দুলাল চক্রবর্ত্তী
অতি সম্প্রতি হাওড়া স্বপ্ন সৃজন দল তিমিরের খোঁজে শীর্ষক একটি নাটক নির্মাণ করেছে। যেটি আদপে চলচ্চিত্রের মতো। ঘটনায় জুড়ে থাকা একটা অবস্থা কীভাবে যেন নাটকের আকার নিয়ে নেয়। যা ঘটনা থেকেই সংবেদনশীল ভাবে জন্ম নিয়েছে। শ্যুটিং চলছে। টেকনিশিয়ান এবং অভিনেতা অভিনেত্রী, সাথে লাইট মেকাপ শব্দ, সেট ইত্যাদির মধ্যেই উঠে আসছে তিমিরকে খোঁজার প্রকৃয়া। আমরা দেখতে দেখতে বুঝছি, বুঝতে বুঝতে দেখছি। সত্তরের দশকে মৃণাল সেন কলকাতা ৭১ চলচিত্র নির্মাণ করেছিলেন। সেখানে একটি চরিত্র ছিল। সে ছিল প্রতিবাদী যুব সমাজের প্রতীক। যে প্রতিবাদের বিপ্রতীপ স্রোতে হারিয়ে গেছিল। কলকাতা একাত্তরে সিনেমায় দেখানো হয়েছিল দিন বদলাতে চেয়ে ছাত্র যুব আন্দোলন চলছে। একদিন ক্লাস চলার সময় কলেজে বোমা পড়ে। পুলিশ সন্দেহের বশে সেই যুবককে ধরে নিয়ে যায়। যে ছিল শান্ত এবং লেখাপড়ায় খুব ভালো। তবে সে কীভাবে অপরাধে যুক্ত হলো, তার মিমাংসা হয় নি। কিন্তু সে পরিবার বিচ্যুত হয়েছিল। একেবারেই নিখোঁজ। তাকে খুঁজতে তার বাবা আর বন্ধু সুদীপ্ত থানায় যায়। থানা সন্ধান দিতে চায় নি বলেই পারেনি। তারপর তাকে খুঁজে না পেয়ে তারা যায় মর্গে। কিন্তু শেষ অবধি তার খোঁজ কোথাও পাওয়া যায় না। দেবরাজ রায়ের সেই মুখ মনে আছে।
এরপর ৫০ বছর অতিক্রান্ত। ২০২৩ সালে একজন পরিচালক পিপলস ফান্ডিং থেকে ফিল্ম বানাতে শ্যুটিং করতে ইছামতি নদীর ধারে একটি গ্রামে গিয়েছে। সেখানে তিমিরের খোঁজে শীর্ষক চলচ্চিত্রের শুটিংয়ের ব্যবস্থাপনা চলছে। এই চলচ্চিত্র ভাবনায় জড়িয়ে আছে সামাজিক অন্ধকারের চেহারা। আছে ভিন্ন এক ভাবনা। কিন্তু সেখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাধা হয়ে দাঁড়ায়। মেঘ, বৃষ্টিতে তাদের শ্যুটিং করা অসম্ভব হয়ে ওঠে। কিন্তু বৃষ্টির মধ্যেই শুটিং দেখতে আসা বা গ্রামের কৌতুহলী ভীরের মধ্যেই তারা খুঁজে পায় শচী কে। এই শচী আরেক মা। যে কিছু দিন আগে তার পরিবেশ কর্মী ছেলে বাদলকে হারিয়েছে। অতএব আলো শুষে নেওয়া রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস অন্ধকারের প্রচ্ছায়া পড়ে গল্পে। নিজেদের কায়েমি স্বার্থ তিমিরে হাবুডুবু খাওয়া গদি দখল করার নগ্ন সময়কে দেখতে পাই। আমরা ভালমন্দ বিচারের চেষ্টা করি। বর্তমান সময়ের জটিল ঘূর্ণাবর্ত অশুভ সময়কে বুঝে নিতে গল্পে মনোযোগ দিই।
ভাল লেগেছিল ব্যঞ্জনা ব্যঞ্জনে সাজাতে চাওয়া রাজনৈতিক দৃষ্টি ভঙ্গিমার না নাটকের চেহারা। যেহেতু নাটকে এসেছে প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে আলো আনার ইচ্ছা বাসনা। তাই তো যখন বৃষ্টি থামে। চেষ্টা চলে তিমিরকে খুঁজে বেড়াবার। শ্যুটিং বারবার শুরু হয়, আর বন্ধ হয়। সমস্যায়, এলাকার নানা বাধায়, মাথা উঁচিয়ে উঠে বসে সময়ের জ্যান্ত তিমির। আলোর বড্ড অভাব। দেখা যায় না সত্যি মিথ্যের বিভেদ। তবুও ক্যামেরাম্যান লন্ঠণের আলোতে শ্যুটিং করতে রাজি