এক মহান বার্তা।

ইন্ডিয়া পাকিস্তান নাম্বার ১১৮০। ছবিটি রাজস্থানের একটি গ্রামের কাহিনী যেটা পাকিস্তানের বর্ডার এর সাথে যুক্ত। দাদা ও বোন উট চরাতে চরাতে ক্লান্ত হয়ে এক রাজস্থানীর  বাড়িতে জল চায়। তারা সেখানে জল খায়। গৃহকর্ত্রীর স্নেহ ও পায়।এরপর বোনকে বসিয়ে রেখে দাদা যায় উট  খুঁজতে। কিন্তু উট ততক্ষণে পাকিস্তানে চলে গেছে। এখানে বর্ডারে কোন কাঁটাতার নেই। কিন্তু সীমান্তের চিহ্নস্বরূপ দুটি পিলার আছে একটি ভারতের সীমারেখা অন্যটি পাকিস্তানের সীমারেখা। অদৃশ্য সীমারেখা ছেলেটিকে আর এগোতে দেয় না। এই ছবির রুক্ষ  পটভূমি চরিত্রগুলির সেন্স অফ হিউমার এর পক্ষে অন্তরায় হয় না। খুবই ছোট ছবি কিন্তু এক গভীর দার্শনিক বোধে দর্শককে ভাবায় ।কাঁটাতার বা গণ্ডি  থাক বা না থাক ,এক অদৃশ্য গণ্ডি দর্শকের মনে ছাপ রেখে যায়।

পিকেট ৪৩ ছবিটি করেন মেজর রবি। একজন মেজরের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পুরো ছবিটি অনুভব করতে হবে। কেননা রাষ্ট্র হাবিলদার হরি আর  হাবিলদার মোশারফকে জড়িয়ে দেয় নিজেদের স্বার্থে। কিন্তু তাদের পরস্পরের মধ্যে যে ভাতৃত্ববোধ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে তাহলে মানবতার জয়গান করেছে।এই ছবি দেখে দর্শক হিসেবে আমার মন সমস্ত গ্লানি হিংসা ভুলে যায় ।তাছাড়া একটা জিনিস আমাকে ছোটবেলা থেকেই বিস্মিত করেছে যে এরকম একটা মোহময় প্রাকৃতিক পরিবেশে কিভাবে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও  হিংসা চলতে পারে। সাদা বরফের উপর লাল রক্তের রং মনকে বিষন্ন করে। সেই বিষন্নতার মাঝে এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস হরি ও মোশারফের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। এ রকমই হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু দিনে দিনে সবকিছু আরো খারাপ হচ্ছে। ছবিতে ডিটেলিং এর  ব্যবহার আর মন উচাটন করা মিউজিক দর্শকের মন আরো গভীরভাবে ছুঁয়ে যায়।

যারা দেশভাগের পর এপারে চলে এসেছিল রিফিউজি হয়ে অথচ কোনদিন মুসলিমদের দিকে অভিযোগের আঙুল তোলেনি, এসব ছবি তাদেরকে উৎসর্গ করা উচিত। আসলে অন্ধ বিদ্বেষ কিছু দিতে পারেনা। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে এগোতে হবে। কোন কাঁটাতার ভিসা-পাসপোর্ট আমাদের মধ্যে বিভেদ এর জন্ম দিতে পারে না। সীমান্ত আসলে আমাদের মনে, মনের মধ্যেকার বিদ্বেষ। তার মধ্য থেকে বের হতে না পারলে আধুনিক ভারতের মুক্তি নেই।

- Advertisement -
সাম্প্রতিক পোস্ট
এধরনের আরও পোস্ট
- Advertisement -