হয়। কিন্তু পরিচালক এই পরিস্থিতিতে উদ্ভুত তিমিরের বেড়া জালে আটকে পড়ে, তিমিরকে খোঁজার শুটিং থেকে বিরত হয়ে রণে ভঙ্গ দিতে চায়। কিন্তু বাদলের মা শচী এসে দাঁড়ায়। তার কথায় তিনি সম্বিত ফিরে পান। শুটিং শুরু হয়। উনিশশো একাত্তরের তিমিরের মা বিমলা তিমির কে খুঁজতে খুঁজতে দু হাজার তেইশের বাদলের মা’র সাথে সুপারইমপোজড হ্য়। বিমলা যেন শচীর মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। এই তুলনায় কল্পিত অন্ধকার দেখানোর প্রতিকীরূপে আমরা ভিন্ন বক্তব্য আস্বাদ পাই। আপ্লুত হই। সবাই-ই হয়তো হতে পারি। যারাই দেখতে দেখতে বুঝেতে বুঝতে এগোবার চেষ্টা করবো। কারণ তিমির বাদলরা হারিয়ে যাচ্ছে। ফ্যাসিবাদের হাঙ্গরে গিলে খাচ্ছে প্রতিবাদ, বিপ্লব কিম্বা বিদ্রোহ। সন্তান হারানো দুই মা এখন স্থান কাল সময় ছাড়িয়ে অন্ধকারের সামনে দাঁড়ায়। তিমির কে খুঁজতে বেরিয়ে আজ তারা তিমিরের মুখোমুখি। তখনই অতীত এসে বলে আলো, আরো আলো আনো,…. একই অন্ধকারাচ্ছন্ন নিরুত্তাপ, নিরুত্তর, সময়কে ব্লেন্ডিংয়ে মিলিয়েই তিমিরের খোঁজে একটি না নাটক, না সিনেমার মধ্যেকার সমসাময়িক বিশ্লেষণ। পুরো নাটকীয় তৃপ্তি নেই। কিন্তু দীপ্তি আছে ভাবনার, চেষ্টা আছে ভাবাবার। তাই সার্থক তিমিরের খোঁজে।
বিখ্যাত চিত্রপরিচালক মৃণাল সেন এর শতবর্ষে তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে হাওড়া স্বপ্নসৃজন “তিমিরের খোঁজে”-নাটকটি নির্মাণ করেছে। খুব স্বাভাবিক ভাবে উঠে আসে সত্তরের দশকে মৃণাল সেন এর সময় কে তুলে ধরার অকৃত্রিম চেষ্টার পাশে পঞ্চাশ বছর পরের বাস্তবতার তুলনামূলক বিচার।
কোথাও যেন কলকাতা -৭১ মিলে মিশে যায় আজকের এই দেশ,এই সময়ের প্রসঙ্গের সঙ্গে। আজ প্রশ্ন একটাই—“আমরা কি তিমির বিলাসী/ (???),…জীবনের পক্ষে, “আমরা তো তিমির বিনাশী হতে চাই” (???) না-কি বলবো একি?
এই নাটকের রচনা ও নির্দেশনা তপন কুমার হাজরা। মঞ্চ, আলো, ও সিনোগ্রাফি–শুভজিৎ বন্দোপাধ্যায়ের কল্পনা সৃজন। আবহ সঙ্গীত তাপস রায়ের। আলো, আবহ এবং ভিডিও প্রক্ষেপক যথাক্রমে সৈকত মান্না এবং পিনাকী দাস (আলো), প্রতীক বেরা ও সৃজিত মন্ডল। অভিনয়ে দুরন্ত দুর্দান্ত আখ্যা দেবার মতো আলাদা কেউ-ই নন। সবাই অনবদ্য ভাবে সাবলীল ও স্বচ্ছন্দ। চরিত্রাভিনয়ে, শচী/ মৌ মুখার্জী, ওসি/ অভিজিৎ দত্তগুপ্ত, দারোয়ান ও প্রোডাকশন ম্যানেজার/ মলয় সাহা চৌধুরী, কৃষ্ণপদ/ প্রভাস হাজরা, চিফ আ্যসিস্ট্যান্ট/ সৌমদ্যূতি ভৌমিক, সুদীপ্ত/ প্রীতম নন্দী, বাবা/ সোমাঞ্জন মন্ডল, সুনীল, পাকড়াশি, ও বাদল / সৃজন কর্মকার, ক্যামেরাম্যান/ স্বরলিপি ঘোষ, মৌসুমী/ মৌসুমী মন্ডল, রাজু, গৃহস্বামী / রাজু বণিক, ছোট তিমির/ মাস্টার ঋক এবং চলচ্চিত্র পরিচালক তপন কুমার হাজরা। এই নাটকটি দেখেছিলাম ১৮ ফেব্রুয়ারী ফিনিকের নবম মিলন সাংস্কৃতিক উৎসবে নৈহাটি ঐকতান মঞ্চে। ইঙ্গিতের সঙ্গীতে একেবারে ব্যতিক্রমী এই নাটক না চলচ্চিত্র হয়ে ওঠার দর্পনারায়ণ ভ্রুণ।